করোনার প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়ায় এগিয়ে সংগঠিত গোষ্ঠী ও প্রভাবশালীরা
প্রণোদনার ঋণ বিতরণে খাতওয়ারী নিড অ্যাসেসমেন্ট না থাকায় অধিক ক্ষতিগ্রস্ত ও তুলনামূলক ছোট ব্যবসায়ীদের তুলনায় গার্মেন্টস সেক্টরসহ সংগঠিত গোষ্ঠী ও প্রভাবশালীরা করোনার প্রণোদনা প্যাকেজ পাওয়ায় এগিয়ে আছে।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাবে রপ্তানিমুখী খাতগুলো সংগঠিত হওয়ায় অ-রপ্তানিখাতগুলোর তুলনায় তারা বেশি সুবিধা পেয়েছে। অন্যদিকে, অনানুষ্ঠানিক খাতের যাদের প্রণোদনা সুবিধা সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, তাদের অনেকের কাছেই প্রণোদনা পৌঁছায়নি। তারা কোনদিন এ সুবিধা পাবে কিনা, সেটিও জানা সম্ভব হবে না। এমনকি সামাজিক সুরক্ষাখাতে যথেষ্ট অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি।
'কোভিড-১৯ প্রণোদনা প্যাকেজ: প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা' শীর্ষক আলোচনা সভায় গবেষণা সংস্থা র্যাপিডের এক প্রেজেন্টেশনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
শনিবার এশিয়া ফাউন্ডেশন, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও র্যাপিড যৌথভাবে অনলাইনে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতায় ঘাটতি থাকার কথা স্বীকার করে বলেন, 'কোভিড পরিস্থিতিতে নিড অ্যাসেসমেন্ট করতে বাড়তি সময় ব্যয় করার চেয়ে দ্রুত প্রণোদনার ব্যবস্থা করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সরকার সেটিই করেছে। তবে প্রণোদনার সুবিধা কারা পাবে, তা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে প্রথমদিকে কিছু ভুলভ্রান্তি ছিল, যা পরে ঠিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
'আমি নিজেও দেখেছি, কিছু ইনক্লুশন, এক্সক্লুশন এরর ছিল। কিন্তু কাদের প্রণোদনা পাওয়া উচিত, সেই হিসাব-নিকাশ করে দিতে গেলে সরকারের অনেক সময় লাগতো। আগুন লাগলে কোন চিন্তাভাবনা ছাড়াই পানি ঢালতে হয়। সরকার এক্ষেত্রে তাই করেছে', যোগ করেন তিনি।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন র্যাপিডের চেয়ারম্যান ড. এম এ রাজ্জাক। সংগঠিত গ্রুপ ও প্রভাবশালী বলতে তিনি কাদের বুঝিয়েছেন, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'সংগঠিত গ্রুপ তারা, যাদের সরকারের বিভিন্ন স্তরে বা পলিসি মেকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার সুযোগ আছে। যেকোনো পলিসির ক্ষেত্রে এটা হতে পারে। তারা লবিং করতে পারে।'
এম এ রাজ্জাক বলেন, 'কাদেরকে প্রণোদনা দেওয়া হলে দেশের দারিদ্র দূরীকরণ ও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে বেশি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে সে ধরণের কোন অ্যাসেসমেন্ট সরকার করেনি। এমনকি ২০২০ সালে প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন শুরুর পর এখন পর্যন্ত তার ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করেনি অর্থ মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ ব্যাংক।'
তিনি বলেন, করোনার প্রথম প্যাকেজ দেওয়া হয় রপ্তানিমুখী খাতগুলোর জন্য, এসএমইখাতের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হয় আরও পরে। তবে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার প্যাকেজের আওতার বাইরে রাখা হয় রপ্তানিমুখী খাতের চুক্তিভিত্তিক ও শিক্ষানবিশ শ্রমিকদের।
