আগে অভিশংসিত মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের ব্যাপারে যা জানা দরকার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে অভিশংসনের মুখে পড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগেও, অবশ্য তার বিরুদ্ধে আরও একবার অভিশংসন অনুমোদন দেয় মার্কিন কংগ্রেস। কিন্তু, সিনেট তাকে নিষ্কৃতি দেয়।
কিন্তু, গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন পার্লামেন্টে হামলার পর আজ বুধবার (১৩ জানুয়ারি) আবারও তাকে অভিশংসন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে জেনে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০ বছরের ইতিহাসে ট্রাম্পের আগে অভিশংসিত দুই রাষ্ট্রপতি; অ্যান্ড্রু জনসন ও বিল ক্লিনটন- এদের কেউই মেয়াদ পূরণের আগে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হননি।
অবশ্য, ক্লিনটন ও জনসনের অভিশংসনের পর তাদের দল নির্বাচনে হেরে যায়। ফলে তারা আর দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ পাননি। সেদিক থেকে তাদের সঙ্গে রয়েছে ট্রাম্পের মিল।
মার্কিন সংবিধান অনুসারে; ঘুষগ্রহণ, দেশদ্রোহ বা অন্যান্য বড় ধরনের অপরাধ বা অনৈতিক কাজে জড়িত থাকলে রাষ্ট্রপতি বা অন্য কোনো পদস্থ কর্মকর্তাকে অভিসংশিত করা যাবে।
তবে ইতিহাসে বহুবার নজির মিলেছে যে, দায়িত্বশীল প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বড় ধরনের রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া প্রক্রিয়াটি অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজ দলের অনিচ্ছায় বেঁচে গেছেন প্রেসিডেন্ট। অনেক সময় তাদের দৃঢ় সমর্থনে বানচাল হয়েছে অভিশংসের চেষ্টাও। সমর্থক গোষ্ঠীর নেতিবাচক মনোভাব এড়াতেই প্রধানত তারা প্রেসিডেন্টকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। যেমন; ট্রাম্পের পক্ষেও শক্ত অবস্থান নিয়েছেন অধিকাংশ রিপাবলিকান।
কংগ্রেসের অভিশংসন মানেই প্রেসিডেন্টকে দপ্তর ছেড়ে বিদায় নেওয়া নয়। এটি আসলে দুই স্তর বিশিষ্ট পদ্ধতি। কোনো কর্মকর্তাকে অভিশংসন করতে হলে প্রতিনিধি পরিষদ বা কংগ্রেসকে তাকে পদচ্যুত করার প্রস্তাব পাস করতে হবে।
প্রস্তাবে অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে, অভিযুক্তের সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিবরণ। এরপর কংগ্রেস অভিশংসনের পক্ষে ভোট দিলে, তা নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে সিনেটের নিজস্ব বিচার প্রক্রিয়া। প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে সরানোর শেষ চাবিকাঠি তাই সংসদের উচ্চকক্ষের উপর নির্ভর করে।
জটিল সেই প্রক্রিয়ার বিশদ নিয়ে আর আলোচনা না বাড়িয়ে এবার দেখা যাক, ট্রাম্পের আগে যে দুই মার্কিন রাষ্ট্রপতি অভিসংশিত হয়েছেন তারা কেন বহাল তবিয়তেই স্বপদে ছিলেন।
অ্যান্ড্রু জনসন
জনসন কেন অভিশংসিত হলেন?
