ডলার সংকটে শুধুমাত্র ব্যাংকগুলোই কি লাভবান হচ্ছে?
মার্কিন ডলারের ঊর্ধ্বমুখী মিছিল অব্যাহত রয়েছে, সোমবার (১৬ মে) আন্তঃব্যাংক লেনদেনে মুদ্রাটির বিপরীতে ৮০ পয়সা কমেছে টাকার মান। ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলার কেনাবেচার দরে যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, তাতে লাভবান হচ্ছে ব্যাংকগুলোই ।
বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির সময়ে যখন গোটা দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে, তখন কিছু ব্যাংক আমদানিকারকদের কাছে উচ্চমূল্যে এবং রপ্তানিকারকদের কাছে কম দামে ডলার বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে আনুষ্ঠানিক দর ৮৭.৫০ হলেও ডলার সংকটের অজুহাত দিয়ে, আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খুলতে প্রতিডলারে ৯৫-৯৭ টাকা দর নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু, রপ্তানিকারকদের অর্জিত ডলার লেনদেনের সময় আনুষ্ঠানিক দরই দিচ্ছে তারা।
দেশের আপামর ভোক্তারা যখন আমদানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির শিকার ঠিক তখনই এভাবে আমদানি ও রপ্তানিতে দেওয়া দর ব্যবধানের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করছে ব্যাংকগুলি।
শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, স্থির ঋণের হারও মূল্য নির্ধারণে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছে। এটি ডলার সংকটের মধ্যে ব্যাংকগুলিকে অযৌক্তিক ব্যবসা করতে প্ররোচিত করছে- কারণ তারা ক্রমবর্ধমান ঋণের চাহিদার সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে ঋণের হার বাড়াতে পারেনি।
ঋণে ৯ শতাংশের এক অঙ্কের সুদহার আমদানিকারকদের আরও এলসি খুলতে উৎসাহ দিচ্ছে, তাতে ডলার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী।
এই পরিস্থিতিতে বাজার দর ও আনুষ্ঠানিক দরের মধ্যে ব্যবধান কমাতে টাকার মান কমাচ্ছে বাংলাদেশ।
অতি-সাম্প্রতিক পদক্ষেপে সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৮০ পয়সা কমায়, ২০ দিনের মধ্যে যা ছিল স্থানীয় মুদ্রার তৃতীয়বার অবমূল্যায়নের ঘটনা।
এতে এদিন আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের বিনিময় মান বেড়ে হয় ৮৭.৫০ টাকা, যা আগের দিন ছিল ৮৬.৭০ টাকা। বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্যেই এ চিত্র দেখা গেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যবসা খাত ও ভোক্তারা
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, চলমান ডলার সংকটে ব্যাংক ছাড়া বাকি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ; আমদানির অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে ডলারের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক-নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি টাকা দিতে হবে। অথচ ব্যবসায়ীরা তাদের রপ্তানি আয়ের মূল্য পাচ্ছেন নির্ধারিত হারে। এছাড়া, ডলারের বিপরীতে বর্ধিত হারে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স আয় পাচ্ছেন না বলেও জানান তিনি।
ব্যবসায়ীদের প্রতিডলার কিনতে প্রায় ৯৫ টাকায় আমদানি এলসি খুলতে হয়। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে ডলারের দামের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ব্যাংকগুলো ডলার ঘাটতির সুযোগে মুনাফা লুটছে।
আমদানি এলসি খোলার অতিরিক্ত ব্যয় শেষপর্যন্ত ভোক্তাদের কাছে চলে যাবে, যা মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দেবে বলে উল্লেখ করেন মোহাম্মদ হাতেম।
লিটল স্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, 'ডলার সংকটের কারণে আমরা বেশি হারে এলসি খুলতে বাধ্য হচ্ছি।'
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, 'আমরা অনেক সময় পুরো খরচের বোঝা ভোক্তাদের ওপর দিতে পারি না। সুতরাং, আমাদের লাভের মার্জিন কমাতে হবে।'
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কিছুসংখ্যক ব্যাংকই শুধু ডলার সংকটকে পুঁজি করে আয় করছে, সবাই নয়। ঋণদাতারা গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কের ভিত্তিতে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের ডলারের দাম অফার করে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ব্যাংকগুলি বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরকদের থেকে চড়া দামে ডলার কিনছে। এক্ষেত্রে একটি বেসরকারি ব্যাংকের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, প্রতি ডলার ৯৫ টাকা দেওয়ার পরও তারা রেমিটরদের কাছ থেকে ডলার পাচ্ছে না।
নাম না প্রকাশের শর্তে আরেক ব্যাংকার বলেন, আমদানিকারকরা প্রতিডলারের বিপরীতে ৯৫টাকায় ব্যয় মেটাচ্ছেন, ইতোমধ্যেই তা মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলেছে। তাই সেই হারে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে মুদ্রাস্ফীতির উপর আর কোন প্রভাব পড়বে না; বরং এটি অন্যায্য ব্যবসায়িক চর্চা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে এবং রপ্তানিকারকদের লাভবান করবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন শীর্ষ নির্বাহী বলেন, এটা কিছুটা সত্য যে কিছু ব্যাংক ডলার সংকটের সুযোগ নিয়ে মুয়াফা করছে। ছোট রপ্তানিকারকরা যাদের দর কষাকষির ক্ষমতা নেই, তারাই এতে লোকসানের শিকার হচ্ছে।
অন্যায্য অনুশীলন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুদ্রাবাজারে বিক্রয় এবং ক্রয় মূল্যের মধ্যে একটি আদর্শ সীমা অবশ্যই থাকা উচিত।
তবে ডলারের আমদানি-রপ্তানি হারের ব্যবধানের দাবিকে অস্বীকার করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন,গত সপ্তাহে একজন রপ্তানিকারক প্রতিডলার ৯৩ টাকায় এক মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি নিষ্পত্তি করেছেন। কিছু ছোট রপ্তানিকারক কম দাম পেতে পারে কারণ ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অর্থ প্রদানের নিষ্পত্তি হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পায়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অবস্থা:
সোমবার (১৬ মে) আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতিডলার কিনতে খরচ করতে হয়েছে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। একদিন আগেও এক ডলার কিনতে লাগত ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। আর গত ১০ মে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা এবং ২৭ এপ্রিল ছিল ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আন্তঃব্যাংক ইউরো বিনিময় হার ৮৩ পয়সা বাড়িয়ে ৯১.০৩ টাকা করেছে।
ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছে নগদ ডলার বিক্রি করেছে এর ৫-৭ টাকা বেশি দরে। বেশিরভাগ ব্যাংক বিক্রি করেছে ৯০-৯২ টাকায়। ব্যাংকের বাহিরে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলার কেনাবেচা হয়েছে ৯২- ৯৩ টাকায়।
বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যের অস্থিতিশীলতা আগেই ছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর তা চরম রূপ নেওয়ায় আমদানির মূল্য বেড়েছে- সেকারণেও মার্কিন ডলারের বিপরীতে মান হারাচ্ছে স্থানীয় মুদ্রা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের রপ্তানি আয়ের তুলনায় আমদানি বেশি, এ কারণে ডলারের উপর চাপ পড়েছে।' বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে আমরা ডলারের বিনিময় হার ৮৭.৫০ টাকা নির্ধারণ করেছি।'
ঈদের সময়ে রপ্তানি বাড়ছিল, এসময় ২০০ মিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসে। এর সঙ্গে ব্যাংকগুলোর চাহিদা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ করছে। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর চাহিদার বিপরীতে ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি দামে ডলার বিক্রির বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র বলেন, প্রয়োজন অনুযায়ী ডলার না পাওয়ায় ব্যাংকগুলোকে খোলা বাজার থেকে বেশি দামে ডলার কিনতে হচ্ছে।
'আমরা আশা করছি, এটি কয়েকদিনের মধ্যেই সমন্বয় হয়ে যাবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বাজার বিবেচনায় ডলারের দর আরও বাড়ানো উচিত। অদূর ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা বাড়িয়ে ৯০ টাকা করবে।
"কিন্তু যে হারে রেমিট্যান্স আমাদের কাছে আসছে তাতে রিজার্ভ আরও কমে যাবে। এক্ষেত্রে আমাদের আমদানি প্রতিস্থাপনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে এবং প্রবাসীদের আরও দক্ষ করে তুলতে হবে" - যোগ করেন তিনি।
চাপের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ
আমদানি বৃদ্ধির কারণে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি শুরু করে। গত ১২মে পর্যন্ত ব্যাংকগুলিকে ৫.১১ বিলিয়ন ডলার দেয়। সে তুলনায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে, ব্যাংকিং খাত থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার কেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরমধ্যেই, মহামারি পরবর্তী সময়ে আমদানি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আরও বেশি অর্থ দিতে হচ্ছে, একারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপের সম্মুখীন হচ্ছে।
বাংলাদেশের ফরেক্স রিজার্ভ, গত বছরের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, গত ১১ মে নাগাদ তা ৪১.৯৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ মাসে, রপ্তানি প্রায় ৩৩ শতাংশ বাড়লেও তা বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যকে ধরে রাখতে পারেনি, এসময় ঘাটতি হয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের পুরো অর্থবছরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
সাম্প্রতিক মাসগুলিতে রেমিট্যান্সে কিছুটা প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের চলতি হিসাব নেতিবাচকের ঘরেই অবস্থান করছে।