'প্রণোদনা সহায়তা কর্মসূচির মিশ্র সাফল্য রয়েছে। প্রণোদনা সহায়তা পাওয়ায় গার্মেন্টস সেক্টর দ্রুত বাউন্স ব্যাক করেছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে শক্তিশালী স্থিতিশীলতার পাশাপাশি অর্থনীতি ও জনগণের মধ্যে স্থিতিস্থাপকতা এনেছে। ইনফরমাল সেক্টরের অনেকেই প্রণোদনার বাইরে রয়ে গেছে, আনইমপ্লয়মেন্ট প্রোটেকশন মেজার্স নেই এবং ইনফরমাল অ্যানালাইসিস ও পলিসি ইনপুটসের অভাব রয়েছে', জানান তিনি।
তিনি বলেন, 'কোভিড মোকাবেলায় বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। কিছু নীতি সহায়তা সময়োপযোগী ছিল। তবে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশে এভাবে অনুমাননির্ভর ও এডহক নীতি প্রণয়নের চেয়ে প্রমাণনির্ভর নীতি সক্ষমতার দিকে যেতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার দুর্বলতা স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে।'
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগী চিহ্নিতকরণে আমাদের দীর্ঘদিনের দুর্বলতা রয়েছে। কোভিডে ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা দেওয়ার তালিকা নিয়ে সে দুর্বলতা আরও ফুটে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত ৩৫ লাখ পরিবারকে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। সঠিক তালিকা না করতে পারার কারণে ১৫ লাখ দরিদ্র সহায়তা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ দিয়ে কৃষি ভর্তুকির ৯৫০০ কোটি টাকাও দেখানো হয়েছে, যা এখানে আসা উচিত নয়। তবে সরকারের খাদ্য সহায়তা সফল হয়েছে।
সরকারের সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকায় যাদের সহায়তা পাওয়া সবচেয়ে জরুরি, তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
ইউএনডিপির কান্ট্রি ইকোনমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, 'কোভিডের কারণে একজন ব্যবসায়ীর হয়তো ৩০% ক্ষতি হয়েছে, আরেকজনের ৭০%। দু'জনের মধ্যে ৭০% ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পাওয়া জরুরি হলেও ব্যাংক ৩০% ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ভালো গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করছে। এছাড়া, প্রণোদনা বিতরণে এলাকাভিত্তিক নিড অ্যাসেসমেন্ট করাও জরুরি, যা এসডিজি বাস্তবায়নেও ভূমিকা রাখবে।'
অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, 'সামাজিক নিরাপত্তায় ডিস্ট্রিবিউশনে কোন সমস্যা নেই, সমস্যা রয়েছে টার্গেটিংয়ে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে। সকলের জন্য পেনশন ও কর্মস্থলে দুর্ঘটনার জন্য বীমা ব্যবস্থা চালু হচ্ছে।'
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত প্রণোদনা প্যাকেজের ৬০% বাস্তবায়ন হয়েছে, উপকৃত হয়েছে ৬.৭৯ কোটি মানুষ।
ইস্টার্ন ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, 'আমরা প্রথমে এক বছর মেয়াদে ঋণ দিলাম। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় তা আরও ১-২ বছরের জন্য বর্ধিত করতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকের উপর যে প্রভাব পড়বে, তা আগামী এক-দেড় বছরের ব্যালেন্সশিটে ফুটে উঠবে।'
অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা মনোয়ার হোসেন বলেন, 'ব্যাংকগুলো প্রণোদনা বিতরণে তাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করছে। কিন্তু যেখানে যার প্রয়োজনীয়তা বেশি, সে তা পাচ্ছে কি-না, তা নিশ্চিত হচ্ছে না। কারণ, ব্যাংকগুলো কম ঝুঁকি বিবেচনা করেই গ্রাহক নির্বাচন করছে।'
ইআরএফ সভাপতি শারমিন রিনভীর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সেরাজ, র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক এম আবু ইউসুফ প্রমুখ।