আগামী বাজেট হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে ‘চ্যালেঞ্জিং’
একদিকে দীর্ঘ দুই বছরেরও লম্বা সময়ের কোভিড পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চাহিদা, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামায় বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনে পড়েছে মারাত্বক প্রভাব। এরমধ্যে ঋণের চাপ সহনীয় পর্যায়ে আনতে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমানোর চাপও রয়েছে। সেইসঙ্গে আবার মুদ্রাস্ফীতিও চোখ রাঙাচ্ছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সরকারের জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় যেসব 'মেগা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট' (উন্নয়ন প্রকল্প) একেবারেই না হলে নয়, তা রেখে বাকী প্রকল্পগুলো যতটা কমিয়ে আনা যায় এবং এর পাশাপাশি অনুৎপাদনশীল খাতের ব্যয়ও কমিয়ে আনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।
শনিবার (২ এপ্রিল) রাজধানীর কারওয়ানবাজারে সিএ ভবনে বাজেট নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনায় এসব কথা বলেন তারা। তাদের মতে, আগামী বাজেট সরকারের জন্য এ যাবতকালের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বাজেট হতে যাচ্ছে।
ইনস্টিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অফ বাংলাদেশ (আইসিএবি) এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)-এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। 'সামষ্টিক অর্থনীতি: ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে প্রত্যাশা' শীর্ষক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইসিএবি'র সভাপতি মোঃ শাহাদাত হোসেন। আলোচনা সঞ্চালনা করেন আইসিএবি'র সাবেক সভাপতি হুমায়ুন কবির।
আলোচনায় মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, এবারের বাজেট ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হচ্ছে, যা গত একশত বছরেও হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী ও ভোক্তার ওপর চাপ কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হলে সুযোগের পাশাপাশি অনেক চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হবে। জ্বালানির মূল্য সহনীয় রাখার লক্ষ্যে এ খাতের জন্য সরকারের ফান্ড ভর্তুকি দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার্স অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়ে এবারের বাজেট আসছে। এমনকি ১৯৭৩ সালের চেয়েও চ্যালেঞ্জিং সময়ে রয়েছে এবারের বাজেট।
সেমিনারের ফাঁকে এ বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়ছে এবং দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই অবস্থান নিয়েছে। সরবরাহ চেইনও এখন স্বাভাবিক নয়; ব্যাংকিং এবং শিপিং লাইনে সমস্যা; জ্বালানি তেলের দামও বাড়ছে। আর এ পরিস্থিতি কবে ঠিক হয় বলা যাচ্ছে না। সুতরাং আমাদের একটি দীর্ঘায়িত সংকটের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।"
এরই মধ্যে ব্যবসায়ী নেতারা কোভিড থেকে উত্তরণ ও স্থানীয় শিল্প বিকাশ এবং আর্থিক খাতকে টেকসই করার লক্ষ্যে সরকারের কাছে ট্যাক্স কমানোর দাবি জানিয়ে আসছেন। সেইসঙ্গে কর প্রদানকে সহজ করা, হয়রানি কমানোসহ এনবিআরের কাছে একগুচ্ছ দাবি ছাড়াও জ্বালানির দাম স্থানীয়ভাবে না বাড়ানোর মতো দাবি আসছে। সরকারের ওপর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি অব্যাহত রাখার চাপও রয়েছে।
মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিয়ে শ্রীলঙ্কার চ্যালেঞ্জিং সময়ের কথা তুলে ধরে দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মেগা প্রজেক্টে ব্যয়ের বিষয়ে শিক্ষা নেওয়ার আহ্বান জানান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, পদ্মা সেতু ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মতো প্রকল্পগুলো ঠিক আছে। কিন্তু রামু-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের মতো ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কোনো প্রকল্পের আপাতত প্রয়োজন নেই। একইভাবে, পদ্মা রেল ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো প্রকল্পগুলোও পুনর্বিবেচনা করা উচিত, যেগুলো থেকে হাই রেট অফ রিটার্ন আসার সম্ভাবনা নেই।
তিনি আরও বলেন, "আমরা (বাংলাদেশ) এখন পর্যন্ত ভালো অবস্থায় আছি।" কিন্তু ঋণ করে কম প্রয়োজনের মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নে সতর্ক না হলে শ্রীলঙ্কার মত পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে টাকা ছাপানো ছাড়া উপায় থাকবে না বলেও সতর্ক করেন তিনি।
একইভাবে তিনি অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমানোরও আহ্বান জানান। আমলাতন্ত্রের পেছনে অনেক ব্যয়ের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, "প্রত্যেক সচিবের কেনো একজন করে বডিগার্ড লাগবে? পৃথিবীর কোথাও এটি নেই। পাজেরো গাড়ি দেওয়া হচ্ছে। অ্যাফোর্ড করতে না পারলে এসব ব্যয় করা উচিত নয়।"
এর পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্তি ভর্তুকি থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, "কেবল সারের পেছনেই ৩৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি। ভারতের চেয়েও কম দাম এখানকার সারের। এই ভর্তুকির সার পাচার হয়ে যায় কিনা, তা দেখতে হবে।"
অনুৎপাদনশীল খাতে বেশি ব্যয়কে অন্যায় বলে মন্তব্য করেন পরিকল্পনা মন্ত্রীও। তিনি বলেন, "এতে সংস্কার আনা দরকার।"
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে বলে আশঙ্কার কথা জানান চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম । তিনি বলেন, এ বছর মুদ্রাস্ফীতি ৭ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে।
ট্যাক্স নেট প্রত্যাশিত হারে না বাড়ার জন্য রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের হয়রানিকে দায়ী করেন ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)-এর সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, "নেট না বাড়ার জন্য এটিই বড় কারণ। এনবিআর মনে করে, তারা সবাই (ব্যবসায়ীরা) চোর, তাদের ধরতে হবে।"
এ সময় তিনি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জমি বিক্রিতে মৌজা রেট ও বাজার মূল্যের বিস্তর ব্যবধানের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, "এসব কারণে সাদা টাকা কালো হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স আসবে না।"
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোঃ ইউনুসুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজার দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নের মূল উৎস; সেইসঙ্গে তিনি আগামী বাজেটে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন।
বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)-এর সভাপতি শমী কায়সার, দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন বিভাগের প্রধান শওকত হোসেন মাসুম, ইআরএফ-এর সভাপতি শারমিন রিনভী এবং মহাসচিব এসএম রাশেদুল ইসলাম প্রমুখ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।