আমাদের গ্যাস মজুদ আছে আর মাত্র ১০ বছরের—তারপর কী হবে?
গত দুই দশকে কোনো নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হওয়ায় আগামী ১০ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ার মতো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
বর্তমানে দেশের ২২টি গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ ১০ লাখ কোটি ঘনফুট। সে তুলনায় বার্ষিক ব্যবহার বা চাহিদা হচ্ছে এক লাখ কোটি ঘনফুট।
গত এক দশকে ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে চাহিদা তথা ব্যবহার বেড়েছে। এরমধ্যে গ্যাসের বড় কোনো মজুদও আবিষ্কার না হওয়ায়, বাংলাদেশে স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন ইতোমধ্যেই লক্ষণীয়ভাবে কমছে। ফলশ্রুতিতে, জীবাশ্ম জ্বালানি উৎসটির ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং বেড়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি।
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি- পেট্রোবাংলার প্রদত্ত তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের দৈনিক ব্যবহার হচ্ছে ৩ হাজার ১২৬ মিলিয়ন ঘনফুট। এরমধ্যে ২ হাজার ২৮৪ মিলিয়নের যোগান আসছে স্থানীয় উৎস থেকে, বাকিটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি হচ্ছে।
২০২০ সালে, স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলি দৈনিক ২,৫৭০.৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন (উত্তোলন) করেছিল।
দুই বছরের ব্যবধানে, স্থানীয়ভাবে গ্যাস উৎপাদন প্রতিদিন ২৮৬.৪ মিলিয়ন ঘনফুট কমেছে। এবং ফলস্বরূপ, অভ্যন্তরীণ উৎসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যেকার ব্যবধান পূরণে এলএনজি আমদানিতে নির্ভরতা বাড়ছে।
কিন্তু, বৈশ্বিক বাজারে এলএনজির মূল্যে এখন দেখা যাচ্ছে অস্থিতিশীল প্রবণতা। ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি নিষিদ্ধ করছে, অথচ রাশিয়াই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ গ্যাস উৎপাদক। এসব ঘটনা বাংলাদেশের সামনে এরমধ্যেই দামি হয়ে ওঠা জ্বালানিটির সরবরাহ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমূহ বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সচল গ্যাসক্ষেত্রগুলির মজুদ ফুরিয়ে আসার সাথেসাথে নতুন গ্যাস বেসিন আবিস্কারে ধীরগতির অনুসন্ধান কাজ অশনি সংকেত, এটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় ব্যাঘাতের পূর্বাভাস।
তারা বলেছেন, "অবিলম্বে যদি একটি কঠোর গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম গ্রহণ করা না হয়, তাহলে তৈরি পোশাক কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সার কারখানাসহ গ্যাসভিত্তিক শিল্প অবকাঠামো হঠাৎ সরবরাহ কমে যাওয়ায় একটি বড় ধাক্কার সম্মুখীন হবে।"
গ্যাস অনুসন্ধান কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছেন, ভবিষ্যতে জ্বালানি সংকট অনুধাবন করে তারা অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বাড়াতে বহুস্তর বিশিষ্ট কর্ম-পরিকল্পনা নিচ্ছেন।
সমতল ভূমি ও উপকূলীয় এলাকায় অনুসন্ধান কাজের পাশাপাশি, তারা এখন পাহাড়ি এলাকায় গ্যাসের সন্ধানে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান।
গ্যাসের রিজার্ভ
২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরপিএস এনার্জি লিমিটেড-এর হিসাব, ও সম্প্রতি আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাওয়া ধারণা অনুযায়ী, দেশের ২৭টি বাণিজ্যিক গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসের মোট প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুদ ২৯.৫৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট।
তবে পেট্রোবাংলার উপাত্ত অনুযায়ী মোট গ্যাস মজুদের ২০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট ২০২১ সালের মধ্যে তুলে ফেলা হয়েছে।
বর্তমানে দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো প্রতি বছর প্রায় ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করে। এভাবে গ্যাস উৎপাদন হতে থাকলে কেবল আগামী ১০ বছর পর্যন্ত দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন করা যাবে।
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে যদি বড় কোনো গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া না যায়, তাহলে বিভিন্ন খাতের শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১,৫০০ টেক্সটাইল শিল্পকারখানা রয়েছে যেগুলো গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।
বিটিএমএ-এর সভাপতি মোহাম্মদ আলি খোকন বলেন, এ খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৬ শতাংশের বেশি আসে টেক্সটাইল ও সম্পর্কিত পণ্য থেকে।
তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়তে থাকায় টেক্সটাইল সেক্টরে শিগগিরই আরও আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ হবে বলে জানিয়েছেন বিটিএমএ সভাপতি। তবে তিনি আরও জানান, গ্যাস সংকট ও উত্তরোত্তর মূল্যবৃদ্ধির কারণে টেক্সটাইল সেক্টরে নতুন বিনিয়োগের উৎসাহ কমে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ এবং ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম বলেন, যদি নতুন কোন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করা না যায় তাহলে সামনে বাংলাদেশ একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
'আমাদের পুরো শিল্প অবকাঠামো গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তাই হঠাৎ করে গ্যাস সাপ্লাইয়ে সংকট দেখা দিলে তা-তে অর্থনীতিতে বিরাট বিপর্যয় ঘটতে পারে'- বলেন তিনি।
'তাই এখন থেকে চেষ্টা করলে সম্ভবত আগামী ছয় বছরের মধ্যে নতুন কয়েকটি ভালো মজুদের গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে,' বলেন বদরুল ইমাম।
