অক্সিজেনের অভাবে দিল্লির হাসপাতালগুলোতে হাহাকার, দ্রুতগতিতে বাড়ছে মৃত্যু
ভারতের দিল্লির বাসিন্দা অশ্বিন মিত্তাল। সপ্তাহখানেক আগে অশ্বিনের দাদীর রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে শুরু করে। দিল্লিজুড়ে হন্যে হয়ে হাসপাতাল শয্যা খুঁজতে শুরু করেন অশ্বিন। পরিচিত সবাইকে সাহায্যের জন্য ফোন করেন তিনি। কিন্তু, তাকে ফিরিয়ে দেয় প্রতিটি হাসপাতাল।
বৃহস্পতিবার দাদীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে তিনি জরুরি সেবার জন্য তাকে কয়েকটি হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু, জায়গা ফাঁকা না থাকায় প্রতিটি হাসপাতাল থেকে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরিবারটি একরকম মেনেই নেয় যে, চিকিৎসা সেবা ছাড়াই এই নারী মৃত্যুবরণ করবেন। কিন্তু, দাদীর ভারী নিঃশ্বাসগুলো অশ্বিন বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেননি।
বয়স্কা দাদীকে নিয়ে কয়েক ঘন্টা যাবৎ গাড়িতে করে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়াতে থাকেন তিনি। অবশেষে, উত্তর দিল্লির এক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মিলে ঠাঁই। তবে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেবলমাত্র "কয়েক ঘন্টা" সময় বেধে দেন। দাদীকে সেখানে রেখে পুনরায় হাসপাতালের সন্ধানে নামেন অশ্বিন।
অশ্বিন নিজেও করোনা আক্রান্ত ছিলেন। তীব্র জ্বর আর শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়েই হাসপাতাল খুঁজতে থাকেন তিনি। কিন্তু, কোথাও কোনো শয্যা মিলেনি। পূর্বের হাসপাতালটি করুণাবশত রোগীকে জরুরি বিভাগে রাখার অনুমতি দেয়।
ডাক্তাররা জানান রোগীর বেঁচে থাকার ভালো সম্ভাবনা আছে। তবে, তার জন্য আইসিইউ প্রয়োজন। অক্সিজেন ফুরিয়ে যাওয়ায় সেই হাসপাতালটিও তিনদিনের মাথায় বৃদ্ধা এই নারীকে ছাড়পত্র দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
অশ্বিনের এক পারিবারিক বন্ধু জানান, "পরিবারটি আবার আগের জায়গায় ফিরে এসে নিয়তিকে মেনে নিয়েছে। তারা জানে যে, রোগী বেঁচে গেলে তা স্রেফ ভাগ্যের কারণে হবে, কোনো চিকিৎসা সেবার কারণে নয়।"
দিল্লির বহু পরিবারই এখন কেবল ভাগ্যের উপর পুরো বিষয় ছেড়ে দিয়েছেন। অধিকাংশ হাসপাতালই পরিপূর্ণ। এছাড়া অনেক হাসপাতাল অক্সিজেন সরবরাহে অনিশ্চয়তার কারণে নতুন রোগী নিতে অসম্মতি প্রকাশ করছে।
অক্সিজেন সংবলিত অ্যাম্বুলেন্স নিয়েও দেখা দিয়েছে সংকট। এমনকি, হাসপাতালে শয্যা পাওয়া গেলেও অ্যাম্বুলেন্স সংকটে রোগীকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে বিপাকে পড়ছে পরিবার।
উচ্চচাপ বিশিষ্ট অক্সিজেন সুবিধা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছেন বহু রোগী। দিল্লিবাসীদের প্রতিটি সকাল শুরু হচ্ছে পরিবার-পরিজন, বন্ধু, প্রতিবেশী ও সহকর্মীদের যাহায্য চেয়ে করা ফোনকলের মাধ্যমে। অক্সিজেন সিলিন্ডার, হাসপাতাল শয্যা কিংবা ওষুধপত্র- সবকিছুর সন্ধান চাওয়া হচ্ছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো ডাক্তার এবং কর্মকর্তাদের সংখ্যাও দিন দিন কমছে। অসহায়ত্বের মুখে বাধা পড়েছেন তারাও। হেল্পলাইনগুলোও কাজ করছে না। মজুদ শেষ হওয়ায় সরবরাহকারীরাও আগে মতো সাহায্য করতে পারছেন না।
এই মুহূর্তে এভাবেই কাটছে দিল্লির রাতদিন। বন্ধুরা বন্ধুদের ফোন করছেন; মরিয়া হয়ে করা সাহায্যের আবেদনে ভেসে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
