বাংলাদেশকে নিজের বাড়ি বানিয়েছেন যে দক্ষিণ কোরিয়ান উদ্যোক্তা
কিহাক সাং—এশিয়ার পোশাক মোগল। নিজের জীবনদর্শন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন বলেই কিহাক সাং আজকের এই অবস্থানে পৌঁছতে পেরেছেন।
যেমন, তিনি বিশ্বাস করেন, পরিশ্রম, পরিশ্রম এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যে-কেউ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে। ৭৫ বছর বয়সি এই কোরিয়ান পোশাক উদ্যোক্তা এখনও ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে ওঠেন। আর ঘুমাতে যান গভীর রাতে। দীর্ঘ কর্মদিবসে তিনি নিজের কারখানায় ঘোরেন, উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখেন।
তার দ্বিতীয় বিশ্বাস হলো, পৃথিবীকে টিকিয়ে রাখার জন্য সবকিছুই টেকসই হতে হবে। চট্টগ্রামে ২,৪৯২ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত তার কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (কেইপিজেড) একবার ঢুঁ মারলেই তার এই বিশ্বাসের প্রমাণ পেয়ে যাবেন। এই শিল্পাঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি জমি বরাদ্দ রাখা হয়েছে গাছ ও বন জন্মানোর জন্য। ৮৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ১৩৭ প্রজাতির পাখির প্রাণচাঞ্চল্যে মুখরিত এ জায়গা।
কিহাক সাংয়ের তৃতীয় দর্শন হলো, বিপদে পড়লে হাঁটুন, হাঁটুন এবং হাঁটুন। এভাবেই কিহাক একদিন বিস্তীর্ণ বালুকাময় জমির সন্ধান পেয়ে যান, যাকে তিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কেইপিজেডে পরিণত করেছেন।
সাদামাটা শুরু
কিন্তু যে মানুষটি তার কোম্পানি ইয়াংওয়ান ও কেইপিজেডের মাধ্যমে বাংলাদেশে ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছেন, ১৯৭২ সালে তার যাত্রার শুরুটা ছিল খুব সাদামাটা।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথা অনুযায়ী কোরিয়ান সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে ১৮ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে কিহাক সাং ভাবছিলেন জীবিকা হিসেবে কী বেছে নেবেন। বাবার কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসায় যোগ দেবেন না বলে স্থির করেন তিনি। কিহাক মুগ্ধ হতেন হাই স্ট্রিটের দোকানে সাজিয়ে রাখা হরেক রকমের পোশাক দেখে।
তাই ২৫ বছর বয়সে তিনি একটি পোশাক কোম্পানিতে সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে যোগ দেন।
কোরিয়া ওই সময় রূপান্তরের পর্যায়ে ছিল। দেশটির টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস উৎপাদনের যাত্রা শুরু হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে এ খাতে দক্ষিণ কোরিয়া গোটা বিশ্বে বড় নাম হয়ে ওঠে।
ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কিহাক বলেন, 'আমি টেক্সটাইল কোম্পানির জন্য পণ্য বিক্রি করছিলাম। সেলসম্যানের কাজ হলো গ্রাহকদের সঙ্গে দেখা করা ও যোগাযোগ রাখা, নমুনা পণ্য বা ডিজাইন গ্রহণ করা, নমুনা বানানো বা এর বাণিজ্যিকীকরণ করা, তারপর ক্রেতার অনুমোদন আদায় করা এবং উৎপাদনের শিডিউল ও মানের তত্ত্বাবধান করা। ব্যাপারটা শুধু বিক্রয় নয়—বরং একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা, যার একাধিক আঙ্গিক রয়েছে।'
