ফিকে হয়ে আসছে পুরান ঢাকার পাদুকা শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর আশা
মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন (৪৫), ১৯৮৮ সালে কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে ঢাকায় আসেন জীবিকার সন্ধানে। পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ১ হাজার টাকা বেতনে জুতার কারখানায় কাজ নেন শ্রমিক হিসেবে।
আস্তে আস্তে দক্ষতা অর্জন করে শ্রমিক থেকে কারিগরে পরিণত হন ইকবাল। তারপর ৬০ হাজার টাকা পুঁজি ও ৫ জন শ্রমিক নিয়ে ২০০১ সালে নিজেই সিদ্দিক বাজারে ভাড়া বাসায় গড়ে তুলেন ছোট একটি জুতা তৈরির কারখানা।
সবকিছু ভালোই চলছিল ইকবালের। কারখানাও বড় হতে থাকে ক্রমে। মাসিক টার্নওভার ছিল ২৫-৩০ লাখ টাকা। কারখানায় ৩০-৪০ জন কারিগর কাজ করত।
কিন্তু করোনার প্রভাবে গত নভেম্বরে বন্ধ হয়ে যায় ইকবালের কারখানা।
ইকবাল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০১৩ সালের দিকে চায়না কাঁচামালের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়ার পর থেকে বিদেশি রেডিমেড জুতার বাজার সয়লাবে হয়ে যাওয়ায় ব্যবসা মন্দা যাচ্ছিল এবং করোনার কিছুদিন আগে আমার কারখানায় আগুন লাগলে আরও ক্ষতিতে পড়ে যাই।
'তারপরও ব্যাংক থেকে ১০ লাখ এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে আরও ২০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে পুনরায় ব্যবসা চালু করি। কিন্তু গত দুই বছরে করোনার প্রভাবে আর ক্ষতি পোষাতে না পেরে গত নভেম্বরে কারখানা পুরোপুরি বন্ধ করতে বাধ্য হই।'
ইকবাল আরও জানান, আগে তারা জুতার কাঁচামাল কিছু বাকিতে, কিছু নগদে কিনতেন। বিভিন্ন শোরুম-মার্কেটেও বিক্রিও করতেন বাকি-নগদ মিলেই। কিন্তু 'করোনার পর কোনো মহাজন আর কাচাঁমাল বাকি দেয় না এবং আমরা অনেক দোকানদারদের থেকে বাকি টাকা তুলতে পারিনি। অনেকে এসব ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে, ঢাকার বাইরের অনেক পাইকারি ক্রেতা, যাদের কাছে টাকা পেতাম, তাদের অনেকেই টাকা না দিয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। এখন বাজারে আমার প্রায় ৪০ লাখ টাকার ঋণ।'
করোনার ধাক্কায় ইকবালের মতো একই পরিণতি হয়েছে পুরান ঢাকার শ'খানেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি জুতা উৎপাদকের।
ঢাকা ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির তথ্যানুসারে, পুরান ঢাকায় কম করে হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি মিলে প্রায় ৫ হাজার জুতার কারখানা ছিল। করোনার প্রভবে বর্তমানে অন্তত ২ হাজার ৫০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়া কারখানার ১০ শতাংশও এখন পর্যন্ত চালু হতে পারেনি।
