নোয়াখালী বিসিক শিল্পনগরী: দেড় দশকেও গড়ে ওঠেনি শিল্প সহায়ক পরিবেশ
নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, উৎপাদন বৃদ্ধি ও বেকারত্ব দূরীকরণের উদ্দেশ্যে ২০০৩ সালে ১৫ একর জমিতে নোয়াখালীর সোনাপুরে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ফ্লাট নির্মাণ শেষে ২০০৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয় শিল্পনগরীটি। কিন্তু গত দেড় দশকেও শিল্প সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি এ বিসিক শিল্পনগরীতে। ফলে জেলার এ বিসিক এখন শুধু নামেই শিল্পনগরী। সারাদিন জনশূন্য থাকা এ শিল্প এলাকাটি বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন মাদকসেবীদের দখলে থাকে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি বিসিকে বেড়েছে চোরের উৎপাত; গত ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির শুরুতে তিনটি প্রতিষ্ঠানে ঘটেছে একাধিক চুরির ঘটনা। বিসিকের নানান সমস্যা, করোনাকালীন ব্যবসার মন্দার মধ্যে অব্যাহত চুরির ঘটনায় শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন উদ্যোক্তারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরিকল্পিত শিল্পায়ন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বেকারত্ব দূরীকরণে বিসিকটি ভূমিকা রাখবে এমনটাই প্রত্যাশা বিশিষ্টজনদের।
বিসিক শিল্পনগরী ঘুরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দিন যত যাচ্ছে বিসিকটি নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে প্রতিনিয়ত বন্ধ হচ্ছে কারখানা/প্রতিষ্ঠান। গ্যাস, পানি সংকট, চুরি-ছিনতাই ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে বরাদ্দকৃত ফ্লাটগুলো বছরের পর বছর খালি পড়ে আছে। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি কারখানা সচল আছে। তাও আবার এসব কারখানার উৎপাদন নিয়মিত না। বিভিন্ন সংকটের কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। এ বিসিকে অবকাঠামো গড়ে উঠলেও বেশিরভাগ ফ্লাটই পরিত্যক্ত, খালি পড়ে আছে, ড্রেনেজ ব্যবস্থা নাজুক, বর্ষাকালে পানি জমে থাকে, যেখানে-সেখানে ময়লা আর্বজনা পড়ে থাকে, ভিতরের প্রতিটি সড়ক ভাঙাচোরা। কিছু ফ্লাটে শিল্পের নামে শুধু স্থাপনা তৈরি হলেও নেই কোন উৎপাদন। কিছু প্রতিষ্ঠানে ঝুলছে তালা, খরচ সামাল দিতে না পেরে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করেছেন তারা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক তদারকি না থাকা এবং উদাসীনতায় এখানে গড়ে উঠছে না ক্ষুদ্র শিল্প, এমনটা অভিযোগ তাদের।
জানা গেছে, শুরুতে বিসিকের ১০৮টি ফ্লাটের মধ্যে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য ৬২টি ফ্লাট বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু বরাদ্দ পাওয়ার পরও সবগুলো ফ্লাটে গড়ে উঠেনি প্রতিষ্ঠান। কেমিক্যাল, রাবার, ওষুধ, ওয়ার্কশপ, আটা, ধান মিল, প্লাস্টিক, বোতামসহ প্রায় ৪০টির মত ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে এখানে। কিন্তু কিছু ব্যক্তি নামমাত্র ফ্লাট বরাদ্দ নিয়ে তাতে কিছু খুঁটি, কেউ বা একটু দেয়াল আবার কেউ কেউ টিনশেডের ঘর তুলে দখলে রাখেন।
পড়ে থাকা ফ্লাটগুলো বরাদ্দ বাতিলের জন্য ভূমি বরাদ্দ কমিটিকে আবেদন দেওয়ার পর বরাদ্দ বাতিল করা হয়। যা নিয়ে পরে আগের বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তিগণ নিম্ন আদালতে মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে মামলাজনিত কারণে অর্ধনির্মিত অবস্থায় রয়েছে ১০টি ফ্লাট। ৮টি ফ্লাটের মামলা ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্ধনির্মিত ফ্লাটগুলোর মামলা জটিলতা কাটিয়ে তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে উদ্ধার করে ভূমি বরাদ্দ কমিটির মাধ্যমে নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