অচিরেই তিনি সুইডিশ ব্যবসা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। আমেরিকানদের গ্রাহকদের সঙ্গেও নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
দু-বছর সেলসম্যান হিসেবে কাজ করার পর ১৯৭৪ সালে দুই অংশীদারকে নিয়ে ইয়াংওয়ান কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন কিহাক সাং। পোশাক উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য সিউল শহরে ইয়াংওয়ানের প্রথম কারখানা স্থাপন করা হয়।
তার সেলসম্যান হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা শুধু কোরিয়াভিত্তিক ইয়াংওয়ান উদ্যোগেই নয়, বাংলাদেশেও কাজে এসেছে।
১৯৭৯ সালে তরুণ উদ্যোক্তা কিহাক সাং সিউল থেকে চট্টগ্রামে উড়ে আসেন, সেখানে পোশাক কারখানা স্থাপন করতে পারেন কি না দেখার জন্য। ওই সময় জায়গাটিকে তেমন সম্ভাবনাময় মনে হয়নি। বাংলাদেশে তখন শতভাগ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমতি ছিল না। তাছাড়া অবকাঠামোগত সহায়তার অবস্থাও ছিল ভীষণ খারাপ।
কিন্তু কিহাক একটা কারণে এদেশে এসেছিলেন—ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশে কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। কোরিয়া ওই সময় উন্নত বিশ্বে কোটামুক্ত সুবিধা পেত না। অনেক কোরিয়ান রপ্তানিকারক তখন শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তান ঘুরে দেখছিলেন ওসব দেশে কারখানা স্থাপন করে ওখানকার কোটামুক্ত সুবিধা ব্যবহার করে প্রতিযোগিতা-সক্ষম থাকা যায় কি না।
ইয়াংওয়ানের যাত্রা শুরু
নানা ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও বাংলাদেশকে বেছে নেন কিহাক সাং। ঘুরে যাবার কমাস পরই, ১৯৮০ সালের মে-তে বাংলাদেশি অংশীদারদের নিয়ে ইয়াংওয়ান বাংলাদেশ লিমিটেড নামে নিজের কারখানা স্থাপন করেন কিহাক।
সুইডিশ ক্রেতার ক্রয়াদেশ ছিল তার কাছে। এক ব্যাচ সাধারণ পোশাকের অর্ডার দিয়েছিল তার ক্রেতা। ওই কারখানায় শ্রমিক ছিল প্রায় ২৫০ জন। তাদের সবাইকে অভিজ্ঞ কোরিয়ান অপারেটরদের দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ানো হয়। ১৯৮৪ সাল নাগাদ কিহাকের কোম্পানি ১৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করে।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে কিহাক সাংয়ের ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনে প্রায় ৮৫ হাজার লোক কর্মরত—তাদের ৭০ হাজার কাজ করেন বাংলাদেশে। সিউল স্টক মার্কেটে তালিকাভুক্ত ইয়াংওয়ানের বার্ষিক টার্নওভার ৩ বিলিয়ন ডলার। এই আয়ের এক-তৃতীয়াংশ আসে বাংলাদেশ থেকে।
এখন ভিয়েতনাম, উজবেকিস্তান, এল সালভাদর ও ইথিওপিয়াতে কারখানা আছে কিহাকের কোম্পানির। তবে তার সবচেয়ে বড় সম্পদ আনোয়ারার কেইপিজেড—প্রতি বছর নতুন নতুন শিল্প কমপ্লেক্স যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে যা এখনও সমৃদ্ধ হচ্ছে।
মার্চের শেষের দিকে কেইপিজেডের নিজ বাসভবনে বসে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় কিহান জানান, 'বাংলাদেশে আমরা প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছি। শিগগিরই এই অঙ্ক ১ বিলিয়ন ডলার ছোঁবে।'
