এখনও উচ্চ বিমান ভাড়ার সবচেয়ে বেশি মূল্য অভিবাসী কর্মীদেরই দিতে হচ্ছে
২০২০ সালে করোনা মহামারির প্রকোপ বাড়লে বিশ্বজুড়ে ফ্লাইট বাতিলের হিড়িক পড়ে। প্রভাবিত হন বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন ইচ্ছুক কর্মীরাও। দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার মধ্যপ্রাচ্যগামী বাংলাদেশি কর্মীরাও তখন গন্তব্য দেশগুলোয় যেতে পারেননি। এরপর ফ্লাইট সচল হলে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন এবার বিদেশ যাত্রা সহজ হবে।
কিন্তু, সে স্বস্তি ছিল সাময়িক।
মহামারিকালে অনেক গন্তব্য দেশ কোভিড নেগেটিভ সনদ থাকা বাধ্যতামূলক করে। ফলে যাওয়ার উপায় সহজ ছিল না। এয়ারলাইনসগুলোর সেলস অফিসের সামনে দীর্ঘ লাইন ধরে অপেক্ষার পর অনেকেই আবিষ্কার করেন কিছুক্ষেত্রে বিমানের টিকেটের দাম দ্বিগুণ বা তিনগুণ হয়ে গেছে।
ওই দুঃসময়ের দুই বছর পর বর্তমানে বিমান ভাড়া উল্লেখযোগ্যভাবে কমলেও, এখনও অবস্থান করছে মহামারি-পূর্ব সময়ের চেয়ে বেশি মূল্যে।
যেমন আগে ঢাকা-দাম্মাম যাত্রায় টিকেটের দাম ছিল ৩৯ থেকে ৪২ হাজার টাকার মধ্যে, মহামারির সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব চলাকালে যা পৌঁছে যায় ৮০-৯০ হাজার টাকায়।
বর্তমানে এই ভাড়া ৫৫ থেকে ৫৮ হাজার টাকার মধ্যে রয়েছে, আর কমারও কোনো লক্ষণ নেই।
ঢাকা-দুবাই ও ঢাকা-মাস্কট রুটেও ভাড়ার অবস্থা তথৈবচ। উভয় রুটেই মহামারি কালে ভাড়া বেড়েছিল, তারপর সামান্য কমলেও এখনও রয়েছে মহামারি-পূর্ব সময়ের চেয়ে বেশি মূল্যে।
ভাড়া কমে মহামারি-পূর্ব সময়ের সমান হয়েছে কেবল ঢাকা-দোহা রুটে।
কিন্তু, সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে সৌদি আরবগামী অভিবাসী কর্মী ও অন্য যাত্রীদের।
ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও কুয়েতের ফ্লাইটে টিকিটের দাম মহামারিকালের উচ্চ অবস্থান থেকে কমলেও; সেই স্বস্তির অবকাশ পাচ্ছেন না সৌদিগামী যাত্রীরা, যদিও তারাই বাংলাদেশের অভিবাসী কর্মী জনসংখ্যার সিংহভাগের প্রতিনিধিত্ব করেন।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ৩ লাখ ২২ হাজার বাংলাদেশি বিদেশে গেছেন, যাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ সৌদি আরবে কাজ পেয়েছিলেন।
ট্রাভেল এজেন্টরা বলেছেন যে, সৌদি আরবের জন্য বিমান ভাড়া তখনও বেশি ছিল, কারণ অনেকে ওমরাহ পালন করতেও সেদেশে যাচ্ছে। এতে টিকেটের চাহিদা বাড়ায় দামও বেড়েছে ।
ট্রাভেল এজেন্সি হক ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মাহমুদুল হক পিয়ারু বলেন, "রিয়াদগামী ফ্লাইটের একটি টিকিটের দাম মহামারির আগের সময়ে ৩০-৩৬ হাজার টাকা ছিল, কিন্তু ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার পরে মূল্য ৯০ হাজারে পৌঁছে। এখন তা ৭০ হাজার টাকায় নেমে এসেছে।"
"ঢাকা-দুবাই টিকিটের দাম কমে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা, করোনাজনিত ফ্লাইট ঘাটতির মধ্যে ছিল ৭০-৮০ হাজার টাকা। অথচ মহামারির আগে এ রুটে বিমান ভাড়া ছিল ৩৬ হাজার টাকা"- যোগ করেন তিনি।
পিয়ারু উল্লেখ করেন যে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফ্লাইট সংখ্যা বাড়ার কারণে টিকেটের উচ্চমূল্য অনেকটা কমে এসেছে।
"যেমন ধরুন, আগে বাংলাদেশ বিমান দিনে সৌদি আরবগামী পাঁচটি ফ্লাইট পরিচালনা করতো। এখন তারা দিনে সাতটি করছে। সৌদি এয়ারলাইন্সও এ রুটে দিনে সাতটি ফ্লাইট পরিচালনা করছে"- তিনি আরও জানিয়েছেন।
শান্তা ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন বলেন, "রমজানের পর ওমরাহ মৌসুম শেষ হবে। আমরা আশা করছি, তখন সৌদি আরবের রুটে বিমান ভাড়া মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য গন্তব্যের মতো কমবে।"
সারা বছর ওমরাহ পালন করা গেলেও বাংলাদেশ হজ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশনের মতে, এদেশ থেকে বেশিরভাগ ওমরাহ যাত্রী নভেম্বর-এপ্রিল মাসেই সৌদি আরব যান।
সাধারণত রমজানে প্রায় ১ লাখ হজযাত্রী ওমরাহ পালন করেন।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, রজব, শাবান এবং রমজান মাসে প্রায় ৪৩ শতাংশ হজযাত্রী সৌদি আরবে যান।
