রেমিট্যান্সে চাঙা হচ্ছে আবাসন খাত
মুন্সিগঞ্জের জিয়াউল আহসান, সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের পাইকারি বাজারে সামুদ্রিক মাছ বিক্রির ব্যবসা করছেন প্রায় ২০ বছর ধরে। গত দুই দশকে মাছ ব্যবসা করে তিনি ভালো উপার্জন করেন। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুর দিকে করোনা মহামারি শুরু হলে তার ব্যবসার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।
জিয়াউল বলেন, 'মাছের সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছিল না, আবার বিক্রয় কমে যায় প্রায় ৮০ শতাংশ। ফলে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যায়। ২০২০ সালের জুনের দিকে সাময়িকভবে ব্যবসা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিই।'
তিনি বলেন, 'এর আগের বছরগুলোতে প্রায় প্রতিবছরই এলাকায় চাষাবাদের জন্য জমি কিনেছি। কিন্তু কোভিডের সময় আমার ব্যবসা বন্ধ হলে চিন্তা করি একটি লাভজনক খাতে টাকা বিনিয়োগ করার।'
২০২১ সালের শুরুর দিকে কেরানীগঞ্জের অ্যাপোলো লেক সিটিতে একসাথে তিনটি প্লট কিনেন তিনি। যার দাম প্রায় ৩ কোটি টাকা। এছাড়াও রাজধানীর পূর্ব মালিবাগে তামান্না প্রপার্টিজের 'শান্তি ভিলা' অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে ৮০ লাখ টাকায় ১ হাজার ১০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন একই সময়ে।
অ্যাপোলো লেক সিটির বিপণন কর্মকর্তা এরশাদুল আলম বলেন, ২০২০-২১ সালে তার কোম্পানি ২৫০টি প্লট বিক্রি করেছে। এসব প্লটের ৪০ শতাংশই কিনেছেন প্রবাসীরা।
তামান্না প্রপার্টিজের একজন কর্মকর্তা বলেন, একই সময়ে মালিবাগের 'শান্তি ভিলা' প্রকল্পসহ চলমান চারটি প্রকল্পে তাদের প্রায় ৫০টি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে, যার মধ্যে ১৯টি কিনেছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন বলেছে, ২০২০-২০২১ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। কোভিডকালীন এই রেমিট্যান্স দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরিমাণের রেমিট্যান্স বলে জানিয়েছেন ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা।
বিনিয়োগের পরিমাণ
আবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে আসা এই বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্সের প্রায় ২০ শতাংশ বিনিয়োগ হয়েছে আবাসন খাতে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অভ প্ল্যানারস-এর (বিআইপি) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুসারে, প্রায় ২০ শতাংশ বিনিয়োগ, যা প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, রেমিট্যান্স রিয়েল এস্টেট খাতের সর্বোচ্চ পরিমাণ বিনিয়োগ। ২০১৯-২০ ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২২ হাজার কোটি ও ২০ হাজার কোটি টাকা।
বিআইপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, এনবিআর, বিভিন্ন আবাসন প্রতিষ্ঠান ও এ-সংক্রান্ত গবেষণা থেকেই এই তথ্য সংগ্রহ করেছে বিআইপি।
তিনি আরও বলেন, 'রেমিট্যান্সের টাকা কোন কোন খাতে বিনিয়োগ হয়েছে, তার সঠিক কোনো ডাটা কারো কাছেই নেই।'
রিহ্যাব বলছে বিনিয়োগের প্রকৃত অঙ্ক আরও বেশি
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েহন অভ বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিআইপির সমীক্ষা ঠিকই আছে।
'তবে আমার ধারণা এর চেয়ে বেশ পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে রেমিট্যান্সের অর্থ,' বলেন তিনি।
রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, '২০১৫ সাল থেকে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ হয় আবাসন খাতে। কিন্তু গত বছর এই বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেয়ে দেড় লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে—যা আবাসন খাতকে বেশ চাঙা করেছে।'