কেইপিজেডে ইতিমধ্যে গার্মেন্টস, টেক্সটাইল, কৃত্রিম (ম্যানমেইড) ফাইবার, জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস উৎপাদনের ৪০টি শিল্প ইউনিট রয়েছে। এখানে ৩০ হাজার কর্মী কর্মরত—তাদের সিংহভাগই আনোয়ারা ও তৎসংলগ্ন এলাকার নারী। অন্যান্য ইপিজেডেও ইয়াংওয়ানের কিছু কারখানা রয়েছে।
রপ্তানিতে ইয়াংওয়ানের মূল্য সংযোজন গড়ে ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ—কিছু আইটেমের বেলায় তা ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত।
ইয়াংওয়ান এখনও দামি আইটেমে ব্যবহৃত হাই-টেক কৃত্রিম ফাইবারে বিনিয়োগ করছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অন্যান্য পোশাকশিল্পের জন্য এমএমএফের প্রধান উৎস হয়ে উঠবে এটি।
২৫ কিলোমিটার রাস্তার নেটওয়ার্ক সংবলিত ২ হাজার ৫০০ একরেরও বেশি জমিজুড়ে বিস্তৃত কেইপিজেডের ভূমির অর্ধেকেরও বেশি জুড়ে আছে বন ও জলাধার। একটি শিল্পাঞ্চল কেমন হওয়া উচিত, তারই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কেইপিজেড।
অপরিচ্ছন্নতা ও দূষণ ভীষণ অপছন্দ কিহাক সাংয়ের। তার এই মনোভাবের ছাপ ফুটে রয়েছে কেইপিজেডের কারখানা ও কম্পাউন্ডের সর্বত্র। চত্বরে বা রাস্তায় ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকা যেকোনো শিল্পাঞ্চলের অতিপরিচিত দৃশ্য। কিন্তু সেই পরিচিত দৃশ্যই দেখা যাবে না কেইপিজেডের কোথাও। এখানে ওয়াশিং ও ক্লিনিং ইউনিটগুলোর মেঝে শুকনো খটখটে—অথচ দেশের অন্যান্য কারখানায় দেখা যায় একেবারেই উল্টো চিত্র।
সম্প্রতি চীনে বিনিয়োগ থেকে সরে এসেছেন কিহাক সাং। তবে তিনি এখন ভারতের তেলেঙ্গানায় একটি নতুন টেক্সটাইল বিনিয়োগ করছেন, আর ইন্দোনেশিয়ায় বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন।
বাংলাদেশে সাংয়ের যাত্রা
১৯৮০ সালের মে মাসে ইয়াংওয়ান বাংলাদেশ কীভাবে প্রথম অর্ডার সামলেছিল, সেই স্মৃতিচারণ করেন কিহাক সাং। 'কাঁচামাল বন্দরে এলে ডেলিভারি নেওয়ার জন্য আমরা হ্যান্ড কার্ট নিয়ে যাই। কারখানায় কাঁচামাল নিয়ে আসার সময় এই কার্টগুলো এক কিলোমিটার লম্বা লাইন তৈরি করে।'
এই উদ্যোগ সফল হয়। ২৫০ শ্রমিক নিয়ে কারখানাটি কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। আর কোরিয়া থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন কিহাক। কিহাক তার কারখানাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ঝামেলামুক্ত রাখার সংস্কৃতি নিয়ে আসেন।
'কিন্তু তখন বাইরে, আগ্রাবাদে প্রায়ই রাজনৈতিক বিক্ষোভ হতো। কারখানার ভেতরে কিছু লেবার-সংক্রান্ত সমস্যা ছিল। ব্যাপারটা আমি পছন্দ করিনি। কিন্তু আমার অংশীদাররাও ব্যাপারগুলোর সুরাহা করেননি,' বলেন তিনি।
কারখানাকে নোংরা দেখাবে, ব্যাপারটা কিহাকের মোটেই পছন্দ ছিল না। তার অংশীদাররা যখন পরিচ্ছন্ন কর্মীর জন্য অপেক্ষা করতেন, তখন কিহাক পরিষ্কার করার জন্য নিজেই ঝাড়ু হাতে তুলে নিতেন।
১৯৮৪ সাল নাগাদ কিহাক কোরিয়ায় ইয়াংওয়ান কর্পোরেশনের অংশীদারদের শেয়ার কিনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিহাকের অংশীদাররা বয়সে তার চেয়ে বড় ছিলেন। তাছাড়া ব্যবসাও তখন খুব বড় ছিল না। কিন্তু কিহাকের বিশ্বাস ছিল, তিনি নিজে সব সিদ্ধান্ত নিতে পারলে তার কোম্পানির উন্নতি হবে।
