বেড়েই চলেছে দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার দাম
বিদেশে শিক্ষা, চিকিৎসা, ভ্রমণ ও পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে দেশের বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার দাম বেড়েই চলছে, কমছে টাকার মান। আন্তঃব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার তুলনায় খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় টাকা বেশি। যার ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের।
বুধবার (৩০ মার্চ) আন্তঃব্যাংকে ডলার বিক্রি হয়েছে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। এছাড়া সৌদি রিয়েল বিক্রি হয়েছে ২২ টাকা ৯৮ পয়সা। যদিও ব্যাংকগুলো ৮৮-৮৯ টাকায় ডলার কেনাবেচা করছে।
গত ২৩ মার্চ প্রতি মার্কিন ডলারের দাম ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া জানুয়ারি মাসের শুরুতে ডলারের মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খোলাবাজারের ডলার বিক্রেতা মো. রিপন বুধবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ৯২ টাকা ৫০ পয়সা। এছাড়া সৌদি রিয়েল বিক্রি হচ্ছে ২৪ টাকা ২০ পয়সা।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর মার্কেটে ডলারের সাপ্লাই কম ও চাহিদা বেশি তাই ডলারের দামটা বেশি। এছাড়া পবিত্র রমজান মাসে অনেকে ওমরাহ করতে সৌদিতে যায় তাই সৌদি রিয়েলের দাম বাড়ছে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, ডলারের দাম বাড়লে রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হবেন। অন্যদিকে আমদানিকারকদের খরচ বাড়বে। যদিও ডলারের দাম বেড়ে গেলে আমদানি খরচ বেড়ে যাবে, বাড়বে পণ্য মূল্যও।
এদিকে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে টানা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমছে। একইসঙ্গে রপ্তানির তুলনায় আমদানির খরচ বাড়তে থাকায় দেশের ব্যাংকগুলোর ডলারের চাহিদা বেড়েছে। সেই চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করতে গিয়ে দেশের রিজার্ভও কমেছে প্রায় চার বিলিয়ন ডলার।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস জুলাই-জানুয়ারিতে ঋণপত্র খোলার হার (এলসি) বেড়েছে ৪৯ শতাংশ ও ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে ৫২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এতে ডলারের চাহিদা ব্যাপকহারে বেড়েছে। যদিও সেই তুলনায় রপ্তানি আয় বেড়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। আর জুলাই-ফেব্রুয়ারি আট মাসে প্রবাসী আয় কমেছে ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ।
রমজানে ওমরাহ করার উদ্দেশ্যে লক্ষীপুর থেকে বুধবার খোলাবাজারে সৌদি রিয়েল কিনতে আসেন শাহে আলম। তিনি ২৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১৫ শত রিয়েলে কিনেছেন। অথচ ব্যাংকগুলোতে তা বিক্রি হচ্ছে ২২.৯৮ পয়সা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরের এখন পর্যন্ত প্রায় ৩.৭৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। যদিও ব্যাংকগুলোর চাহিদার আলোকে ডলার বিক্রি করে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ দাঁড়াল ৪৪.১৯ বিলিয়ন ডলার। যা গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছিল।
রেমিট্যান্সের নিম্ন প্রবাহের পাশাপাশি উচ্চ ইমপোর্ট পেমেন্টের কারণে রিভিউ টাইমে বাংলাদেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ের মধ্যে চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০.০৬ বিলিয়ন ডলারে, যা এক মাস আগেও ৮.১৮ বিলিয়ন ডলার ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে উদ্বৃত্ত ছিল ১.৫৬ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, বহিঃবিশ্বের সাথে আমাদের ট্রেড গ্যাপ বা বাণিজ্য ব্যবধান ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে ৮২% বা ৮.৪৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ১৮.৬৯ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, এই সময়ে বিদেশি আয় বাড়াতে টাকার মান আরও কমাতে হবে। তাতে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় এবং পণ্য-সেবা রপ্তানি আয় বাড়বে। তবে কার্ব মার্কেটের সঙ্গে সমন্বয় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজর দিতে হবে; যাতে মধ্যখাতে ১/২ টাকা পার্থক্য থাকে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে আমদানি ঘাটতি ব্যাপক বেড়েছে। আমদানি-রপ্তানির ঘাটতি কমিয়ে আনতে হলে ডলারের দাম আরও বাড়াতে হবে। এতে প্রবাসীদের আয়ের প্রবাহ বাড়বে। রপ্তানি মূল্য বেশি পাবে।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় কার্ব মার্কেটে রেট বেশি থাকায় প্রবাসীরা হাতে হাতে টাকা নিয়ে আসছে। তাই দুই বাজারের পার্থক্যটা এক টাকায় নামিয়ে আনতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কোভিডের পর থেকে পণ্য আমদানি অনেক বেড়েছে। আবার একইসঙ্গে ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া বেড়ে গেছে। যার কারণে ডলারের খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে দামও বাড়ছে।
'প্রবাসীদের আয়ের পরিমাণও কমে গেছে। সেজন্য তারা কম পরিমাণ অর্থ পাঠাচ্ছেন। আবার অনেকে হাতে হাতে ডলার পাঠাচ্ছেন। কারণ এভাবে পাঠালে বেশি টাকা পাওয়া যায়।'
তিনি আরও বলেন, যেসব জায়গায় খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হয়, সেখানেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নজরদারি বাড়াতে পারে। তাহলে কিছুটা চাপ তৈরি হবে। এতে বৈধ চ্যানেলে আয় বাড়তে পারে।