স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা ও এলডিসি পরবর্তী প্রস্তুতির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে এনবিআরকে
দুই বছরের কোভিড পরিস্থিতির ধকল কাটিয়ে অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ফেরাতে বিনিয়োগ ও স্থানীয় শিল্পবান্ধব বার্ষিক আর্থিক নীতির অংশ হিসেবে ভ্যাট-ট্যাক্স কমানোর দাবি এসেছে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও (এনবিআর) স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেবে এমন রাজস্ব কাঠামোর পক্ষে, যার প্রতিফলন গত বাজেটেও দেখা গেছে।
কোভিডের ধাক্কায় ক্ষতির শিকার হওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে তাদের সুরক্ষার মাধ্যমে অর্থনীতির গতি ফেরানো এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ হতে যাওয়া বাংলাদেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জও অপেক্ষা করছে, যার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, স্থানীয় শিল্পকে বর্তমানে দেওয়া সুরক্ষা অনেকটাই কাটছাঁট করতে হবে, কমিয়ে আনতে হবে আমদানি পর্যায়ে উচ্চ-ট্যারিফ।
ফলে একদিকে স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা, নতুন নতুন সুবিধা নিশ্চিত করার তাগিদ, অন্যদিকে ওই সুরক্ষা কমিয়ে আনার চাপ– এই দুই বিপরীতমুখী অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই আগামী বাজেটে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
বাজেট আলোচনায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমও এ বাস্তবতা অনুধাবন করেছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের বলেন, বাজেটে স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু, বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী স্থানীয় ও রপ্তানিমুখী শিল্পকে দেওয়া বিভিন্ন সুবিধা কমিয়ে আনার বাধ্যবাধকতা মানা ও এসব শিল্পের জন্য বর্তমানের মতোন এত বিপুল সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হবে না জানিয়ে শিল্পোদ্যোক্তাদের এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
এর অর্থ হলো, সরকার স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে আমদানি পণ্যে বর্তমানের মতো এত বেশি শুল্ক রাখতে পারবে না। তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।
অর্থনীতিবিদরাও তাই মনে করছেন। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিওটিও) নীতিমালা মানতে হলে, আমদানি পণ্যে উচ্চ শুল্ক কমিয়ে আনতে হবে।
এই বিপরীতমুখী বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় করাই সরকারের জন্য আগামী বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা গেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।
তিনি বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশন পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। বিদেশি পণ্যের শুল্ক বাড়িয়ে স্থানীয় শিল্পকে সুযোগ করে দেওয়ার পাশাপাশি, তাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যেকোনো খাতকে প্রণোদনা বা সুযোগ দিলে সময় বেঁধে দিতে হবে। ওই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই যেন তারা প্রতিযোগী সক্ষম হয়ে উঠে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
স্থানীয় শিল্পের স্বার্থে, গত দুই বাজেটে সরকার বেশ সাহসী উদ্যোগ নিয়েছে। রাজস্বে বড় ধাক্কার ঝুঁকি সত্ত্বেও দুই বছরে কর্পোরেট করহার ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে সাধারণ কোম্পানির জন্য ৩০ শতাংশ ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২২.৫ শতাংশ করেছে । আসছে বাজেটে, এই করহার আরো ২.৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কমাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দাবি তুলেছে দেশের প্রায় সকল ব্যবসায়ী সংগঠন।