ইয়াংওয়ান বাংলাদেশ লিমিটেডের বেলায়ও একই পথে হাঁটেন কিহাক। ১৯৮৬ সালে তিনি অংশীদারদের থেকে আলাদা হয়ে যান। ওই বছরই তিনি ভালো বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ঝামেলামুক্ত পরিবেশের আশায় চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেডে) একটি কারখানা স্থাপন করেন।
সিইপিজেড ও একটি প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়
আশির দশকের গোড়ার দিকে সরকার চট্টগ্রাম ইপিজেড নির্মাণ করে। ওই সময়ের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে কিহাক সাং বলেন, 'আমি যখন সেখানে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম, তখন শুরুটা খুব ধীর ছিল। ওখানে মাত্র দুটি ছোট কারখানা ছিল তখন। বিনিয়োগকারী ও পোশাক উৎপাদকদের জন্য সরকার সেখানে আরও কিছু কারখানা নির্মাণ করে। এটা খুব ধীরে ধীরে বড় হয়।'
১৯৮৬ সালে সিইপিজেডে এসএস২ চিহ্নিত একটি ফ্যাক্টরি স্পেস ভাড়া নেয় ইয়াংওয়ান কর্পোরেশন। ওটা সুনির্মিত কারখানা ছিল। ধীরে ধীরে কোম্পানিটি বড় হয়, সেইসঙ্গে অন্যান্য ভবনগুলোরও দখল নেয়।
কিহান বলেন, 'আমি বিক্রি করছিলাম আর কিনছিলাম। প্রতি ছয় মাসে এক সপ্তাহের জন্য আমি ভিজিট করি।
'এখানে আমাদের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমি খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমরা যখন সিইপিজেডে চলে যাচ্ছিলাম, ওই সময় ১৯৮৬ সালে জ্যামাইকাতেও একটি কারখানাও স্থাপন করেছি। সেখানে আমরা সফলও হয়েছিলাম। এদিকে আমরা ইন্দোনেশিয়ায় চেষ্টা করছিলাম—ওটা অনেক বড় জায়গা।
'১৯৮৮ সালে ইয়াংওয়ান কোরিয়াতে আইপিও ছাড়ে। এটি আমাদের নগদ প্রবাহের অবস্থা ভালো করে। আমরা সিইপিজেডে আরও বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলাম। তাই ১৯৯০ সালে ১ লাখ বর্গফুট এলাকা নিয়ে একটা বড় কারখানা তৈরি করি। তখন আমরা প্রচুর অর্ডার পাচ্ছিলাম।'
১৯৯১ সালের এপ্রিলে এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে চট্টগ্রামে। উপকূলীয় অঞ্চলকে দুমড়েমুচড়ে দেয় সেই ঘূর্ণিঝড়—প্রাণ কেড়ে নেয় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের।
ওই ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কিহাক জানান, 'ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের প্রধান দরজা উড়ে যায়। তারপর পানি ঢুকে পড়ে ভেতরে, পুরো কারখানা ডুবে যায় কাদামাটিতে।
'কারখানা পুনরুদ্ধারের জন্য আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রামে ছিলাম। পুনরুদ্ধারকালে বুঝতে পারি, এখানকার এই শ্রমিকরা সত্যিই তাদের চাকরিটা করতে চায়, তারা আমাদের এই দেশে রাখতে চায়। পুনরুদ্ধারের পরে আমি যখন চলে যাচ্ছিলাম, ওরা সবাই কেঁদেছিল।
'এরপর আমরা আরও বিনিয়োগ করি। কারণ আমরা বিপর্যয় থেকে সফলভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম। আর আমাদের গ্রাহকেরা আমাদের শক্তি দেখেছেন, দেখেছেন কীভাবে আমরা তাদের ব্যবসাকে রক্ষা করেছি। আমাদের ক্রেতারা আমাদের প্রচেষ্টাকে খুব ভালোভাবে স্বীকৃতি দেন। রীতিমতো স্রোতের মতো অর্ডার আসতে থাকে তাদের কাছ থেকে।'
