পাহাড়ে সম্ভাবনা জাগাচ্ছে কফি চাষ
বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ের বাগানগুলোতে পাকা কফি চেরি সংগ্রহে ব্যস্ত জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-থানচি সড়কে পাহাড়ের চাষিরা।
স্থানীয় এক উদ্যোক্তার মাধ্যমে ২০১৭ সালে কফি চাষের কথা প্রথম জানতে পারেন চংক্রাত ম্রো। ওই বছরই আগ্রহী হয়ে চিম্বুক পাহাড়ে আম বাগানের ফাঁকে ৩০০টি কফির চারা লাগিয়েছিলেন। এর পরের বছর লাগানো হয় আরও ৪০০টির চারা। তিন বছরের মাথায় কফির গাছে ফল ধরা শুরু করে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে চংক্রাত ম্রো বলেন, "গত বছর ভাল ফল ধরেছে। কয়েকটি ধাপের প্রক্রিয়া শেষে ৩৮ কেজি কফি বিন পেয়েছিলাম। এ বছরও ভাল ফল এসেছে। এখন পুরোদমে কফির ফল সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছি। মনে হয় এ বছর ৫০ কেজির মত কফি পাওয়া যাবে।"
''নতুন চাষ করছি হিসেবে অভিজ্ঞতার ঘাটতি ছিল। প্রথম দিকে ঢাকার একটি কোম্পানির কাছে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম। তারপর বান্দরবান হর্টিকালচার কেন্দ্রেও প্রশিক্ষণ পাই। আপাতত এই সব প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা নিয়ে কফি চাষের বাণিজ্যিক দিকে আগাচ্ছি।''
চংক্রাত ম্রোর মত চিম্বুক পাহাড়ে অনেক চাষির ব্যস্ত এখন কফি গাছের ফল সংগ্রহ নিয়ে। গেল শুক্রবার জেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-থানচি সড়কের চিম্বুক পাহাড়ে কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বাগানে বাগানে কফির ফল পাকতে শুরু করেছে। চাষিরাও ফল সংগ্রহ শুরু করেছেন। চলবে প্রায় জানুয়ারি মাস পর্যন্ত।
কৃষি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্যমতে, পাহাড়ে দুই জাতের কফি চাষ হয়ে থাকে। একটি হল অ্যারাবিকা ও অন্যটি রোবাস্তা। তবে এলাকাভেদে ফলনে ভিন্নতা দেখা দেয়। পরিচর্যার কারনেও হয়ে থাকে ভাল ও খারাপ ফলন।
ডিএই সূত্র বলছে, বান্দরবান জেলায় ভূ-প্রকৃতির কারনে অ্যারাবিকা কফি জাত চাষের জন্য উপযুক্ত। এ জাতের কফি যে কোন ফলদ বাগানে ছায়াযুক্ত আবাহাওয়ায় ভাল ফলন হয়ে থাকে। ফলে চাষের জন্য আলাদা জায়গার দরকার পড়ে না।
চিম্বুক পাহাড়ে মেনদুই পাড়ার চাষি তংসি ম্রো পাঁচ বছর আগে ২০০টি কফির চারা লাগিয়েছিলেন। এর দুই বছর পর আরও ৪০০টি চারা গাছ লাগান তিনি।
"গত বছর ৬০০টি গাছ থেকে ৩২ কেজি কফি পেয়েছিলাম। আরও দেড় হাজার মত কফির চারা লাগানোর পরিকল্পনা আছে," বলেন তিনি।
এরাপাড়ার বাসিন্দা আরেক কফি চাষি য়ংসা ম্রো চার বছর আগে প্রথম ৯০০টি কফির চারা লাগান। তার মধ্যে অর্ধেক চারা মারা যায়। এরপর আরও চারা লাগানোর পর বর্তমানে ১৩০০টি কফির গাছ রয়েছে। তবে এ বছর ৩০০টির মতো গাছে ফল ধরেছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে য়ংসং তিনি জানান, গত বছর ১৭ কেজি কফি বিক্রি করেছেন। চামড়া (খোসা) বাদ দিয়ে কেজি ২৪০ টাকা বিক্রি হয়েছে। চামড়াসহ হলে কেজি ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি হয়। তবে মান ভাল হলে কেজি ৪০০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়।
অনেকের কফির চারা লাগানো ইচ্ছা থাকলেও চারা পাওয়া যাচ্ছে না। যেগুলো পাওয়া যায় সে চারাগুলো মান ভাল নয় বলে জানান তিনি।
