বাজার স্থিতিশীল রাখতে একমাসে ডলারের দাম বাড়ল তিনবার
দেশে কোভিড পরবর্তী অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে রপ্তানির তুলনায় আমদানি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি ও যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম ক্রমবর্ধমান বাড়তে থাকায় দেশের বাজারে ডলারের চহিদা বাড়ছে। ডলার বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চলতি মে মাসে তৃতীয়বারের মত ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সোমবার আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের বিনিময় হার আরও ৪০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭ টাকা ৯০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
রোববার পর্যন্ত প্রতি ডলার বিনিময় হয়েছিল ৮৭ টাকা ৫০ পয়সায়। এই হার নির্ধারিত হয়েছিল গত ১৬ মে। তার আগের সপ্তাহে ৯ মে ডলারের বিনিময় মূল্য ২৫ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। তার আগে এই বিনিময় হার ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, কোভিড পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর থেকে সকল ধরনের পণ্যে বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়ায় পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় খরচ বেড়ে যায়। তাতে ডলারের চাহিদাও বাড়তে থাকে। ফলে বিশ্বের অনেক দেশের মত বাংলাদেশের মুদ্রা টাকাও ডলারের বিপরীতে দর হারাতে থাকে।
শুধু আন্তঃব্যাংক লেনদেনেই ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে ৩ শতাংশের বেশি। গত বছরের এপ্রিলে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। জুনে তা এক পয়সা বাড়লেও আগস্ট থেকে টাকার মান দ্রুত কমতে থাকে।
এ বিষয়ে বেসরকারি একটি ব্যাংকের ট্রেজারি হেড দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, 'মার্কেটে সাপ্লাইয়ের তুলনায় ডিমান্ড বেশি তাই প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে ডলারের দাম বাড়ছে। গত সপ্তাহে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ পরিমাণে মার্কেটে ডলার সাপোর্ট দিয়েছে যার ফলে কিছুটা স্টেবল (স্থিতিশীল) ছিল। এই সাপোর্ট নিয়মিত না করলে মার্কেটে প্রেশার বাড়বেই।'
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষ করে প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলোকে ডলার দিয়ে থাকে তবে তা পরিমাণে খুবই কম তাই ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংক থেকে উচ্চমূল্যে ডলার কিনতে হচ্ছে। এর কারণে এলসি খুলতে গিয়ে তাদের কেনা দামের চেয়েও ৩০/৫০ পয়সা বেশি রাখছে। তাই অতিরিক্ত ডলার মূল্য থাকায় সোমবারও ব্যবসায়ীদের ৯৬-৯৭ টাকায় এলসি খুলতে হয়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এলসি খোলার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলোর কাছে পর্যাপ্ত ডলার পাচ্ছে না। তাই আন্তঃমন্ত্রণালয় চলতি বাজার রেট অনুযায়ী ডলার কিনে জ্বালানি তেলের বিল পরিশোধ করতে বলা হয়। প্রতিষ্ঠানটিও গত মাসের ২৬ তারিখ রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে।
আন্তঃব্যাংকের ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাগুজে ডলারের দরও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে কাগুজে ডলার কিনতে সোমবার ৯৮ দশমিক ২০ টাকা গুনতে হয়েছে ক্রেতাদের। এর আগে গত ১৭ মে খোলা বাজারে ডলারের দাম ১০২ টাকায় উঠেছিল।
খোলাবাজারে (কার্ব মার্কেট) ডলার আসে মূলত বিদেশফেরত প্রবাসী কর্মী ও পর্যটকদের কাছ থেকে। সঙ্গে করে নিয়ে আসা ডলার অনেকে বিক্রি করে দেন মানি চেঞ্জারগুলোর কাছে। আবার বিদেশগামীরা প্রয়োজনে ডলার কিনে নেন এসব প্রতিষ্ঠান থেকে।
এদিকে কোভিডকালে আমদানির পরিমাণ কম ও রেমিট্যান্সের উপর ভর করে গত বছরের আগস্টে দেশের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে আমদানির পরিমাণ বাড়তে থাকায় দেশের রিজার্ভের পরিমাণ কমতেছে। মার্কেটের চাহিদা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার। আজ সোমবারও ১৩০ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। এখন দেশের রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২ বিলিয়ন ডলার। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছরে, ব্যাংকিং খাত থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার কেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ মাসে, রপ্তানি প্রায় ৩৩ শতাংশ বাড়লেও তা বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যকে ধরে রাখতে পারেনি, এসময় ঘাটতি হয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের পুরো অর্থবছরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিট্যান্সে কিছুটা প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও ঘাটতি ১৪ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়ায় দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের চলতি হিসাবের নেতিবাচকের ঘরেই অবস্থান।