সেই বিপর্যয়ের পর ইয়াংওয়ান বহুতল ভবন তৈরি করতে শুরু করে। আর সবগুলো ওয়্যারহাউস রাখে বন্যার স্তরের উপরে। ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হতে থাকে ইয়াংওয়ানের।
'ওই সময় আমরা অনেক সমস্যায় পড়ি। বিশাল ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি সামলানোর সক্ষমতা ছিল না ইপিজেডের। আমাদের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিল না প্রশাসন। তাই আমি ভাবছিলাম, আমাদের বোধহয় নিজস্ব ইপিজেড থাকা দরকার।'
কেইপিজেডের দীর্ঘ গল্প
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সাংয়ের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এ সময় তিনি জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) একটি আয়োজনে অংশ নেন। সেখানে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি নতুন আসবাবপত্র রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা ও গবেষণা তুলে ধরে জাইকা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে এই ইপিজেড স্থাপনের পরামর্শ দেয় সংস্থাটি।
তবে কিহাক সাং বলেন, কিছু করতে হলে বেসরকারি উদ্যোগেই করা উচিত। বেসরকারি খাতই জানে কীভাবে কোনো কাজ করতে হয়। তারা দ্রুততম সময়ে কাজ করবে।
পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে সাং বলেন, 'সে সময় নিজস্ব ইপিজেড করার পরিকল্পনা ছিল না আমার। কিন্তু জাইকার সেই প্রোগ্রামের পরে বাংলাদেশের তৎকালীন কোরিয়ান রাষ্ট্রদূত আমাকে কাজটির জন্য চাপ দিতে শুরু করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন আমি এমন একটি ইপিজেড গড়ে তুলতে পারব।'
১৯৯৫ সালে ইপিজেড স্থাপনের উদ্যোগ নেন সাং।
ইপিজেডের জন্য জাইকার নির্ধারিত অঞ্চল পরিদর্শনকালে সাং দেখেন আনোয়ারার ভূ-প্রকৃতি শুষ্ক ও অনুর্বর।
'মানুষ তখন এখান থেকে বালি সংগ্রহ করত। পুরো অঞ্চল ছিল চোরাকারবারি, জলদস্যু আর গুন্ডাদের দখলে। বালির জন্য স্থানীয় মানুষ তখন জায়গাটিকে টেক্সাস বলে ডাকত,' বলেন তিনি।
'আমাকে বলা হয়েছিল উত্তর দিকে কিছুটা পানি আছে। কিন্তু আসলে কিছুই ছিল না। বেশিরভাগ সময়ই তা শুষ্ক থাকত। আবার বর্ষাকাল এলে সবকিছু পানির নিচে তলিয়ে যেত। অথচ কারখানা স্থাপনের জন্য আমাদের পানির প্রয়োজন,' বলেন তিনি।
এখানে কর্ণফুলী নদীর পানি লবণাক্ত। অন্যদিকে, খুব বেশি জলাশয়ও ছিল না। পাশেই সদ্য চালু হওয়া কাফকো কারখানা ভূগর্ভস্থ পানি তুলে কাজ করছিল। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসীরা অভিযোগ জানায় কাফকোর কারণে তাদের টিউবওয়েলের পানি শুকিয়ে গেছে।
পানি সংকটের সমাধান
পানির সমস্যার কথা মাথায় রেখে কিহাক সাং কেইপিজেডের ভূমির জন্য সরকারের কাছে যান। সরকার ইপিজেডটির জন্য ২ হাজার ৫০০ একরেরও বেশি জমি (প্রায় ১ হাজার ৭০০ একর সরকারের) অধিগ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালের মধ্যে একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়, যার আওতায় বেসরকারি ইপিজেডগুলো কাজ করবে।