হঠাৎ করে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে প্রবাসীদের বিনিয়োগকেই মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, এই বিনিয়োগের টাকার মধ্যে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন প্রবাসীরা। ফ্ল্যাট ও জমি কেনার জন্য বিনিয়োগ হয়েছে বাকি অর্থ।
জেমস ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ও রিহ্যাবের সাবেক পরিচালক শাহাদাত হোসেন বলেন, তাদের বিভিন্ন প্রকল্পে গত বছর ও এর আগের বছর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন প্রবাসীরা—যা আগের বছরগুলোর তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।
কেন আবাসন খাতে এত রেমিট্যান্স বিনিয়োগ
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অভ বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ. মনসুর টিবিএসকে বলেন, 'কোভিডের মধ্যে আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগটা সবচেয়ে বেশি ছিল। কারণ আবাসন খাতের বাইরে বিনিয়োগ করতে হলে সেটি করতে হবে বিভিন্ন ব্যবসায়। কিন্তু কোভিডের মধ্যে প্রায় সব রকম ব্যবসার অবস্থা খারাপ ছিল।'
তিনি বলেন, 'এছাড়াও আবাসন খাতে বিনিয়োগ অনেকটাই নিরাপদ। প্রবাসীরা সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠান যাচাই করে জমি বা অ্যাপার্টমেন্ট কিনলে সেখানে প্রতিনিয়ত তাদের ইনকাম বৃদ্ধি পায়। দেখা যায় এখন যে টাকায় ফ্ল্যাট বা জমি কিনেছে, ১০ বছর পর সেটি বিক্রয় করলে এর দ্বিগুণ বা তার চেয়ে একটু কম দামে বিক্রয় সম্ভব।'
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আবাসন খাতে বিনিয়োগ পদ্ধতি একেবারেই সহজ।
'প্রবাসীরা বেশিরভাগই রেডি ফ্ল্যাট বা রেডি প্লট কিনেছেন। কেনার চুক্তি করার পর শুধূ নিবন্ধন করাটাই কাজ। এই খাতে বিনিয়োগে ঝামেলা কম। আর তাই প্রবাসীরা এই খাতেই বিনিয়োগ করেছে সবচেয়ে বেশি,' বলেন তিনি।
কোন এলাকায় কী পরিমাণ বিনিয়োগ
রিহ্যাব সূত্র জানিয়েছে, দেশের আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় ৬০ শতাংশই হলো রাজধানী ও এর পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর ও সাভার এলাকায়। সারা দেশ রয়েছে বাকি ৪০ শতাংশ। আর বিয়োগের পরিমাণও প্রায় একই।
রিহ্যাব পরিচালক নাইমুল হাসান বলেন, রাজধানীর পর চট্টগ্রাম ও সিলেটে সবচেয়ে বেশি ইনভেস্ট করেছেন প্রবাসীরা।
সিলেটের আবাসন ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, বৃহত্তর সিলেট এলাকায় আবাসন খাতে প্রতি বছর নতুন বিনিয়োগের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রবাসীদের টাকা।
নিবন্ধন অধিদপ্তরের তথ্য তুলে ধরে নাইমুল বলেন, গত বছর প্রায় ৮ হাজার ২৩ কোটি টাকার পুরাতন ফ্লট বিক্রি হয়েছে সারা দেশে। এই পুরোনো ফ্ল্যাটগুলোর অর্ধেকের বেশ কিনেছেন প্রবাসীরা।
'কালো টাকা' সাদা করা হয়েছে আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিম বলেন, 'গত অর্থবছরে যে পরিমাণ কালো টাকা সাদা করা হয়েছে, তার বেশিরভাগ বিনিয়োগ হয়েছে আবাসন খাতে।'
একই অর্থবছরে রেমিট্যান্স থেকে সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমান রাজস্ব পেয়েছে বলে জানান তিনি। প্রবাসীদের আয় আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে যেসব জমি ও ফ্ল্যাট ফ্ল্যাট ক্রয়ের নিবন্ধন করা হয়েছে, সেখান থেকেও বড় অঙ্কেকের রাজস্ব পেয়েছে সরকার।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী টিবিএসকে বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে দেশের আবাসন খাতে বিনিয়োগ এখন বেশ নিরাপদ।
'বিশেষ করে রাজধানী এলাকায় রাজউক এই আবাসন খাতকে জনবান্ধব ও নিরাপদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়াও রাজধানী ও পাশ্ববর্তী এলাকায় নাগরিক সুবিধা বেশি থাকায় প্রবাসীরা এসব এলাকায় আবাসন খাতে বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছেন,' যোগ করেন তিনি।