বিদ্যুতের পাইকারি মূল্য প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে
জীবনযাপনের খরচ দিন দিন আকাশচুম্বী। তাতেই শোচনীয় দশা আপামর ভোক্তাদের। তার ওপর আরেক আঘাত হিসেবে পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
এর আগে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বিদ্যুতের দাম ৬৫.৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি চেয়েছিল।
রেকর্ড মূল্যস্ফীতি, স্থানীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন ও তরল জ্বালানির দাম বৃদ্ধির মতো একাধিক চাপে ভোক্তারা যখন অতিষ্ঠ; ঠিক তখনই এলো বিদ্যুতেরও মূল্যবৃদ্ধির এ সুপারিশ।
বুধবার (১৮ মে) এক গণশুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি বলেছে, জ্বালানি তেলের ও কয়লার মূল্যবৃদ্ধি এবং অনান্য খরচের কারণে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রতিইউনিট উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তারা মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।
তবে পোশাক পণ্য প্রস্তুতকারক, ভোক্তা এবং ব্যবসায়িক জোটগুলোর প্রতিনিধিরা- এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, এই পদক্ষেপ অযৌক্তিক; কারণ এতে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়নি।
তারা বিপিডিবির রাজস্ব ঘাটতি কমাতে উচ্চমূল্যের তরল জ্বালানি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বদলে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক এমন স্বল্পমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
কিউট ড্রেস ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ এইচ এম মোস্তাফিজ বলেন, "একটি পোশাক কারখানার মোট পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৪ শতাংশ বিদ্যুৎ বিল হিসেবে ব্যয় করতে হয়। প্রস্তাবিত হারের বাস্তবায়ন এ শিল্পকে আরও চাপের মুখে ফেলবে; কারণ প্রায় সমস্ত কাঁচামালের দাম ইতোমধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে এবং পরিবহন খরচও প্রায় তিন থেকে চার গুণ বেড়েছে।"
"এই অবস্থায় শিল্পটি টিকে থাকার ব্যাপারেই আমরা অনিশ্চিত"- যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, সময়মতো বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে না পারায় বিদ্যুৎ সরবরাহকারীরা ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে।
এই অবস্থায় "বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এ শিল্পে বিপর্যয় ডেকে আনবে। বিপুল সংখ্যক কারখানা সেই বোঝা বহন করতে পারবে না।" বিদ্যুৎ খরচ বাড়লে বেশ কিছু শিল্প বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলেও যোগ করেন হাতেম।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি শুধুমাত্র পোশাক শিল্পের ওপর আর্থিক বোঝা বাড়াবে। এতে নতুন বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করা হবে।
এরমধ্যেই গ্যাস সংযোগের অভাব এবং এর প্রস্তাবিত মূল্যবৃদ্ধি উদ্যোক্তাদের চাপের মধ্যে ফেলেছে বলেও উল্লেখ করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।
গণশুনানিতে বক্তৃতাকালে, মোতাহার গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, একটি শিল্প তার ব্যবসা থেকে গড়ে ১০-২০ শতাংশ মুনাফা করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিবহন খরচ, খাদ্য এবং খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বাড়ায় লাভের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে।
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি কারখানা মালিকদের পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য করবে, যার ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলেও তিনি সতর্ক করেন।
এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের সাময়িক মূল্যবৃদ্ধির পর পরই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। "এর পরিবর্তে, বিপিডিবি'র উচিত পাওয়ার সেক্টর ফান্ড দিয়ে সাময়িক ঘাটতি মেটানো।"
রাজস্বে ঘাটতি কমাতে তিনি বিপিডিবিকে অতিরিক্ত ক্ষমতা কমাতে, অকার্যকর পুরানো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি বন্ধ করার পাশাপাশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির নির্মাণকাজ শেষ করার পরামর্শ দেন।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলমও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে বিপিডিবির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানোর পরিবর্তে বিপিডিবি তেল ও কয়লার ওপর বিভিন্ন কর মওকুফ করে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে এবং কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টের প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর বাড়ানোর মাধ্যমে রাজস্বে ঘাটতি সমন্বয় করতে পারে।
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বিশ্বে এত বেশি দাম বাড়ানোর উদাহরণ আর নেই।
বিপিডিবিকে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোর পরামর্শ দিয়ে অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, "আপনি যদি বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল ব্যবহার করেন, তার মানে আপনি সংকটে পড়েছেন।"গ্রাহকদের সুবিধার জন্যবিদ্যুৎ বোর্ডের সাশ্রয়ী মূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার করা উচিত।"
মেট্রোপলিটন চেম্বার অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) প্রাক্তন সভাপতি নিহাদ কবির অবশ্য একলাফে এতোটা দাম বাড়ানোর পরিবর্তে, ছোট আকারে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
গণশুনানির শুরুতে বিপিডিবির মহাব্যবস্থাপক (কমার্শিয়াল অপারেশন) সিএফকে মোসাদ্দেক আহমেদ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
পাওয়ার পয়েন্টে প্রস্তাব উপস্থাপনাকালে তিনি বলেন, চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না হওয়ায় তেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রতিইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন মূল্য ছিল ২.১৩ টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে ৩.১৬ টাকা হয়েছে।
জ্বালানি তেলের দাম এবং কয়লার ভ্যাট বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ৪.২৪ টাকা হবে। এ বাস্তবতায় পাইকারি দাম না বাড়লে বিপিডিবি এ বছর ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তবে, বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি দেখেছে যে, সরকারি ভর্তুকি বাদ দিলে বিপিডিবিকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রি করে ৮.১৬ টাকা আয় করতে হবে।
তেল ভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো থেকে বিপিডিবির প্রতিইউনিট বিদ্যুৎ কেনার খরচ ৩-১৬ টাকা পর্যন্ত, এবং কিছুক্ষেত্রে আরও বেশি।
এই উচ্চমূল্যে কিনে কমদামে বিক্রির কারণে বিপিডিবি ক্রমাগত লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছে, সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে এই লোকসান পূরণ করতে হচ্ছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে সরকার বিপিডিবিকে ৪,৫১১.৯০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৭৭.৯১ কোটি টাকায় উন্নীত হয়৷
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের নির্বাহী সম্পাদক একেএম আসাদুজ্জামান পাটোয়ারী বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে।
"সাধারণত, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ থেকে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ মুনাফা পেতে চায়। কিন্তু, সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়ালে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ হারাবে," বলেন তিনি।
ঢাকার বিয়াম অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে সভাপতিত্ব করেন বিইআরসি চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জলিল। সমাপনী মন্তব্যে, তিনি সকলের জন্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং সহনশীল সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশ্বাস দেন।