কিন্তু এরপর সরকার বদল হলে কার্যক্রম শ্লথ হয়ে পড়ে। জমি ক্রয়, রাস্তাঘাট ও মৌলিক অবকাঠামো নির্মাণে ইয়ংওয়ান ততদিনে ১০০ কোটি টাকা খরচ করে ফেললেও সরকার ইপিজেড পরিচালনার লাইসেন্স দিচ্ছিল না। অবশেষে ২০০৬ সালে শর্তসাপেক্ষে ইয়ংওয়ানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেওয়া হয় সংশোধিত আরেকটি লাইসেন্স। পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে ইয়ংওয়ানের আরও কয়েক বছর লেগে যায়। কেইপিজেড এখন পর্যন্ত জমির নামজারির নথি পায়নি।
কিন্তু এতসব সমস্যা সত্ত্বেও কিহাক সাং ২০০৮ সাল থেকে একটি শিল্প কমপ্লেক্স নির্মাণ অব্যাহত রাখেন।
২০১১ সালে কেইপিজেড প্রথম কারখানা চালু করে।
'আমরা মাঝারি গভীরতার নলকূপের সাহায্যে পানি সংগ্রহ করেছি। কাফকোর তুলনায় আমাদের পানির ব্যবহার খুব বেশি নয়। কেইপিজেড এখানকার পানি রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহার করে,' বলেন তিনি।
'পরবর্তীতে আমরা বৃষ্টির পানি সংগ্রহের সিদ্ধান্তও নিই। একসাথে বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ করেছি। এই জিনিস দারুণ কাজ করেছে। বৃহৎ জলাধার নির্মাণ করে আমরা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করছি। এর আগে বৃষ্টিতে নদী বা গ্রাম ভেসে যেত।'
কেইপিজেডের জলাধারে বছরে এখন প্রায় ৫০০ মিলিয়ন গ্যালন পানি জমা হয়। এর ফলে গ্রামগুলো যেমন বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে, তেমনি শুষ্ক মৌসুমেও মিলছে পানি।
শুরুর বছরগুলোয় এখানকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল অনিশ্চিত। কারখানা চালাতে কেইপিজেডে ডিজেলচালিত ১.৫ মেগাওয়াটের তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় সুযোগটা কয়েক বছর আগে আসে বলে উল্লেখ করেন কিহাক সাং।
'বাংলাদেশের মান অনুযায়ী বিদ্যুৎ এখন স্থিতিশীল। উইভিং ইউনিট আমাদের নতুন সোলার প্যানেল সিস্টেম ব্যবহার করছে,' বলেন তিনি। (ইপিজেডের এই ২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্ল্যান্টটি বাংলাদেশের বৃহত্তম রুফটপ সোলার প্ল্যান্ট। এছাড়াও আরেকটি ২০ মেগাওয়াটের প্ল্যান্ট স্থাপিত হচ্ছে।)
'আমি চাই কেইপিজেড হবে বাস ও কাজ করার সবচেয়ে চমৎকার জায়গাগুলোর একটি। এর ভেতরে অনেক পাহাড় আর বন রয়েছে। উৎপাদনশীল শিল্পগুলোর পাশাপাশি জীবজন্তু ও প্রকৃতির সাহচর্যে কেইপিজেডকে আমি টিকিয়ে রাখতে চাই। শুরু থেকেই কেইপিজেডের ৫০ শতাংশ জায়গা গাছপালার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
'ইপিজেড বলেই যে সবকিছু কেবল ইট-পাথরের হবে, প্লট বিক্রির জায়গা হবে, ব্যবসা শেষে ইচ্ছেমতো তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাওয়া যাবে, তা নয়। আমি এখান থেকে যেতে চাই না। কেইপিজেড ছেড়ে যেতে পারব না আমি। তাই স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও কাজের জন্য আমি একে শহুরে ধাঁচে গড়ে তুলেছি,' বলেন এ বর্ষীয়ান উদ্যোক্তা।
বার্ষিক ৩ বিলিয়ন ডলার টার্নওভারের কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে ইয়াংওয়ান। ভবিষ্যতে এটি পর্তুগাল, তিউনিসিয়া ও মরক্কোতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছে। এ দেশগুলোতে (ইউরোপ-আমেরিকার) ক্রেতাদের কাছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরবরাহ পৌঁছানোর সুবিধা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে এ সুবিধা এখনো তৈরি হয়নি। বিশ্বজুড়ে কুইক রেসপন্স ইউনিটের মাধ্যমে তারা তাদের উৎপাদন বাড়াতে বাড়াতে চান বলে জানান কিহাক।