মহামারির প্রভাবে শুরু হওয়া ফ্লাইট স্থগিতাদেশের কয়েক মাস পর, বিমান ভ্রমণ পুনরায় শুরু হওয়ায় ২০২০ সালের শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্যের রুটগুলোয় বিমান ভাড়া বাড়তে শুরু করে।
ট্র্যাভেল এজেন্টদের মতে, সমস্ত স্থানীয় এবং বিদেশি এয়ারলাইনস যারা এসব রুটে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করে, তারা টিকিটের মূল্য দ্বিগুণ বা তিনগুণ বাড়িয়েছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের বিমান ভাড়া অপরিবর্তিত রয়েছে।
এয়ারলাইন কর্তৃপক্ষগুলো অবশ্য কম সংখ্যক ফ্লাইট, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, রিটার্ন-টিকিটধারীদের কম সংখ্যা, পর্যটকদের চলাচল কমা এবং সাধারণ পরিচালন ব্যবস্থা বজায় রাখার বাধ্যবাধকতাকে তাদের পরিচালন খরচ বৃদ্ধির সাথে যুক্ত করেছে, যার ফলে টিকিটের দাম বেড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনাকারী প্রধান এয়ারলাইনগুলো হলো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, এমিরেটস, ফ্লাই দুবাই, এয়ার এরাবিয়া, ওমান এয়ার, ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স, সালাম এয়ার ইত্যাদি।
গত মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিমান ভাড়া কমেছে ৩৮ থেকে ৫৮ হাজার টাকা পর্যন্ত।
বিমানের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের বিমানভাড়ার ওপর
মহামারি শুরুর আগে ঢাকা থেকে যশোরের বিমানভাড়া ছিল ২ হাজার ৭০০ টাকা। একই টিকিটের দাম এখন ৫ হাজার টাকা হয়েছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জেট ফুয়েলের দাম বাড়ার কারণেই বিমানভাড়াও বেড়েছে।
গত দেড় বছরে জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে ১১৭ শতাংশ। এতে এয়ারলাইনগুলোর উপর খরচের চাপ বেড়েছে। এই চাপ সামাল দিতে বাড়ানো হয়েছে টিকিটের দাম।
২০২০ সালের অক্টোবরে জেট ফুয়েলের দাম বাড়তে শুরু করে। ওই মাসে প্রতি লিটার জ্বালানির দাম ছিল ৪৬ টাকা। আরও ১৩ টাকা মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার পর, গত ৬ এপ্রিল প্রতি লিটার জ্বালানির দাম ১০০ টাকায় পৌঁছেছে।
অর্থাৎ, ১৮ মাসের ব্যবধানে বিমানের জ্বালানির দাম বেড়েছে ৫৪ টাকা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) তথ্যমতে, গত ১৮ মাসে বিমানের জ্বালানির দাম ১৪ বার বেড়েছে। গত তিন মাসে তা বেড়েছে ২৫ টাকা।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র মো. কামরুল ইসলাম বলেন, "টিকিটের দাম বাড়িয়ে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সমন্বয় করতে হবে। জেট ফুয়েলের দাম বাড়ার কারণে প্রতিটি অভ্যন্তরীণ রুটে ভাড়া বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।"
তিনি আরও বলেন, "ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে জেট ফুয়েলের দাম বেড়েছে। কিন্তু গত ১৮ মাস ধরেই দেশে নন-স্টপ জেট ফুয়েলের দাম বাড়ছে। করোনা মহামারি চলাকালে সবকিছু বন্ধ থাকলেও, জেট ফুয়েলের দাম আকাশচুম্বী হয়েছিল।"
বিমান চলাচল খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে দেশের অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের ওপর। দেশীয় বিমান সংস্থাগুলো বিদেশি বিমান সংস্থাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। আর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব শেষপর্যন্ত যাত্রীদের উপর পড়বে।
নভো এয়ারের হেড অব সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং মেসবাহুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, ঈদের আগে প্রচুর চাহিদা থাকায় টিকিটের দাম আরও বেড়েছে।
"কিছু রুটে বিমানভাড়া ছিল ৫ হাজার ১০০ টাকা, কিন্তু এখন সেটি প্রায় ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা," বলেন তিনি।
ঈদের জন্য অভ্যন্তরীণ রুটের প্রায় ৮০ শতাংশ বিমানটিকিট ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে।