পেঁয়াজের নতুন জাত স্বনির্ভরতার পথ দেখাচ্ছে
২০০৮ সালে যখন বারি-৫ পেঁয়াজ-৫ তখন এটিকে বাংলাদেশের পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলা হয়। কিন্তু, তারপর ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও উচ্চ ফলনশীল জাতটির আলো ছড়ায়নি দেশের কৃষিক্ষেতে। তবে গত কয়েক বছরে দেশে রান্নাবান্নায় অপরিহার্য পেঁয়াজের তীব্র সংকট দেখা দিলে, তখন এই জাতটি আবার সামনে আসে।
এ বাস্তবতায় পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে এবং ক্রমবর্ধমান স্থানীয় চাহিদা মেটাতে, সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলিতে কৃষকদের মধ্যে বারি-৫ জাতটিকে জনপ্রিয় করতে পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটও আরো উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।
কৃষি গবেষকরা বলছেন, বারি-৫ একটি গ্রীষ্মকালীন জাত হলেও- এটি সারা বছরই চাষ করা যায়। উৎপাদনশীলতা হেক্টর প্রতি ৩০ টন- যা বর্তমানে পাওয়া ৩-৪টি স্থানীয় জাতের তুলনায় অন্তত তিনগুণ বেশি।
ইতোমধ্যেই মেহেরপুর, পাবনা, ঈশ্বরদী, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন এলাকায় ২৫ হেক্টর জমিতে এক হাজারের বেশি কৃষক উচ্চ ফলনশীল জাতের পেঁয়াজটি চাষ করেছেন।
মেহেরপুর সদর উপজেলার কালীগাংনী গ্রামের পেঁয়াজ চাষি ফারুক হোসেন বলেন, "গত বছর আমি বারি-৫ পেঁয়াজ চাষ করে বিঘাপ্রতি ১০০ মণের বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করেছি। অন্য কৃষকরাও এটি চাষে আগ্রহী হয়েছেন। আমার সাফল্য দেখে এরপর এলাকার অন্য কৃষকরাও এই জাতটি চাষে আগ্রহী হয়েছে।"
স্বাধীনতার পর থেকেই সরকার বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে ধান উৎপাদন বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে গবেষণার অভাবেই তাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে গবেষকরা উল্লেখ করেন।
বিশ্বব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে ধানের গড় উৎপাদনশীলতা হেক্টরপ্রতি ৪.৬২ টন, যেখানে বৈশ্বিক গড় হেক্টরপ্রতি ৪.৬১ টন। তবে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদনশীলতা হেক্টরপ্রতি ৯.৭৬ টন, যা কিনা বৈশ্বিক গড় ১৯.০২ টনের অর্ধেক।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় পেঁয়াজের হেক্টরপ্রতি উৎপাদনশীলতা যথাক্রমে ১৬.৪১, ১৩.২০ এবং ১৫.৫৪ টন।
গবেষকরা এখন আশা করছেন, বারি-৫ চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারবে।
বগুড়ার মশলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নূর আলম চৌধুরী বলেন, "আমরা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনকে (বিএডিসি) বারি-৫ পেঁয়াজের বীজ দিয়েছি। বিএডিসি এখন কৃষকদের বীজ সরবরাহ করবে। এটি সম্প্রসারণে কাজ করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।"
তিনি আরও বলেন, "বীজের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য দু-তিন বছর সময় প্রয়োজন। আবার যখন কৃষকরা নিজেরাই বীজ উৎপাদন শুরু করবে- তখনই বড় পরিবর্তনটা আসবে।"
গবেষকরা বলছেন, দেশে পেঁয়াজের স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত ৩-৪টি জাত রয়েছে। যেগুলোর উৎপাদনশীলতা (হেক্টরপ্রতি) ৭-৯ টনের মধ্যে।
উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ না হওয়ায় এখনো চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে। দেশে এখন (উৎপাদনের সময়) অপচয় বাদ দিয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন ২০ লাখ টনের কাছাকাছি। সে তুলনায় চাল প্রধান খাদ্যশস্য হওয়ায় স্বাধীনতার পর থেকেই ধান উৎপাদন বৃদ্ধিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যে কারণে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের নানা গবেষণায় এখন পর্যন্ত ধানের ২০০'র বেশি উচ্চ-ফলনশীল জাত উদ্ভাবন হয়েছে। উৎপাদনও এক কোটি টন থেকে বেড়ে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ টনে পৌঁছেছে।
বারির সাবেক মহাপরিচালক মো. নাজিরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরীক্ষামূলক চাষের ক্ষেত্রে বারি-৫ জাতের পেঁয়াজের সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া গেছে হেক্টর প্রতি ৩০-৩৫ টন।"
তিনি বলেন, "আমরা হয়তো উৎপাদনের গড় হার দ্রুত পরিবর্তন করতে পারব না, কিন্তু যখন আমাদের যখন ঘাটতি হয়, ঐ সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারব। কারণ এটি সারা বছরই উৎপাদন করা যায়।"
ধান, আলু ও গমের উৎপাদনশীলতা:
২০২০ সালে 'প্রোমোটিং এগ্রি-ফুড সেক্টর ট্র্যান্সফরমেশন ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। সেখানে বাংলাদেশের গড় উৎপাদনের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনটি জানায়, চাল উৎপাদনে প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। আলু উৎপাদনের বৈশ্বিক গড়ের কাছাকাছি অবস্থান করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ জানান, "কম দামের সার, উন্নত মানের বীজ, নতুন জাতের কারণে বর্তমানে ধানের বা চালের উৎপাদনশীলতা প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত বেড়েছে। কারণ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চালের উৎপাদনেই বাড়তি গুরুত্ব দিয়েছে সরকার।"
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় (ইউএন-ফাও) বাংলাদেশের সহকারী প্রতিনিধি নূর আহামেদ খন্দকার বলেছেন, "বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ ৮০'র দশকে যখন মাত্র সাড়ে ৭ কোটি জনসংখ্যা ছিল, তখনও চালের (বার্ষিক) ঘাটতি হতো প্রায় ২০ লাখ টন। নতুন উচ্চফলনশীল জাতগুলো দেশে ধানের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েছে।"
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন জানায়, বৈশ্বিক গড়ে হেক্টরপ্রতি আলুর উৎপাদন ২০.৬৭ টন, আর বাংলাদেশের ১৯.৯৬ টন।
গড় হিসাব ছাড়া স্বতন্ত্র দেশের হিসাবে- বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসে হেক্টরপ্রতি আলুর উৎপাদন ৫০ টন। তুরস্কে যা ৪৮ টন। যুক্তরাষ্ট্র ও স্পেনে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয় ৩০ টনের বেশি। প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে যা যথাক্রমে ২২.২৮ ও ২১.৮৩ টন।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্যানুসারে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আলু উৎপাদিত হয় ৯৯ লাখ টন, যা ১০ বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ধান, আলু ও আমের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তবে বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় গম উৎপাদনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দেশে গমের উৎপাদনশীলতা হেক্টরপ্রতি ৩.০৯ টন, যা বিশ্বে প্রতিহেক্টরে ৩.৪ টন।
কৃষি দক্ষতায় শীর্ষে বাংলাদেশ:
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এডিবি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা বলছে, কৃষি খাতের দক্ষতায় বাংলাদেশ এশিয়ার ৪১টি দেশের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। জাপান, দ. কোরিয়া চীনসহ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলোও কৃষির দক্ষতায় বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে।
'রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ইমপ্রুভিং এগ্রিকালচারাল প্রোডাকশন এফিশিয়েন্সি: এ স্ট্রাটেজিক টুল ফর ইমিশন রিডাকশন' শীর্ষক এডিবির এক সাম্প্রতিক গবেষণা জানায়, এতে বলা হয় বাংলাদেশে কৃষি খাতের দক্ষতা ৯৮ শতাংশ। তবে প্রযুক্তি, সার, সেচ ও শ্রমের দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা আরও ২ শতাংশ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
তালিকায় বাংলাদেশের পেছনে থাকা মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও দ. কোরিয়ায় কৃষি খাতের দক্ষতা ৯৭ শতাংশ। ৯৬ শতাংশ দক্ষতা নিশ্চিত করে নেপাল দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় ও এশিয়ায় পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়স্থানে থাকা শ্রীলঙ্কা এশিয়ায় রয়েছে ১৩তম অবস্থানে।
কৃষিতে জমি, শ্রম, পুঁজি, সার ও জ্বালানি এই পাঁচটি উপকরণ ব্যবহারের দক্ষতা নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। জমির দক্ষতায় বাংলাদেশ শীর্ষে থাকলেও শ্রমের দক্ষতায় দক্ষিণ এশিয়ায় তলানিতে রয়েছে।
কৃষিতে পুঁজি ব্যবহারের দক্ষতায় নেপালের পরেই দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। দক্ষতার সাথে সার ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম আর জ্বালানি ব্যবহারে ষষ্ঠস্থানে রয়েছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ও কৃষি গবেষণা পরিষদের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, "দেশের মানুষের খাদ্য যোগান ছিল সরকারের প্রধান লক্ষ্য। এজন্য বিজ্ঞানীরা ধান, আলু থেকে শুরু করে কৃষি ফসলের অনেক জাত উদ্ভাবন করছেন। এটা আমাদের উৎপাদনশীলতাকে স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে এসেছে।"
"সরকার এখন চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদনশীল ফসলের উপরও কাজ করছে। সরকার বিনামূল্যে সার ও বীজ বিতরণ, নতুন জাতের প্রচার এবং কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উপর জোর দেওয়ায় উৎপাদনশীলতা বাড়বে"- যোগ করেন তিনি।
এদিকে ২০১৭ সালে পরিচালিত বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ শতাংশ বা ২ কোটি ২৭ লাখ মানুষ কৃষি খাতে কাজ করছে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬২ লাখ। দক্ষতার অভাবে গত কয়েক বছরে কৃষিতে শ্রমিকের সংখ্যা ১৫ লাখ কমেছে।