শুধু কর্পোরেট কর নয়, কোভিডে ক্ষতির মুখে পড়া ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প রক্ষায় উদ্যোগ চেয়েছেন তারা। অগ্রিম কর প্রত্যাহার, স্থানীয় শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কহার কমানো, কয়েকটি খাতে কর অবকাশ সুবিধা প্রদান, ব্যক্তিশ্রেনীর করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানো, ন্যূনতম কর প্রত্যাহার, টার্নওভার ট্যাক্স সীমায় পরিবর্তনসহ নানান দাবি উঠে এসেছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এনবিআরের প্রাক-বাজেট আলোচনায়। পাশাপাশি ভ্যাট ও শুল্কের বিভিন্ন অসঙ্গতি দূরীকরণ এবং কর পরিশোধ আরো সহজতর করার প্রস্তাবও করেছে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। যদিও গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বাজেটেই ট্যাক্স, ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর একগুচ্ছ দাবি থাকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ অন্যান্য সংগঠনগুলোর।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর বাজেটেই আইনে পরিবর্তন আসে। কিছু পরিবর্তনে ব্যবসার সমস্যা আংশিক সমাধান হয়, আবার কিছু পরিবর্তন নতুন করে সমস্যা তৈরি করে। সময়ের পরিবর্তনে ব্যবসার ধরন পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগী দেশগুলোর নীতি পরিবর্তনের কারণে নতুন চাহিদা তৈরি হয়। ফলে পরের বছর আবার ওইসব বিষয়ে কথা বলতে হয়।
ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন- ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, আমরা প্রতিবছর দাবি করি। তবে প্রতিফলন বেশি হয় না। তবে কয়েক বছর ধরে এনবিআর ব্যবসায়ীদের কিছু সুবিধা দিয়ে আসছে। কিন্তু আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক আইনগুলো অত্যন্ত জটিল। অনেক খাতেই কর এখনো প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বেশি।
কর্পোরেট করহার কমানোর পাশাপাশি, গত কয়েক বছর ধরেই এনবিআর স্থানীয় শিল্প প্রসারে কর ছাড়ের মত সুবিধা দিয়ে আসছে। ইলেকট্রনিক, ইলেক্ট্রিক্স, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, মোবাইল ফোন, অটোমোবাইল শিল্পসহ আমদানি নির্ভরতা কমায় এমন শিল্প স্থাপনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি, উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছে। বিপরীতে আমদানি পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধিও করে, স্থানীয় শিল্পকে বাড়তি সুবিধাও দিচ্ছে সরকারের রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটি।
২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তীতে, ডব্লিওটিওর নীতি মেনে আমদানি পণ্যে বর্তমানের ন্যায় মাত্রাতিরিক্ত ট্যারিফ প্রত্যাহার করার তাগিদ রয়েছে।
কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখনো এই সুরক্ষা দিয়ে যাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। খোদ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেমার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রস্তাবে আমদানিকৃত তৈরি পণ্যে কাস্টমস শুল্কের সর্বোচ্চ হার ২৫ শতাংশ রাখার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, অগ্রিম আয়কর ও ভ্যাট অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের লক্ষ্যে, ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার শেষ পর্বে গত মঙ্গলবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই- এর সঙ্গে আলোচনা করেছে এনবিআর। আলোচনায় অর্থবহ ও কার্যকর ফলাফল বাজেটে দেখতে চেয়েছেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসীম উদ্দিন।
