আবারও আসছে কম আয়, কম ব্যয়ের বাজেট
কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় রাজস্ব বোর্ডের আওতাধীন রাজস্ব ব্যবস্থা থেকে ১২.১% প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যদিও গত অর্থবছরের সমান লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেও চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্জনে পিঁছিয়ে রয়েছে সংস্থাটি।
কোভিড পরবর্তী দ্বিতীয় অর্থবছরের জন্য ৬,৭৫,১৩৯ কোটি টাকার বাজেট প্রাক্কলন করেছে অর্থবিভাগ, যা জিডিপির ১৫.৫% এবং চলতি অর্থবছরের বাজেটের ১১.৯ শতাংশ বেশি। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫.৫ শতাংশে সীমিত রেখে এনবিআরকে ৩.৭০ লাখ কোটি টাকার লক্ষমাত্রা দেবে অর্থবিভাগ, যা জিডিপির ৮.৫%।
বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকারের আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার সংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল ও সরকারি সম্পদ কমিটি।
গতানুগতিক ধারায় আগের বছরগুলোর মতোই কম আয় ও কম ব্যয়ের বাজেট তৈরি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা বলছেন, নতুন বাজেটে কর ও কর বহির্ভূত রাজস্বের যে লক্ষ্যের কথা বলা হচ্ছে তা তা আদায় করা কঠিন হবে না। তবে এ লক্ষ্য পূরণ হলেও বাংলাদেশে জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায় হবে ১০ শতাংশের কম, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।
তারা আরও বলেন, করোনা থেকে পুনরোদ্ধারের পথে খাকায় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ দরকার। আর মানবসম্পদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বাড়াতে হবে। বড় ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে এ সব লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে না বলেও মনে করেন তারা।
দুই বছর আগে দেশে কোভিড শনাক্ত হওয়ার তিন মাসের মাথায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৩.৩০ লাখ কোটি টাকার লক্ষমাত্রা দিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষনা করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, যা ছিল জিডিপির ৮.৭৪%। অর্থাৎ, জিডিপির অনুপাতে আগামী অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা কমছে। যদিও অর্থনীতিবিদসহ সরকারের নীতি-নির্ধারকরা বিভিন্ন সময় কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে সংস্কারের উপর গুরুত্বারোপ করছেন।
গত অর্থ বছরের শুরু থেকেই কোভিড পরিস্থিতি মহামারি রূপ নেওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত এবং জন ও যান চলাচল। ওই বছর রাজস্ব আয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি দেখতে পায় বাংলাদেশ।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের আভাস মিললেও এনবিআরের লক্ষমাত্রা এক টাকাও বাড়েনি। যদিও অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষমাত্রার তুলনায় পিঁছিয়ে রয়েছে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা যৌক্তিক
রাজস্ব আয়ের এই লক্ষমাত্রাকে যথেষ্ট যৌক্তিক বলে মনে করছেন ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তবে প্রাক্কলন অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি ৫.৫% এ সীমিত রাখা ও ৭.৫% জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন করার জন্য যথেষ্ঠ চেষ্টা করতে হবে বলে জানান তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস)-কে তিনি বলেন, অর্জন অসম্ভব জেনেও আগে প্রতিবছরই এনবিআরকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব লক্ষমাত্রা দেওয়া হতো। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলিত লক্ষমাত্রা সে তুলনায় বেশ যৌক্তিক। কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরায় এটি অর্জনযোগ্য হতে পারে।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ টিবিএসকে বলেন, কোভিড নিয়ন্ত্রণে আসায় আমদানি-রপ্তানি বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যেও গতি ফিরেছে। ওমিক্রম ভয়াবহ রূপ না নিলে এবছর লক্ষমাত্রার কাছাকাছি রাজস্ব আদায় হবে এবং আগামী বছরও প্রাক্কলন অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারবে এনবিআর।
কর কাঠামো সংস্কার এখনও অবহেলিত
২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেট গতানুগতিকতার দিকেই যাচ্ছে মন্তব্য করে পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বছরের পর বছর ধরে কর কাঠামো সংস্কারের কথা বলা হলেও এ সংক্রান্ত কোন উদ্যোগই কাজে আসছে না। এর ফলে টাকার অঙ্কে অর্থনীতির আকার যে হারে বাড়ছে, বাজেটের পরিমাণও একই হারে বাড়ছে। এ অবস্থায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো অগ্রাধিকার খাতে প্রকৃত বরাদ্দ বাড়ানো যাচ্ছে না।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পাঁচ মাসে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৬৭ কোটি টাকা। এটি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৫% প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষমাত্রার তুলনায় ১৩ হাজার কোটি টাকা পিঁছিয়ে রয়েছে এনবিআর।