ক্ষতিগ্রস্ত আরেক কারখানার মালিক মোহাম্মদ কাজল। তারও ১২ জন কারিগর নিয়ে সিদ্দিক বাজারে ছোট্ট একটি কারখানা ছিল। করোনার আর ক্ষতি পোষাতে না পেরে ২০২০ সালে শেষের দিকে কারখানা বন্ধ করে একবারে গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে চলে যান।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'আমি যাদের কাছে বিক্রি করতাম, তাদের ঢাকার বাইরের একটা বড় অংশ করোনায় ক্ষতি পোষাতে না পেরে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছে। যাদের কাছে আমি ৭ লাখ টাকা বাকি পাই, সেই টাকা আর পাওয়া সম্ভব না। বর্তমানে আমার কাছে জুতার কাঁচামাল বাকি দেয়া মহাজনরাও ১০ লাখ টাকা পাবে। প্রতিনিয়তই টাকার জন্য ফোন দিচ্ছে তারা, কিন্ত কোনো উপায় দেখছি এ টাকা শোধ করার। বর্তমানে আমি কিশোরগঞ্জে একটি জুতার কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি কোনোমতে সংসার চালানোর জন্য।'
রাজধানীর পুরান ঢাকার এই পাদুকা ক্লাস্টারটি প্রায় ২-৩ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের উৎস ছিল। বর্তমানে তাদের অর্ধেকই চাকরি হারিয়ে অন্য পেশায় চলে গেছে।
তাদের একজন কারিগর আব্দুর রহমান। ১০ বছর ধরে পুরান ঢাকায় জুতার কারখানায় কাজ করছিলেন তিনি। করোনা মহামারির প্রকোপে দেওয়া প্রথম লকডাউনেই তিনি গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ চলে যান।
আবদুর রহমান টিবিএসকে বলেন, এখন তিনি গ্রামে কৃষি শ্রমিক হিসেব কাজ করছেন।
জুতা কারিগরদের উত্থান
জানা যায়, পুরান ঢাকায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দক্ষিণ মৈশুন্দিতে জুতা বানানোর কাজ শুরু করেছিল বিহারিরা।
তাদের কাছ থেকে এ কাজ দেশীয় কারিগররা শেখার পর বংশাল, সিদ্দিক বাজার, আলুবাজার, মালিটোলা লেন, সুরিটোলা লেন, লুত্ফর রহমান লেন, আব্দুল হালিম লেন, ওসমানগণি লেন,টিকাটলী, আগা সাদেক রোড প্রভৃতি এলাকায় জুতার ব্যবসা গড়ে ওঠে।
১৯৮০-র দশকে এ শিল্প বিস্তৃত হয়। তবে বাংলাদেশ স্বাধীনের পরে বিহারীরা এদেশ ছেড়ে চলে গেলে বাঙালি শ্রমিকরা এসব কারখানা চালু রাখে এবং নিজেরাই কারখানার মালিক হয়।
এ ক্লাস্টারের কাঁচামালের শতকরা ৫-১০ ভাগ দেশীয় চামড়া এবং বাকি সব আমদানীকৃত দ্রব্য, যেমন—রেক্সিন, রাবার, পেস্টিং, বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল, পিইউ অ্যাডহেসিভ, হিল, ইনসোল বোর্ড, লেটেক্স, সলুউশন/আঠা, সুতা, সোল, স্টিকার, কালার ইত্যাদি। এসব জিনিস বেশিরভাগই চীন থেকে আমদানি হয়।
আর মেশিন হিসেবে এসব কারখানায় ব্যবহৃত হয় সেলাই মেশিন, বব মেশিন, ডাইস মেশিন, হান্টার, হ্যামার, পাওয়ার নাইফ মেশিন, স্কেল, আয়না, পেন্সিল ইত্যাদি।
এখানকার চামড়া ও রেক্সিন হ্যান্ডমেইড পাদুকা বিদেশি পণ্যের থেকে গুণে-মানে ভালো বলে দাবি মালিক-কারিগরদের।
এখানকার কারখানা মালিকদের প্রায় সবাই কারিগর-শ্রমিক থেকে মালিক হয়েছেন। তারা নিজেরাই নতুন শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। এভাবেই প্রতিটি কারখানার শ্রমিকরা দক্ষ কারিগর হয়ে গড়ে ওঠে। বর্তমানে এখনকার মালিক-শ্রমিকের প্রায় ৭০ শতাংশই কিশোরগঞ্জের ভৈরব ও নরসিংদী থেকে আসা।
এখনকার উৎপাদিত পণ্যের একটি বড় অংশ দেশের স্বনামধন্য কোম্পানী—যেমন বাটা, এপেক্স, বে, জেনিস—এবং রাজধানীসহ সারা দেশের বড় বড় পাদুকা বিপণির অর্ডারের ভিত্তিতে তৈরি করে থাকে।
কাঁচামালের চড়া মূল্য
শিল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুসারে, মহামারিকালে চীন থেকে আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
