সরকারকে পরিচালন বাজেটে ঋণের অপচয় রোধ করতে হবে
সরকারের ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। তবে এ ঋণ পরিচালন বাজেটে ঋণের অপচয় হিসেবে দেখানো হয়, যেটি কমাতে হবে। একইসঙ্গে সরকারের ব্যাংক ঋণের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করলে দেশের অর্থনীতিতে আরও অগ্রগতি আসবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
শনিবার (৪ জুন) বিআইবিএম সার্টিফাইড ব্যাংকার্স অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনস (বিসিবিএএ) আয়োজিত ওয়েবিনারে অর্থনীতিবিদরা এসব কথা বলেন। ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বিসিবিএএর সদস্য সচিব মোঃ মাজেদুল হক।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলো সরকারকে ঋণ দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তারা ক্ষুদ্র ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। এটি আসলে আমাদের দেশের জন্য ক্ষতি। কারণ, সরকারকে ঋণ দিলে সহজেই মুনাফা করতে পারে ব্যাংক। অল্প পরিশ্রমে লভ্যাংশ পাওয়া যায়। কিন্তু এসএমই ঋণ দিলে ব্যাংকের পরিশ্রম বেশি হলেও কর্মসংস্থান তৈরি হয়। যেটি দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য কল্যাণকর কিন্তু সেখাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণে গড়িমসি করে।
তিনি আরও বলেন, "সত্যিকার অর্থেই আমাদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। তবে লক্ষ্য করতে হবে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু। অনেক দেশ ঋণ নেওয়ার জন্য প্যাডেল (উদ্বুদ্ধ) করবে। মেগা প্রকল্পের জন্য ঋণ দিতে চাইবে। তবে বিষয়গুলো সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলা করা উচিৎ। প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ নিয়ে তার ব্যবহার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। অপচয় রোধ করতে হবে।"
সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরের আসন্ন জাতীয় বাজেটে ঘাটতি মোকাবেলায় দেশের বিভিন্ন উৎস থেকে ১ লাখ ৪১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মোট ১ লাখ ৪১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকার মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা আসবে ব্যাংকিং খাত থেকে এবং বাকি ৪০ হাজার কোটি টাকা সঞ্চয়পত্র সহ অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
সাবেক গভর্নর বলেন, "চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে সরকার ঋণ নিয়েছে ৩৪ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মানে সরকারের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তবে আমাদের ঘাটতি মেটানোর জন্য রাজস্ব আয় যথেষ্ট ছিল না। এটি আরও বাড়াতে হবে।"
বৈদেশিক ঋণের বিষয়ে সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, "আমাদের বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করতে হবে। শ্রীলঙ্কার মতো যেন না হয়। মেগা প্রকল্পগুলো বৈদেশিক ঋণ নিয়েই যে করতে হবে, সেখানেও চিন্তার প্রয়োজন আছে। যেমন- পায়রা বন্দর ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এগুলো অনেকটা বিদেশি ঋণের মাধ্যমে হচ্ছে। এ প্রকল্পের ব্যয়ের বিষয়টিও দেখতে হবে আমাদের ভবিষ্যতের বোঝা হয়ে যাচ্ছে কিনা। কারণ ডলারের দাম ৮০ থেকে যখন ১২০ হবে, আমাদের চাপ কী পরিমাণে বাড়বে সেটা বোঝাই যাচ্ছে।"
জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, "ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিলে মনিটরি পলিসি (মুদ্রানীতি) দুর্বল হয়ে পড়ে। বাজেটে নির্ধারিত অনেক অর্থ অপচয় হয়। এটি কমাতে হবে।
এগুলো কামানো গেলে বাজেট আরও বাস্তবিক হবে, আর্থিকব্যবস্থা আরও উন্নত হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানিত ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "এবারের বাজেটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ভর্তুকি। এই ভর্তুকি সরকার নিজের ঘাড়ে নিচ্ছে নাকি জনগণের ঘাড়ে দিচ্ছে সেটিই বিবেচ্য বিষয়। সরকার যদি নিচের ঘাড়ে নিয়ে থাকে তাহলে ঘাটতি বাজেট আরও বাড়বে।"
তিনি বলেন, "আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে ঋণের গ্রোথ বাড়ছে, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরি পলিসির লক্ষ্যমাত্রার থেকেও কিছুটা কম রয়েছে। গত এপ্রিলের প্রাইভেট সেক্টরের ক্রেডিট গ্রোথ প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ, যা কোভিডের আগে ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ। এর মানে হচ্ছে, ঋণের চাহিদা বাড়ছে। এখন ডলারের দাম বেড়েছে তার মানে হচ্ছে ঋণের চাহিদা আরও বাড়বে।"
তিনি বলেন, "করোনার সময়ে আমরা লক্ষ্য করেছি ব্যাংকগুলো প্রণোদনার ক্ষুদ্র ঋণ দিতে আগ্রহী নয়। কিন্তু এখানেই বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়। বারবার সতর্ক করেও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণে শতভাগ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি কোনো ব্যাংক।"
কিন্তু পোশাক খাতে বৃহৎ ঋণ ঘোষণার পরপরই বিতরণ শেষ। বিষয়গুলো সবই বাজেটের আগে বিবেচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের ঘাটতি বাজেট এবং ব্যাংক ঋণ সার্বিক দিক বিবেচনা করে দেখতে হবে। বোর্থ ইনটার্মস অফ সোসিং, ইনটার্মস অফ ইউসিং, ইনটার্মস অফ রিটার্ন এসপেক্টটস থেকে দেখলে তাহলে অর্থনীতিতে অগ্রগতি দেখতে পাবো।"
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের উপদেষ্টা ড. এম এস সিদ্দিক বলেন, "সরকারের ঋণ গ্রহণ হল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমি বলবো সরকার অনেক বেশি ভর্তুকি দিচ্ছে সঞ্চয়পত্র সুদ ভর্তুকি খাতে। সরকার এ খাতকে কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) হিসেবে উল্লেখ করছে। কিন্তু এ সুবিধা কারা পাচ্ছে? মধ্যম ও উচ্চ পর্যায়ের লোকজন। একজন সাধারণ মানুষ বিনিয়োগ করতে পারবে ৫০ লাখ টাকা, আর একজন সরকারি কর্মকর্তা বিনিয়োগ করতে পারবে ১ কোটি টাকা। এটি একধরণের বৈষম্য, তাই সরকারকে এ বিষয়গুলো দেখতে হবে।"
তিনি বলেন, "পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ছিল, তার সুদহার ছিল এক শতাংশের কম। এখন সরকার যে জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছে তার সুদহার ৩ শতাংশের মতো। আমরা এ প্রকল্প থেকে সরাসরি রিটার্ন যদি দেখি তা টোল থেকে আসবে, কিন্তু এ নিয়ে সমালোচনা আছে।
এখন এ ঋণ কীভাবে পরিশোধ করতে হবে, তা দেখার বিষয়। কারণ এর একটি প্রভাব থাকবে বাজেটে," যোগ করেন তিনি।