তেলের কথা ভুলে যান, গম নতুন সতর্কবার্তা দিচ্ছে
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৪ বছরের সর্বোচ্চ দামে বৈশ্বিক গমের বাজার। এর জেরে এক সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে বেড়ে গেছে ময়দা এবং নিত্যদিনের খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে ময়দার তৈরি বেকারি আইটেমগুলোর দাম।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পরপরই সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কায় দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে গত দশ দিনে প্রতি মণে (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ১২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে গমের দাম। তার জেরে বেড়ে গেছে আটা-ময়দা ও সুজির দাম।
এখন দুই কেজি আটার প্যাকেটের খুচরা মূল্য ৯০ টাকা থেকে বেড়ে বেড়ে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। স্লাইসড রুটির প্যাকেটের দাম ইতিমধ্যেই কিছু ব্র্যান্ডেড বেকারির আউটলেট ও খুচরা দোকানে অন্তত ১০ টাকা বেড়েছে।
রাস্তার পাশের চা-স্টলে বিক্রি হওয়া পাউরুটি ও বিস্কুটের দাম বাড়লে কর্মজীবী মানুষের খাবারের পেছনে খরচও বাড়বে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে ফ্রেইট খরচ আরও বেড়েছে। সেইসঙ্গে বেড়েছে গমের আমদানি মূল্যও। এ দুই খরচ সমন্বয় করতে ভোগ্যপণ্য কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানির জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভোক্তাদের ওপর সরাসরি যে প্রভাব পড়ে, গমের মূল্যবৃদ্ধির ফলে সরাসরি প্রভাব পড়ে তারচেয়ে বেশি।
ফলন ভালো হওয়ায় পর্যাপ্ত স্থানীয় সরবরাহ থাকায় বাংলাদেশের চালের চাহিদা মেটানো গেছে। কিন্তু তারপরও চালের দাম বেড়েছে—তাছাড়া সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে আরও চাল আমদানি করতে হবে।
যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। বাড়তে পারে সারের দামও। এর ফলে ভবিষ্যতে বেড়ে যাবে ধান চাষের খরচও।
গম এদেশের প্রধান খাদ্য না হলেও ফাস্ট-ফুড দোকানের সংখ্যা এবং বেকারি শিল্পের আকার বাড়ার খাদ্যশস্যটির চাহিদা বাড়ছে।
দেশে গমের বার্ষিক উৎপাদন ১০-১১ লাখ টনের মধ্যে আটকে রয়েছে। অথচ গত বছর গমের চাহিদা ছিল ৫৪ লাখ টন। মোট চাহিদার চার-পঞ্চমাংশ পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে।
বাংলাদেশের আমদানি করা মোট গমের প্রায় ৩৮ শতাংশ আসে যুদ্ধরত বৈশ্বিক রুটির বাস্কেট রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। ভারত থেকে গম আমদানি বাড়লেও এই প্রধান দুটি উৎসের অভাব পূরণ করা একপ্রকার অসম্ভবই।
তাই সরবরাহ নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সেই অনিশ্চয়তার প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে গমের মূল্যের ওপর। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রতি বুশেলে (২৭ দশমিক ২১ কেজি) খাদ্যশস্যটির দাম বেড়েছে ১২ ডলার, অর্থাৎ ৪০ শতাংশ।
বাংলাদেশ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গম আমদানিকারক। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে বার্ষিক গমের চাহিদা ৫৮ লাখ টন। এর ৬০ শতাংশ মেটানো হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানির মাধ্যমে।
চলতি বছরের ১ মার্চ পর্যন্ত গম আমদানি করা হয়েছে ৩৭ টনের বেশি। গত দুই মাসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন গম আমদানি করা হয়েছে। গত বছর দেশ দুটি থেকে গম আমদানি হয়েছিল ৩৫ লাখ টন।
চাহিদা অনুসাড়ে চলতি বছরের জন্য আরও ৩০ লাখ টন গম আমদানি করতে বলে জানা গেছে মন্ত্রণালয় সূত্রে।
কিন্তু চলমান যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের প্রধান বন্দরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সরবরাহ ও শিপিং লিঙ্ক। যার ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে শিপমেন্ট। এছাড়া রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার এবং ফ্রেইট খরচ বেড়ে যাওয়ায় রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যও বন্ধের উপক্রম।
এই পরিস্থিতে বাংলাদেশি খাদ্যশস্য আমদানিকারকরা জন্য বিকল্প সোর্সিং দেশের সন্ধান করছে।
টিকে গ্রুপের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড মার্কেটিং) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত দুই সপ্তাহ ধরে ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে পণ্য আমদানি বন্ধ। বিকল্প হিসেবে কানাডা এবং আর্জেন্টিনা থেকে গম বুকিং করছি। আর্জেন্টিনার গম গুণগত মানে রাশিয়া-ইউক্রেনের চেয়ে খারাপ হলেও দাম প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি দিয়ে বুকিং দিতে হয়েছে।'
তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে টনপ্রতি গমের দাম ছিল ৩৯০ ডলারের নিচে। এখন এই প্রতি টন গম বুকিং দিতে হচ্ছে ৪৪৬ ডলারে।
মেঘনা গ্রুপের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার মো. তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, ভারত থেকে যে গম ফ্রেইট খরচসহ প্রতি টন ৩২০ ডলার পড়ত, সেটাই এখন এলসি করলে পড়ছে ৪০০ ডলার।