মোহাম্মদ বাবু, পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারে ১২ বছর ধরে জুতার সোল, হিল ইত্যাদি কাঁচামাল বিক্রি করেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, করোনার আগে ১ কেজি কেমিক্যালের দাম ছিল ৯৫-১০০ টাকা। কিন্তু এখন এক কেজি কেমিক্যালের দাম পড়ে ২০০-২৩০ টাকা।
বাংলাদেশ রেক্সিন অ্যান্ড সু-মেটারিয়াল মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ টিবিএসকে বলেন, করোনায় সবার বিক্রিই প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তাছাড়া কারখানার মালিকদের কাছে বকেয়া টাকা আটকে পড়ায় বেশিরভাগ ব্যবসায়ীই বিপাকে রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, 'একসময় এক কন্টিনারে ট্যাক্স দিতাম ৩ লাখ টাকা (২০০৩ সালের দিকে), বর্তমানে ৪০ লাখ টাকা ট্যাক্স দিতে হয়। দিনদিন কাঁচামালের শুল্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে (২০১৩ সালের আগ পযন্ত) চায়না কাঁচামালে ৩০-৪০% শুল্ক দিতে হতো। বর্তমানে চায়না থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল আমদানিতে সর্বোচ্চ ৯২% পর্যন্ত ট্যাক্স দিতে হয়। অথচ চায়না রেডিমেড জুতায় শুল্ক দিতে হয় মাত্র ৪২ শতাংশ।'
অন্যদিকে ভারতের ব্যবসায়ীরা একই পণ্য মাত্র ৪৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে চীন থেকে আমদানি করে বলে জানান তিনি।
অন্তত দেশের বাজার স্থিতিশীল ও দেশীয় উদ্যোক্তাদের টিকিয়ে রাখতে বিদেশি কাঁচামালে ট্যাক্স কমানো এবং বিদেশি জুতায় শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন হারুন-অর-রশিদ।
সরকারি সহায়তার দাবি
ঢাকা ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বাপ্পি সরকার বলেন, 'ঈদ-উল-ফিতরের আগে-পরের তিন মাস মূলত আমাদের ৫০% জুতা বিক্রি হয়ে থাকে। কিন্ত করোনার প্রভাবে বিগত বছরে ৪টি ঈদে প্রত্যাশা অনুযায়ী বিক্রি না হওয়ায় আমরা একদম ধসে গেছি। করোনায় সরকারি কোনো প্রণোদনাও পাইনি।'
সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সাহায্য করার আবেদন জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'চায়না ও ভারতের মেশিনের রেডিমেইড জুতা স্বল্প শুল্ক ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমাদের দেশিয় হ্যান্ডমেইড পাদুকা শিল্পকে ধসিয়ে দিচ্ছে। আমরা সরকারের কাছে অবিলম্বে আর্থিক সহযোগিতা চাই, কারিগরি প্রশিক্ষণ, সহজ শর্তে ও স্বল্পসুদে ব্যাংক লোন, আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন ও দেশীয় পাদুকা শিল্প রক্ষার স্বার্থে বিদেশি জুতার ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দেয়ার আবেদন জানাই।'
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে এমএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা প্রাথমিকভাবে পুরান ঢাকার পাদুকা শিল্পটিকে অ্যাসেসমেন্ট করব। তারপর তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি দেবে সরকারিভাবে।
'এছাড়াও আগামীতে যদি প্রণোদনার অর্থ প্রদানের সুযোগ পাই, তাহলে অব্যশই পুরান ঢাকার পাদুকা শিল্পটি অগ্রাধিকার পাবে।'