সেই সাথে আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে আমদানি-বিকল্প পণ্য উৎপাদনে কর সুবিধা অন্যান্য খাতের জন্যও বিস্তৃত করার পরামর্শ দেয় সংগঠনটি। পাশাপাশি কোভিডে ক্ষতির মুখে পড়া ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের রক্ষায় উদ্যোগ চেয়েছেন তারা। আয় না হলে কোন ধরণের অগ্রিম করের (যা পরবর্তীতে সমন্বয় বা ফেরত পাওয়া যায় না) বিপক্ষে শক্ত অবস্থান জানানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বার্ষিক আর্থিক সুবিধা এমনভাবে দেওয়া, যাতে সংশ্লিষ্ট সবাই তা নিতে পারে, তাও তুলে ধরেছেন ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া আগামী বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য সামগ্রী ও কৃষিজাত পণ্য ক্রয়ে বিদ্যমান টিডিএস ২ শতাংশ বাতিল করা, ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত বৈদেশিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনুমোদনযোগ্য ব্যয়ের সীমা দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ করা, প্রমোশনাল ব্যয়ের সর্বোচ্চ অনুমোদনযোগ্য সীমা দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা, কর্মীর আয়কর রিটার্ন দাখিলের ব্যর্থতার জন্য কোম্পানির ব্যয়কে অগ্রাহ্য করার বিধান বাতিল করা, ভবিষ্যতে করের প্রভাব কেমন হবে- সে বিষয়ে অ্যাডভান্স রুলিং এর ব্যবস্থা থাকা, অনলাইনে শুনানির ব্যবস্থা রাখা, হাইকোর্টে আপিলের পূর্বশর্ত হিসেবে ২৫ শতাংশের এর স্থলে ১০ শতাংশ করা, ব্যক্তি করদাতাদের ন্যূনতম করে রেহাই দেওয়া, সারচার্জ মুক্ত সীমা ৩ কোটি থেকে ৫ কোটি টাকা করা, এসএমই খাতের নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া, স্থানীয় শিল্পের স্বার্থে কাঁচামাল আমদানির শুল্ককর কমানো, সব রপ্তানি খাতের জন্য কর্পোরেট করহার একই করাসহ বেশ কিছু দাবি করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে কর্পোরেট করহার কমানোর সুবিধা না পাওয়ার ব্যাখ্যাও দিয়েছে- ঢাকা মেট্রোপলিটন কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই), অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) সহ বেশকিছু সংগঠন।
সংগঠনগুলো বলছে, অগ্রিম আয়কর (এআইটি ও এটি) ও ন্যূনতম কর আদায় করা হয়, যা পরবর্তীতে লোকসানি প্রতিষ্ঠান, কিংবা আয় না করা প্রতিষ্ঠান সমন্বয় বা ফেরত পায় না। সেজন্য কর্পোরেট করহার কমানো সত্ত্বেও কার্যকর কর হার ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ হয়ে যায় বলে জানিয়েছে বেশকিছু ব্যবসায়ী সংগঠন। এসব কারণে কর কমানোর সুবিধা নেওয়া যাচ্ছে না বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
দেশে বর্তমানে ১১১টি খাত থেকে অগ্রিম আয়কর আদায় করা হয়, যার মধ্যে ৪১টি ন্যূনতম কর বা অফেরতযোগ্য। যে পরিমাণ রিফান্ড দেওয়া হয়, তা টিডিএস এর মাত্র দশমিক ২০ শতাংশ। প্রোডাকশন লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে, এমন ক্ষেত্রে বিশেষ কর ছাড়ের প্রস্তাব দিয়ে এক্ষেত্রে ভারতের উদাহরণ দিয়েছেন এমসিসিআই এর সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।
তিনি বলেন, গত বাজেটে ভারত প্রোডাকশন লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি (পিএলআই) ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ করেছে। আর নতুন করে যারা শিল্প স্থাপন করছে, তাদের কর ২৫ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করেছে। ভারত ও ভিয়েতনামের মতো এমন নীতি, বাংলাদেশেও নেওয়ার প্রস্তাব দেন তিনি।
আগামী বাজেটের জন্য ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগ দাবিই যৌক্তিক বলে মনে করছেন, ড. আহসান এইচ মনসুর। বিশেষত কর না হওয়া সত্ত্বেও লেনদেনের ওপর অগ্রিম আয়কর ব্যবস্থা বাতিল করার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
ন্যূনতম কর বিষয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর খুব কমই দেশেই এভাবে মিনিমাম ট্যাক্স নেওয়ার বিধান রয়েছে, কিন্তু সেখানে রিফান্ড ব্যবস্থাও রয়েছে। অথচ এখানে ট্যাক্স নেওয়া হলেও- তা ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা অনেক কঠিন।
এনবিআরের প্রধান বাজেট সমন্বয়কারী ড. মো. নায়েমুল ইসলাম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ প্রতিষ্ঠান বাজেট প্রস্তাব আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুইশ প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সরাসরি এনবিআরে উপস্থিত হয়ে তাদের প্রস্তাব ও এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। আমরা এখন এসব পর্যালোচনার কাজ শুরু করেছি'।