রাবার কারখানায় কর্মরত এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়কটিতে কোন বৈদ্যুতিক বাতি নেই। ফলে সন্ধ্যার পর থেকে প্রতিষ্ঠানের ভিতরের লাইট ছাড়া বাকি অংশটুকু অন্ধকার হয়ে থাকে। গত আড়াই মাসে তিনবার চুরির ঘটনা ঘটেছে এ প্রতিষ্ঠানে। চোরের দল কারখানা থেকে মূল্যবান তিনটি মেশিন, চারটি পানির মটর, একটি ড্রিল মেশিন ও অনেকগুলো লোহার প্লেটসহ মূল্যবান মালামাল নিয়ে গেছে। বিদ্যুতের মূল খুঁটি থেকে কারখানায় আসা বিদ্যুতের ক্যাবল কেটে নিয়ে গেছে কয়েকবার। একাধিকবার প্রতিষ্ঠান পাহারা দেওয়ার জন্য লোক নিলেও তারা স্থানীয় কিছু বখাটে ও রাতে চোরদের ভয়ে কয়েকদিন চাকরি করে নিজের নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে ছেড়ে চলে যায়। বিসিকে কোন নিরাপত্তা না থাকায় প্রতিনিয়ত আমাদের সমস্যা বাড়ছে। কর্তৃপক্ষ যদি বিসিক এলাকায় পুলিশের টহল জোরদার করে তাহলে হয়তো এ সমস্যার উত্তরণ হবে বলেও মনে করেন তিনি।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, চুরির বিষয়ে বিসিক কার্যালয়ে একাধিকবার জানানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের চুরি রোধে নিরাপত্তার বিষয়ে জানালে বিসিক কর্তৃপক্ষ জানান নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের দেখার বিষয় না। অথচ প্রতিমাসে চলমান প্রতিটি কারখানা থেকে নিরাপত্তা বাবদ ফি নিচ্ছে বিসিক অফিস। এছাড়াও স্থানীয় কিছু বখাটের নিরাপদ আড্ডাস্থল হয়ে উঠেছে এ শিল্পনগরী। তাদের উৎপাত ও চাঁদার ভয়ে উদ্যোক্তারা এখানে কারখানা করে টিকতে পারেন না।
উদ্যোক্তারা বলছেন, গ্যাস, পানির সংকট ও কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণেই পূর্ণতা পায়নি এ শিল্পনগরী। তার উপর প্রতিনিয়ত হচ্ছে চুরি-ছিনতাই, রয়েছে নিরাপত্তাহীনতাও। বর্তমানে বিসিকে উৎপাদনযোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫টির মতো। এর বাইরে কিছু গ্রিল ওয়ার্কশপ ও চালের মিল চলমান রয়েছে। গ্যাসসহ অন্যান্য সংকট দূর করে উদ্যোক্তা তৈরিতে উদ্যোগ নিলে এ শিল্পনগরী দেশের অর্থনীতিতে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে করেন তারা।
হাজী প্লাস্টিকের পরিচালক মো. শহিদুল আলম জানান, বিসিকে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে গ্যাসের। পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাস পাওয়া গেলে এখানে বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। যত দ্রুত গ্যাস পাওয়া যাবে তত দ্রুত বিসিকের উন্নতি হবে। আমাদের এখানে কোন কৃষি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই। আমাদের জেলার দক্ষিণাঞ্চলে যে পরিমাণ সবজি উৎপাদন হয় তার জন্য এখানে একটি বড় ধরনের কোল্ড স্টোর করা দরকার। কোল্ড স্টোর প্রতিষ্ঠা হলে শিল্পনগরীটি কৃষি পণ্য সংরক্ষণে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
নোয়াখালী শিল্পনগরীর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) মাহাবুব উল্যাহ গ্যাসসহ কিছু সংকটের কথা স্বীকার করে দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বলেন, বর্তমানে গ্যাসের যে সংযোগটি রয়েছে তা বাসাবাড়িতে ব্যবহারের সংযোগ। সংযোগটির ৬ইি পাইপ দিয়ে গ্যাসের চাপ (প্রেশার) বাড়ানোর জন্য বাখরাবাদকে লিখিতভাবে দেওয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্যাসের সমস্যাটি সমাধান হবে।
তিনি আরও বলেন, শুধুমাত্র সংকটের কারণে বিসিক পূর্ণতা পায়নি কথাটি ঠিক না। উদ্যোক্তারা ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়েও নির্দিষ্ট সময়ে চালু না করার কারণে এখানে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্ল্যাটের মালিকগণের আদালতে মামলা চলমান থাকার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেনি। মামলাগুলোর মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৮টি মামলার রায় আমাদের (বিসিক) পক্ষে এসেছে। নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্ধারকৃত ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হবে।