আব্রাহাম লিঙ্কন আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হন অ্যান্ডু জনসন। তিনি লিঙ্কনের উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ পরবর্তীকালের ওই সময়টা ছিল উত্তাল। ডেমোক্রেট জনসন যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউনিয়নপন্থী অবস্থান নেন। তবে তিনি ছিলেন একজন বর্ণবাদী। তিনি কনফেডারেট রাজ্যগুলোকে ফেডারেল কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করতে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না।
এমনকি কংগ্রেস যেসব আইনের মাধ্যমে দক্ষিণের প্রাক্তন বিদ্রোহী রাজ্যগুলোকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে, তার অধিকাংশের বিপক্ষে ভেটো দেন জনসন। এনিয়ে পুরো মেয়াদে কংগ্রেসের সঙ্গে তার লড়াই চলে। এখানেই শেষ নয়, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন নাগরিকদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা সহায়তা এবং জমি বরাদ্দে পাস করা ফ্রিডম্যান ব্যুরো অ্যাক্টের বিপক্ষেও ভেটো দেন।
এসব কার্যকালাপে তার উপর চটে যায় কংগ্রেস। তবে শেষপর্যন্ত যখন তিনি লিঙ্কন নিয়োজিত যুদ্ধমন্ত্রী এবং রিপাবলিকান দলের কট্টর অংশের মধ্যেও তুমুল জনপ্রিয় এডউইন স্ট্যানটনকে পদচ্যুত করেন, তখন আর কংগ্রেস ধৈর্য ধরে রাখতে পারেনি।
অভিশংসনের জন্য ১১টি ধারায় প্রস্তাবনা আনে কংগ্রেস। সবগুলোতেই দায়িত্ব পালনকালে নিজ দপ্তরের আইন লঙ্ঘন করেছেন জনসন, এমন অভিযোগ আনা হয়। কংগ্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে অভিসংশিত হন জনসন। এরপর, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রক্রিয়া চলে যায় সিনেটের হাতে। অবশ্য, সেখানে এটি অনুমোদন পায়নি। কয়েক বছর পর মার্কিন সুপ্রিম কোর্টও জনসনের অভিসংশনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে।
জনসন কেন ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হননি?
সিনেটে মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে জনসনের পদমর্যাদা রক্ষা পায়। বিরোধী দল রিপাবলিকানদের সাত সিনেটর ডেমোক্রেটদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তার পক্ষে ভোট দেওয়াতে সামান্যের জন্য ক্ষমতাচ্যুত হননি তিনি।
জনসনের পক্ষে সমর্থনকারীরা সিনেট অধিবেশনে যুক্তি দেন, তিনি যুদ্ধমন্ত্রীকে নিজে নিয়োগ না দেওয়ায়, তাকে সরিয়ে দাপ্তরিক আইন লঙ্ঘন করেননি। অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে তাই জনসন সর্বোচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হবেন বলেও হুমকি দেন তারা।
ঐতিহাসিক হান্স এল. ট্রাফোজে অবশ্য মনে করেন, জনসনকে হঠানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সিনেটররা রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই তাকে সমর্থন দেন ।
বিল ক্লিনটন:
ক্লিনটন কেন অভিশংসিত হলেন?
কংগ্রেসের ইন্টার্ন মনিকা লিউনিস্কির সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে কংগ্রেসের ক্ষোভের শিকার হন বিল ক্লিনটন। ১৯৯৮ সালে এই ঘটনা জনসম্মুখে আসলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এনিয়ে প্রথমে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের আনীত "যৌন সম্পর্কের" অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করেন তিনি। অবশ্য, পরবর্তীকালে অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা মেলে।
তার বিরুদ্ধে আনা অভিশংসনের ধারায় অভিযোগ আনা হয়, তদন্তকারীদের কাছে মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে ক্লিনটন নিজের বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছেন। হোয়াইট হাউসের কর্মীদের মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি ন্যায়-বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন বলেও জানান অভিযোগকারীরা।
ক্লিনটন কেন দপ্তর থেকে অপসারিত হননি?
কংগ্রেসের সিদ্ধান্তের পর সিনেটে শুরু হয় ক্লিনটনের বিচার প্রক্রিয়া। কিন্তু, সেই বিচারের ফলাফলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কতিপয় কিছু গুরুতর কারণেই রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব। ক্লিনটন অন্যায্য আচরণ করেছেন, সিনেটররা তা স্বীকার করে নিলেও, শেষপর্যন্ত তারা তাকে "সর্বোচ্চ ও গর্হিত অপরাধের" দায়ে ক্ষমতাচ্যুত করেননি।
এব্যাপারে নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবিধানিক আইনের অধ্যাপক মাইকেল গেহেরডাট বলেন, "ক্লিনটন অসৎ আচরণ করেছেন- তা অধিকাংশ ব্যক্তি স্বীকার করে নিলেও, তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর পক্ষে সেটি তারা যথেষ্ট বলে মনে করেননি।"
সূত্র: টাইম