তবে এই দাম প্রতিদিনই বাড়ছে। এটা সমন্বয় করতে হলে দাম বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তাসলিম বলেন, ইউক্রেন ও রাশিয়া মিলে বৈশ্বিক গমের সরবরাহের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহ করতো। যা এখন একেবারেই বন্ধ। বাকি আছে আমেরিকা, কানাডা, ভারতের মতো কয়েকটি দেশ। ফলে ওসব দেশের বাজারের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে গেছে।
অন্যদিকে চীন ইউক্রেন থেকে কর্ন আমদানি করত তাদের ফিড শিল্পের জন্য। কিন্তু এখন এটা পুরোপুরি বন্ধ। তাই চীন এখন চাচ্ছে ফিডে গমের ব্যবহার বাড়িয়ে দিতে। এজন্য দেশটি বেশি করে গম কিনে মজুদ করছে। এ কারণেও বেড়ে যাচ্ছে খাদ্যশস্যটির দাম।
মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার ৪০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে ইউক্রেনের গম ও ভুট্টা। এই সরবরাহ ব্যাহত হলে গমের অন্যান্য সম্ভাব্য উৎসের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হবে। এতে দাম আরও বাড়বে।
বসুন্ধরা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার রেদোয়ানুর রহমান বলেন, 'সবাই অন্য দেশ থেকে আমদানি করে রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু সবাই তো তা পাবে না। কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেনের যে গম সেটা তো বন্ধ। কিন্তু চাহিদা তো কমেনি।
'টাকা হয়তো সবারই থাকবে, কিন্তু গম সবাই পাবে না। দাম অনেক বেড়ে গেলে অনেকেই সেটার আমদানি কমিয়ে দেবে।'
তিনি আরও বলেন, 'এই সংকট যদি দীর্ঘমেয়াদে থাকে, সেক্ষেত্রে যারা রুটির উপর নির্ভর করত তারা আবার চালে ফিরে যেতে পারে। এজন্য আমাদের চালের উৎপাদনও স্থিতিশীল রাখতে হবে।'
সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়ে গেছে। ফলে দেশের বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গমের সংকট তৈরি হয়ে বুকিং আরও বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। কারণ বিকল্প দেশগুলোতে চাইলেও হঠাৎ করে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব নয়।
বাড়ছে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের দামও
গমের পাশাপাশি অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামও গত দুই সপ্তাহে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম রেকর্ড বেড়েছে। গত দশ দিনে খাতুনগঞ্জে মণে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে বর্তমানে পাম অয়েল বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার ৮০০ টাকায় ও সয়াবিন বিক্রি হচ্চে ৭ হাজার টাকায়।
মাত্র দশ দিনে ৮৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে প্রতি মণ চিনি বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৭২৫ টাকায়। এই সময়ে মসুরের দাম মণে ১৯০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে মসুর বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৩৫৮ টাকা দরে।
এই দশ দিনে ইউক্রেন থেকে আমদানিকৃত প্রতি মণ সরিষার দাম ২ হাজার ৬৫০ টাকা থেকে বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৬৩০ টাকায়।
খাতুনগঞ্জের মেসার্স হক ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী আজিজুল হক বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কারণে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। সরবরাহ কম থাকায় এবং বেশি দামে আমদানি করার কারণে দাম বেড়ে গেছে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, শুধু গম নয়, তেল ও চিনির দামও বাড়তি। একটা বিস্কুট বানাতে গেলে তিনটি উপাদানই দরকার পড়ে। এসব উয়াপাদানে মোট ৮০ ভাগ খরচ হয় এবং বাকি ২০ শতাংশ হলো শ্রমিক থেকে শুরু করে অন্যন্য খরচ। অর্থাৎ এসব উপাদানের দাম বাড়লে ওই উপাদানের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
কামরুজ্জামান আরও বলেন, সব মিলিয়ে এখনকার দাম দিয়ে হিসেব করলে তিনটি উপাদান মিলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। এক্ষেত্রে দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।
সরকারি আমদানি নিয়ে অনিশ্চয়তা
এ বছর সরকার ৪ লাখ টন গম আমদানি করেছে, লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ টন। কিন্তু বাকি ১ লাখের সোর্সিং নিয়ে এখন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'সংটের সময় সবাই খাদ্য মজুদ করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক দেশই এ কাজ করছে। ফলে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা আরও ২ লাখ টন গম আমদানির প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর মধ্যে ভারত থেকে ৫০ হাজার টন আমদানি চূড়ান্ত করেছি। তবে বাকিটার উৎস এখনো জানা যায়নি।'
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোসাম্মাত নাজমনারা খানম বলেন, 'আমরা সাধারণত যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে তুলনামূলক কম দামে গম পাই। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুটির বাস্কেট থেকে যেহেতু চালান বন্ধ হয়ে গেছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে।
'তবে ভারত আমাদের জন্য নতুন বাজার। আমরা ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে কথা বলেছি। বুলগেরিয়ার সঙ্গেও আমাদের একটি চুক্তি আছে। সেখান থেকে তুলনামূলক কম দামে গম পাওয়া যাবে।'
**প্রতিবেদনটি তৈরিতে আরও সহযোগিতা করেছেন মোহসিন ভূঁইয়া ও তারিফ তাহমিদ খান