ভ্রমণকারী, সংগ্রাহক, সংস্কারক
১৯৭৫ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন কিহাক সাং। তিন মেয়ের বাবা তিনি। দ্বিতীয় মেয়েকে তিনি নিজের উত্তরাধিকার করেছেন।
'ছোটবেলায় এক জ্যোতিষী আমার হাত দেখে বলেছিল আমি এক হাজারবারের বেশি ভ্রমণ করব,' বলেন কিহাক। জ্যোতিষীর সেই ভবিষ্যদ্বাণী তো অক্ষরে অক্ষরে ফলেছেই, বরং তার ভবিষ্যদ্বাণীকেও ছাড়িয়ে গেছে কিহাকের ভ্রমণসংখ্যা। কারণ বছরের অর্ধেক সময়ই তাকে ব্যবসার কাজে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়।
তবে ব্যবসার কাজে এত ব্যস্ততা সত্ত্বেও পরিবার ও বন্ধুদের সময় দিতে ভোলেন না কিহাক। ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধব, ভাই-বোনদের নিয়ে এখনো সিউলের বাসায় বা গ্রামের পৈতৃক বাড়িতে আড্ডা জমে তার।
কিহাক বলেন, 'আমার বন্ধুরা ইতোমধ্যে দুবার বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। এ বছরও ওদের আসার কথা রয়েছে।
'যৌবনে আমি সাঁতার কাটতে পছন্দ করতাম, লম্বা দূরত্বের সাঁতার। এখন আর ওসব হয়ে ওঠে না। একবার সাঁতারের জন্য প্রথম পুরস্কারও পেয়েছিলাম,' স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
'এখন আমার শখ হচ্ছে ক্যামেরা সংগ্রহ করা। পুরোনো দিনের মেকানিক্যাল ক্যামেরা; ছোটগুলো। আমার সংগ্রহে বোধহয় ১০ হাজারের মতো ক্যামেরা আছে। অডিও ইকুইপমেন্টও সংগ্রহ করি আমি। সিউলের স্থানীয় দোকানগুলোতে থেকে কেনা হয় এগুলো,' জানান কিহাক।
সাম্প্রতিককালে ব্রন ডিটার র্যামস-এর কাছ থেকে ১০টি রেকর্ড প্লেয়ার কিনেছেন কিহাক। পাঁচটা ভালো ছিল, বাকি পাঁচটাকে অনেকটাই মাজাঘষা করতে হয়েছিল। জার্মান ডিজাইনার ডিটার র্যামসকে ডিজাইনারদের ডিজাইনার বলা হয়। তার কাজ থেকেই আইফোনের ডিজাইনের ধারণা নেওয়া হয়েছিল।
পুরনো স্থাপনা নিয়ে নাড়াচাড়া করাও কিহাকের পছন্দের কাজ। কেনার সময় কেইপিজেডে তার বাড়িটি বেশ পুরোনো ছিল, পরে সেটিকে নতুন করে সাজানো হয়।
১৮৩০ সালে কিহাকের দাদার তিন ঊর্ধ্বতন পুরুষ সিউলের গ্রামের বাড়িটি কিনেছিলেন। সেটিকে এখনো পরম যত্নে আগলে রেখেছেন কিহাক আর তার ভাইবোনেরা। সে বাড়ির পুরোনো স্থাপনা এখনও অক্ষত আছে। এটি ভালোভাবে সংরক্ষিত অন্যতম প্রাচীন কোরিয়ান বাড়ি বলে জানান কিহাক।
নিজের জীবনের সাফল্যের রহস্য বলতে গিয়ে কিহাক বলেন, 'কাজ করুন, কাজ করুন, কাজ করুন এবং সহজে হাল ছাড়বেন না। মাঝে মাঝে আমরা অল্পতেই হাল ছেড়ে দিই। তবে একবার শুরু করলেই আপনি এর শেষটা দেখে নিতে চাইবেন। অন্যদেরকে ভালো কাজের জন্য কৃতিত্ব দেওয়াটাও ভীষণ জরুরি। যত সমস্যাই থাকুক, কাজের মধ্যে থাকতে হবে।'
বাংলাদেশি শিল্পের একজন পৃষ্ঠপোষক কিহাক সাং কেইপিজেডের অনেক ভবনে বিভিন্ন শিল্প ফুটিয়ে তুলেছেন।
এছাড়া তিনি সোনারগাঁওয়ের শতবর্ষী বড় সদর বাড়ি পুনঃপ্রতিষ্ঠার খরচও দিয়েছিলেন।
'ওই বাড়িটি আমি চিনতাম। বাড়িটা যখন দেখি, তখন মনে হলো কিছু একটা না করলে এই বাড়ি যেকোনো সময় ধসে পড়তে পারে। পুরোনো জিনিসের সংস্কার করা বরাবরই আমার শখ। এতে আনন্দ পাই। এরকম সংস্কারের কাজ আমি প্রায়ই করি, সেগুলো তখন দেখার মতো হয়,' বলেন কিহাক সাং।