অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ লাখ বিদেশির শিক্ষাগ্রহণ
আর মাত্র দুমাস পড়েই যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে সম্মানজনক একটি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র; ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সেমিস্টারের পাঠ শুরু করতেন ১৯ বছরের তিয়ানইউ ফ্যাং। কিন্তু, হঠাৎ করেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে তার জীবনে। নিজের উজ্জ্বল শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন এই চীনা নাগরিক।
ফেং অবশ্য একা নন, তার মতো আরও ১০ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থীকে ওয়াশিংটনের এক সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া করতে পারে। গত সোমবার নেওয়া ওই সিদ্ধান্তের আওতায় যেসব বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে পাঠদান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; তাদের শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগের নির্দেশ জারি করেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আওতায় যারা স্বেচ্ছায় যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাবেন না; তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ফেরত পাঠাবে ট্রাম্প প্রশাসন। খবর সিএনএনের।
এ সিদ্ধান্ত ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত, এবং এমন মুহূর্তে নেওয়া হয়েছে; যখন চলমান মহামারির ক্রমশ ভয়াবহতার মাঝে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে নানা বিষয়ের পাঠদান সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে।
কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এখনও নিজ ক্যাম্পাসে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছে অবশ্য। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মহামারি পরিস্থিতি যেভাবে নাজুক অবস্থায় রূপ নিচ্ছে, তাতে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও অচিরেই অনলাইন ক্লাস নেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে।
ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে ২৯ লাখের বেশি মানুষকে আক্রান্ত করেছে করোনাভাইরাস আর এতে মারা গেছেন এক লাখ ৩০ হাজার জনের বেশি। তাই এমন সম্ভাবনার পাল্লাই দিন দিন ভারি হচ্ছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন নীতিমালায় সবচেয়ে প্রভাবিত হবেন এশিয়া থেকে আসা ছাত্ররা। যুক্তরাষ্ট্রে পাঠরত বিদেশিদের মধ্যে তাদের সংখ্যাই অর্ধেকের বেশি।
শুধুমাত্র ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষেই তিন লাখ ৭০ হাজার চীনা ছাত্র যুক্তরাষ্ট্রে আসে। এরপরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল ভারতীয়রা, দুই লাখ দুই হাজার জন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে দূরপ্রাচ্যের দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির প্রায় ৫২ হাজার ছাত্র নানা মার্কিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়।
প্রথমেই উল্লেখিত চীনা তরুণ তিয়ানইউ ফ্যাং তার মিডল স্কুল বা মাধ্যমিক সমমানের পড়াশোনা শেষ করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রেই। এরপর তিনি বেইজিং ফিরে গিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর চলতি বছরেই সেখান থেকে আবার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন তিনি।
এই সময় করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে চীন থেকে ফ্লাইট নিষিদ্ধ ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। এ নিষেধাজ্ঞা এড়াতে কম্বোডিয়া গিয়েছেন। সেখানেই এখন আছেন ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার পরিকল্পনা করেন তিনি শুধুমাত্র মানসম্মত শিক্ষালাভের প্রত্যাশায়।
মার্কিন প্রশাসনের সিদ্ধান্তের কারণে তার জন্য শিক্ষা অর্জনের এই সংগ্রাম আরও জটিল হয়ে পড়লো। ইতোমধ্যেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে প্রতিটি সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছে, যার আওতায় শুধু ফল সেমিস্টার (আগস্ট থেকে ডিসেম্বর) এবং সামার (মে থেকে আগস্ট) সেমিস্টারে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ক্লাস করার সুযোগ পাবেন।
এর অর্থ হচ্ছে, ফল সেমিস্টারে ক্যাম্পাসে ক্লাস করার পর পরবর্তী সেমিস্টার তাকে অনলাইনে পাঠদান নিতে হবে। নতুন নিয়মের আওতায় তাকে এই সময়ের জন্যে আবার যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মাঝে চলাচলকারী আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের পরিমাণ এখন অনেক কমে গেছে। আবার রয়েছে প্রতিবার ভ্রমণের পর ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকার ঝক্কি। এধরনের যাতায়াতে ব্যয়বৃদ্ধির কথা বলাই বাহুল্য।
তাই চীনে বসেই অনলাইনে ক্লাস করার জন্য ৬০ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করা উচিৎ হবে কিনা, তা আবারও ভেবে দেখতে বাধ্য হচ্ছেন ফ্যাং। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, সেই শিক্ষাজীবন যে সহপাঠী এবং শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা থেকে তাকে বঞ্চিত করবে, তাও বলাই বাহুল্য।
অনিশ্চয়তার সঙ্গে বসবাস:
যুক্তরাষ্ট্রে পাঠরত আরেক চীনা শিক্ষার্থী ২৯ বছরের চীনা শিক্ষার্থী চেন না। গত সোমবারের ঘোষণায় তার স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন এখনই হুমকির মুখে পড়েনি। কারণ, তিনি বর্তমানে নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) ডিগ্রী অর্জনের অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পাঠগ্রহণ চলছে অনলাইন এবং অফলাইন দুই মাধ্যমেই।
তবে শঙ্কার বিষয় হলো; সংক্রমণ রোধের চেষ্টায় আবারো পুরোদমে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার দিকে ঝুঁকতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এর আগে গত মার্চেও এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
এনিয়ে শঙ্কিত ছাত্রী চেন না- বলেন, ''এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করা আমি কিছুতেই বন্ধ করতে পারছিনা। নিজেকে এখন খুব অসহায় ও দুর্বল লাগছে। তারপরও, আমি যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে অবস্থান করে শিক্ষাগ্রহণ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব।''
অনলাইনে পাঠদান শুরু হলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স ট্রান্সফার করাটাও সম্ভব হবে না তার জন্য। কারণ চেন 'ইন্টারঅ্যাক্টিভ টেলিকম্যিউনিকেশন্স পোগ্রাম' নিয়ে পড়ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাতেগোণা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়টির ওপর মাস্টার্স পোগ্রাম চালু আছে। ফলে তাকেও বাধ্য হয়ে চীনে ফিরে গিয়ে অনলাইনে ক্লাস করতে হবে। যা একইসঙ্গে ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ এবং করোনার মহামারি চলাকালে অতীব ঝুঁকিপূর্ণ।
এমন অযাচিত ভোগান্তির মুখে পড়তে চলেছেন যে ১০ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থী, তাদের অধিকাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে উদার ধারণা পোষণ করতেন। বলাই বাহুল্য, সে ধারণা এখন রাতারাতি বদলে যাবে তাদের মানসে। পৃথিবীতেও উচ্চশিক্ষার আকর্ষণীয় কেন্দ্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই তার আবেদন হারাবে।