বর্তমানে সেখানে হাসপাতাল শয্যা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। অক্সিজেন সিলিন্ডার এবং ওষুধপত্রের সরবরাহ নিয়েও চলছে সংকট। অক্সিজেন শেষ হতে চলায়, শনিবার (২৪ এপ্রিল) দিল্লির সরোজ হাসপাতাল এবং বাত্রা হাসপাতাল রোগীদের অন্যত্র সরিয়ে নিতে পরিবারগুলোকে আহ্বান জানায়।
গত কয়েকদিনে এই শহরে করোনায় আক্রান্তদের দৈনিক শনাক্তের হার ২৪ হাজারেরও বেশি। হাসপাতালগুলোতে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী থাকায় স্বাস্থ্য সেবাদানকারীরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
অনেকেই, আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকা রোগীদের নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছেন। দিল্লি নিবাসী শিবেশ রানার ভাইয়ের অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। তবে, শহরে কোনো শয্যা না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্স যোগে ভাইকে নিয়ে তিনি পাশের রাজ্য হরিয়ানায় যান।
কিন্তু যাত্রাকালে রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটে। এমনকি, অ্যাম্বুলেন্সটিতেও জরুরি সেবাদানের ব্যবস্থা ছিল না। হাসপাতালে পৌঁছানোর কয়েক ঘন্টা পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যে কোভিড প্রতিরোধে গঠিত বিশেষ দলের সদস্য ডাক্তার ফাতাহুদিন। তিনি জানান, এই সংকট নজিরবিহীন। অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে ডাক্তাররাও বেশি কিছু করতে পারবেন না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
"ভেন্টিলেটর এবং বাইপ্যাপ মেশিন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে উচ্চচাপ বিশিষ্ট তরল অক্সিজেন প্রয়োজন। চাপ কমে গেলে মেশিনগুলো ফুসফুসে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সরবরাহে ব্যর্থ হয়। ফলে, এর পরিণাম হতে পারে প্রাণঘাতী," বলেন তিনি।
রোগীকে স্থিতিশীল অবস্থায় রেখে মূল্যায়ন ও ভবিষ্যৎ চিকিৎসা পরিকল্পনা করতে ডাক্তারদের যে সময় প্রয়োজন, তার জন্য অক্সিজেন অন্যতম প্রধান একটি অনুষঙ্গ।
যথাযথ চিকিৎসা সেবার অভাবে রোগীদের মৃত্যুবরণ ঠেকাতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানান ডাক্তার ফাতাহুদিন।
"স্বল্পসময়ে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল ও আইসিইউ শয্যা নির্মাণে বিশ্বে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষতা সবথেকে বেশি। তাদেরকে এ কাজে সম্পৃক্ত করা উচিত," বলেন তিনি।
দিল্লির বাইরে অন্যান্য শহরে পরিস্থিতি খুব একটা ভিন্ন নয়। দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন পুরো দেশ বিপর্যস্ত, তখন পুনে, নাসিক, লক্ষ্নৌ, ভোপাল, ইন্দোর এবং এলাহাবাদের মতো শহরগুলোও রেহাই পায়নি।
শুক্রবার ভারতে প্রায় তিন লাখ ৪৯ হাজার করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। সেই সাথে দৈনিক সংক্রমণ বৃদ্ধির হারে রেকর্ডমাত্রা যুক্ত হয়। এছাড়া, করোনায় মৃত্যুবরণ করেন আরও দুই হাজার ৭৬৭ জন। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
গবেষণাগারের ধারণ ক্ষমতা অতিক্রম হওয়ায় অনেক শহরে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালনাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতাল শয্যা না পাওয়ার পাশাপাশি শনাক্তকরণ পরীক্ষা না করাতে পেরে বহু রোগী ঘরেই মৃত্যুবরণ করছেন। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের করা তালিকায় শনাক্তহীন এই মানুষদের জায়গা হয় না।
এদিকে, তীব্র হচ্ছে আর্তনাদ– আগের চাইতেও হৃদয়বিদারক হয়ে উঠছে প্রতিটি আহ্বান।