চলতি অর্থবছর মোট ৩.৮৯ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার, যা জিডিপির ১১.৩%। এর মধ্যে এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকা ও কর বহির্ভূত ৪৩ হাজার কোটি টাকার লক্ষমাত্রা প্রস্তাব করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছর জিডিপির ৯.৯% প্রাক্কলন করে মোট ৪.৩৩ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষমাত্রা স্থির করছে অর্থমন্ত্রণালয়। এর মধ্যে এনবিআর বহির্ভূত কর থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ও কর বহির্ভূত খাত থেকে ৪৫ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব লক্ষমাত্রা চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলন কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকতারা জানান, জিডিপির বেইসইয়ার পরিবর্তনসহ নতুন করে কয়েকটি খাত অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটে জিডিপির আকার অনেক বেড়ে যাবে। ফলে রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন যে হারে বাড়ানো হচ্ছে, জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আদায় সে হারে বাড়ছে না।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৩৪.৫৬ লাখ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছর তা বাড়িয়ে ৪৩.৬৩ লাখ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে।
কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে
২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য জিডিপির ৩২.২% বিনিয়োগ প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে বেসরকারিখাতে ২৫.৩% ও সরকারিখাতে ৬.৯% বিনিয়োগ আশা করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকতারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মাতলুব আহমাদ বলেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ সব সময় জিডিপির ২২-২৩ শতাংশের মধ্যে হয়ে থাকে। করোনার কারণে গত দুবছর বেসরকারি বিনিয়োগ থমকে ছিল। এখন ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ শুরু করেছেন। কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে আগামী অর্থবছর প্রাক্কলন অনুযায়ী বিনিয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন তিনি।
আগামী অর্থবছর যে বাজেটের আকার ৭১,৪৫৮ কোটি টাকা বাড়লেও এর বড় অংশই ব্যয় হবে পরিচালন ও সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধে। ফলে বাজেটের আকার যে হারে বাড়বে, সে অনুযায়ী উন্নয়ন ব্যয় বাড়বে না।
২০২২-২৩ অর্থবছরের ৬,৮৫,১৩৯ কোটি টাকার প্রাক্কলিত বাজেটের ২.৫০ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে, যা জিডিপির ৫.৭%। অন্যদিকে, পরিচালন ও অন্যান্যখাতে ব্যয় হবে ৪,২৫,১৩৯ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯.৮%।
চলতি অর্থবছর ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকার বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল ২,২৫,৩২৪ কোটি টাকা, যা ছিল জিডিপির ৬.৫%।
নতুন বছরের বাজেটের আকার সম্পর্কে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ৫.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি যোগ করলে অর্থনতির আকার বাড়ে ১৩ শতাংশ। এর বিপরীতে বাজেটের আকার 11.84 শতাংশ ও রাজস্ব আহরণ ১১.৩ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। এ হিসাবে জিডিপির তুলনায় নতুন বাজেটে প্রকৃত আয় ও ব্যয় কমছে।
এডিপি বরাদ্দ বাজেটের আকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়
চলতি বাজেটের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটে এডিপির বরাদ্দে প্রবৃদ্ধি থাকছে ১১%, এডিপি বাদে অন্যান্য ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১২%।
আগামী অর্থবছরের জন্য ৭.৫% প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করছে অর্থবিভাগ। চলতি অর্থবছর ৭.২% প্রবৃদ্ধি লক্ষমাত্রা ধরা হলেও ৬.৬% প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে চলতি সপ্তাহে পূর্ভাবাস দিয়েছে আইএমএফ।
এ প্রসঙ্গে জাহিদ হোসেন বলেন, রফতানি ও রেমিট্যান্স আয়ের ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে। তবে ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য হয়ত পূরণ হবে না। আগামীতে কতটা প্রবৃদ্ধি হবে তা নির্ভর করবে ওমিক্রনের আঘাতের ওপর।
বাজেট ঘাটতি ৫.৫% এ সীমিত রাখা কঠিন হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলোর গতি আনতে বাড়তি টাকা লাগবে। ওমিক্রনের কারণে করোনার বোস্টার ডোজেও অর্থ ব্যয় হবে। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫.৫ শতাংশে রাখা কঠিন হবে।
'প্রায় দেড় বছর শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এ খাতে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেছে। সামনে নতুন সংক্রমনের ঝুকি থাকায় অনলাইন ও সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে পারে। এক্ষেত্রেও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ দরকার'- যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আগামীতে বাজেটের আকার কত হলো এটার চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার খাত তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তায় কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া গেলো। এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাজেট বরাদ্দের কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
বাজেট ঘাটতির দিকে খুব একটা নজর না দিয়ে তিনি নমনীয় শর্তে বিদেশি ঋণের সবগুলো সুযোগ সর্বোচ্চ ব্যবহারের তাগিদ দেন।
দ্রব্যমূল্য বাড়লেও অপরিবর্তিত থাকবে মুদ্রাস্ফীতি
চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতি ৫.৫% প্রাক্কলন করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়, যা আগামী অর্থবছরও অপরিবর্তিত রাখা হবে। যদিও বছরজুড়ে চাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১২ মাসে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫.৪৪%।
এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে মূলত উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে। তা ছাড়া অর্থনীতি পুনরোদ্ধার হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদাও বাড়বে। এ অবস্থায় আগামীতে মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির বড় চ্যালেহ্জ হয়ে দাড়াতে পারে।