গ্যাস রেশনিং-এও সংকটের থাবা
ঘনীভূত হওয়া গ্যাস সংকটের মাঝে সরকার বিভিন্ন খাতে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে শুরু করেছে।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকার সিএনজি স্টেশনগুলোতে দৈনিক চার ঘণ্টা করে গ্যাস রেশনিং শুরু করে, পরে তা ছয় ঘণ্টায় বৃদ্ধি করা হয়।
রমজান মাসে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার মধ্যেই গত ১০ এপ্রিল পেট্রোবাংলা নতুন একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ওই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, দেশের সব শিল্পকারখানায় ১৫ দিনের জন্য বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ থেকে রেশনে গ্যাস সরবরাহের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই ঘোষণার আওতায় পড়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাকের শিল্পকারখানাগুলোও।
রমজানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
পেট্রোবাংলার তথ্যউপাত্ত অনুযায়ী, দেশের মোট উৎপাদিত গ্যাসের ১৫ শতাংশ লাগে শিল্পখাতে। আর বিদ্যুৎখাতে দেওয়া হয় ৪৬ শতাংশ গ্যাস।
তবে বিদ্যুৎ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য গ্যাসের প্রয়োজনীয় সরবরাহ পাচ্ছেন না। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লোডশেডিং হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎখাতে প্রতিদিন ১,৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ খাত কেবল ১,০০০ থেকে ১ম১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পায়। এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড-এর কর্মকর্তারা।
১৩ বছরে ১৭ বিস্ফোরণ
গ্যাসের নতুন মজুদ খুঁজে পাওয়া ও নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজন বিস্ফোরণ ও কূপ খনন। যত বেশি বিস্ফোরণ, তত বেশি গ্যাস মজুদ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা।
প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের গ্যাস কূপ খননের কার্যক্রম প্রতি বছর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করেছে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন ৩৮৬টি কূপ খনন করেছে। ২০১৭ অর্থবছরে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০১-এ।
কিন্তু বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম খুবই নগন্য।
পেট্রোবাংলা'র তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত অনুসন্ধান কোম্পানিগুলো ও আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে কেবল ১৭টি কূপে বিস্ফোরণ কাজ চালিয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) ১৪টি কূপ খনন করেছে, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) তিনটি, ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) একটি করে কূপ খনন করেছে।
১৭টি কূপের মধ্যে সাতটি কূপ বাণিজ্যিকভাবে টেকসই হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে আনুমানিক মজুদের পরিমাণ খুব বেশি ছিল না।
সাধারণত, গ্যাস অনুসন্ধানের বৈশ্বিক সাফল্যের হার প্রতি সাত কূপে একটি। কিন্তু বাংলাদেশে এ অনুপাত প্রতি তিন কূপে একটি।
গ্যাস অনুসন্ধানে প্রায় দ্বিগুণ সাফল্যের হার থাকা সত্ত্বেও দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের কাজ এখনো যথাযথ মনোযোগ পায়নি।
বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান প্রচণ্ডভাবে উপেক্ষিত মন্তব্য করে বদরুল ইমাম বলেন, 'এত বেশি অনুসন্ধান-হার থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে কম গ্যাস অনুসন্ধান করা জায়গাগুলোর একটি।'
এ সমস্যা সমাধানে তিনি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করার পরামর্শ দেন।
পেট্রোবাংলা'র পরিকল্পনা কী?
গ্যাস সরবরাহের সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে পেট্রোবাংলা। গ্যাস উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে কেন্দ্র করে কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
পেট্রোবাংলা'র চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানান, তারা পুরনো হয়ে যাওয়া, শুকিয়ে যাওয়া, ও পরিত্যক্ত গ্যাসক্ষেত্রগুলো সংস্কার করার পরিকল্পনা করছেন।
'এ প্রক্রিয়ায় জাতীয় গ্রিডে আরও ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যোগ করা যাবে বলে আমরা অনুমান করছি,' তিনি বলেন।
এছাড়াও দেশের পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রে গভীর খননকাজের পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে পেট্রোবাংলা।
এগুলোর মধ্যে দুইটি বাপেক্স-পরিচালিত মোবারকপুর ও শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রে খনন করা হবে। অন্য দুটি খনন হবে, বিজিএফসিএল-পরিচালিত তিতাস ও বাখরাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে। বাকি একটির অবস্থান এসজিএফএল-এর রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রে।
'পাশাপাশি আমরা পার্বত্য অঞ্চলে জরিপ চালাচ্ছি। এটি এ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। ওসব স্থানে গ্যাসের সম্ভাবনা দেখা গেলে আমরা কূপ খনন শুরু করব,' বলেন নাজমুল আহসান।
অনুসন্ধানের পাশাপাশি বিদেশ থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিরও পরিকল্পনা রয়েছে পেট্রোবাংলা'র।
সরকার মহেশখালী ও পায়রাতে আরও দুইটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়া মাতারবাড়ীতে একটি ভূমি-ভিত্তিক এলএনজি টার্মিনালও স্থাপন করা হবে। এসব তথ্য জানিয়েছেন পেট্রোবাংলা'র চেয়ারম্যান।
সাগরের মধ্য দিয়ে এলএনজি পরিবহন ও স্থানান্তরের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো- এফএসআরইউ।