কফি চাষের মাধ্যমে ইতিবাচক ফল পাচ্ছেন জানিয়ে হেডম্যান পাড়ার বাসিন্দা, পেশায় শিক্ষক ও চাষি মেনয়াং ম্রো বলেন, "চিম্বুক পাহাড়ের মত আরও অনেক জায়গা কফি চাষের জন্য খুবই উপযুক্ত। চাষিরা সঠিক প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা পেলে কফি চাষের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে চিম্বুক পাহাড়ে ওয়াইজংশন এলাকায় বোতলজাতের মাধ্যমে গুঁড়ো কফি বিন বিক্রি শুরু করেছি আমি।"
এদিকে কফি চাষ নিয়ে চিম্বুক পাহাড়ে প্রথম উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা সদরে বাসিন্দা সিংঅং খুমি । দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "বান্দরবানে কয়েকটি এলাকার কয়েকজন চাষি নিয়ে প্রথম কফির চাষ শুরু করা হয় ২০১৬ সালে। চিম্বুক পাহাড়, রুমা সদর ও রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নে এই সব চাষিদের কাছে কফির গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এরপর নিজে কফির চারা তৈরি করে চাষিদের কাছে বিতরণ করা শুরু করি।"
''একেকজন চাষির কাছে জায়গার পরিমাণভেদে ২০০ থেকে শুরু করে ২০০০টি চারা পর্যন্ত বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। চারা লাগানো পর বাগান পরিচর্যা ও ফল সংগ্রহের পর কফি তৈরি প্রক্রিয়া সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তবে শুরুর দিকে অনেক চাষি আগ্রহ দেখায়নি। চারা লাগিয়েও লাভ হবে না মনে করে পরিচর্যার কিছুই করেনি এমন চাষিও রয়েছে," বলেন তিনি।
তিনি বলেন, "বর্তমানে কয়েকটি এলাকার আমার তালিকাভুক্ত আশিজন চাষি রয়েছে; যাদেরকে পাঁচ বছর আগে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করা হয়েছিল। প্রতিবছর তাদের কাছ থেকে কফি সংগ্রহ করি। গত বছর চাষিদের কাছ থেকে ৫০০ কেজির মত কফি সংগ্রহ করা হয়েছে। এ বারে ৮০০ কেজির মত পাওয়ার আশা করছি"।
জেলা হর্টিকালচার কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. সাফায়েত আহমদ সিদ্দিকী বলেন, বান্দরবান সদর, রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি চার উপজেলায় ৬৫ জন উপকারভোগী কৃষক রয়েছে। তালিকাভুক্ত এই কৃষকদের ১৫০টি করে মোট ৯৭৫০টি কফির চারা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া লামা ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় হর্টিকলালচার কেন্দ্রের আওতাভুক্ত দুটি কফির চারার নার্সারি আছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) এসএম শাহ নেওয়াজ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে কৃষকরা বাণিজ্যিক চাষের দিকে ঝুঁকছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।
''২০২০-২১ অর্থ বছরে ৬২৫ জন কৃষকের ১৪৬ হেক্টর জমিতে কফির আবাদ হয়েছে। তার মধ্যে ২০ হেক্টর জমিতে ফলন এসেছে। চারা লাগানোর ৩ বছর পরই ফলন আসে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ছয় উপজেলায় ৬৫টি বাণিজ্যিক প্রদশর্নী রয়েছে। ছোটখাট কফির প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা করা গেলে কৃষকরা নিশ্চিন্তে কফি চাষ করতে পারবে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।''