আফগানিস্তানের নতুন গ্রেট গেমে অবস্থান তৈরির লড়াইয়ে চীন, পাকিস্তান ও ভারত
১৯ শতকে আফগানিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে আনার এক প্রচ্ছন্ন লড়াই চালিয়েছে রুশ ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। ২০ শতকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানের ক্ষমতা দখলের ফলে যে নতুন 'গ্রেট গেম; জন্ম নিয়েছে তাতে স্থলসীমা আবদ্ধ আফগানিস্তানে মূল পরিচালক হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে পাকিস্তানের। পরম মিত্র চীনকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে প্রভাব সুসংহত করতে চাইছে ইসলামাবাদ।
তালেবানের ঘনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়দাতা ছিল পাকিস্তান। যুক্তরাষ্ট্র অতীতে এনিয়ে অনেকবার চাপও দিয়েছে।
ওয়াশিংটন অভিযোগ করে, কাবুল সরকারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সমর্থনেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তালেবান। ইসলামাবাদ বরাবর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তারপরও, গেল সপ্তাহে যখন তালেবান কাবুল দখল করলো, তখন আর রাখঢাকের প্রয়োজন হয়নি।
পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, 'আজ আফগানরা দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলেছে।'
অন্যদিকে, তালেবান যখন নতুন সরকার গঠনের রূপকাঠামো নিয়ে আলোচনা করছে, তখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যাচ্ছে, পাকিস্তানী কর্মকর্তারাও সে প্রক্রিয়ায় জড়িত আছেন।
কূটনৈতিক বিবৃতিতে অবশ্য ইসলামাবাদ যথেষ্ট সতর্ক। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, পাকিস্তান সকল পক্ষের অংশগ্রহণে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা চায়, যা আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে। তবে এটি নিশ্চিত করা 'আফগান পক্ষগুলোর দায়িত্ব'।
অন্যদিকে, তালেবানের সঙ্গে এক দশক আগেও অন্তরঙ্গতা ছিল না বেইজিংয়ের। কিন্তু, পাকিস্তানের সর্ব-ঘনিষ্ঠ কৌশলগত অংশীদার চীন এবার তালেবানের প্রতি মিত্রতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় আগে তালেবান প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানান খোদ চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
প্রায় এক লাখ কোটি ডলারের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদে ভরপুর আফগানিস্তান। ভবিষ্যৎ বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি লিথিয়ামের মতো খনিজের সবচেয়ে বড় মজুদও সেখানে। চীন চায় এসব সম্পদের নিয়ন্ত্রণ।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ, আফগানিস্তানের সঙ্গে ছোট্ট স্থলসীমার বাড়তি নিরাপত্তার নিশ্চিতকরণ। এ সীমান্ত লাগোয়া কারাকোরাম পর্বতমালার মধ্যে দিয়ে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশকে পাকিস্তানের সাথে যুক্তকারী মহাসড়ক। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপেক) জন্য যার গুরুত্ব অপরিসীম।
ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গেও সংযোগস্থল আফগান ভূমি। বেইজিং তালেবানের ওপর ভর করে এ অঞ্চলে একাধিক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা করছে।
ভূ-রাজনীতির দাবার বোর্ডে অপর পক্ষ পাকিস্তানের পুরোনো শত্রু- ভারত। চীনের সাথেও সীমান্ত বিরোধ রয়েছে নয়াদিল্লির। বিতর্কিত পার্বত্য স্থল সীমায় এক বছরের বেশি সময় জুড়ে মুখোমুখি অবস্থানে আছে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনী।
কাবুলে সদ্য উৎখাত হওয়া সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিল ভারত। তাই বিপরীত পক্ষে থাকা চীন ও পাকিস্তান তালেবান শাসিত আফগানিস্তানে মূল পরিচালক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। এনিয়ে সঙ্গত কারণেই বিচলিত ভাব বাড়ছে নয়াদিল্লির।
চীন যদিও বলছে, তালেবান সখ্যতার মূল কারণ আফগান সীমান্তবর্তী পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশের স্থিতিশীলতা। বেইজিংয়ের শাসন বিরোধী ইস্ট-তুর্কমেনিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) এর জঙ্গিরা যেন আফগানিস্তানে নিরাপদ আশ্রয় না পায়- তা নিশ্চিত করা।
সিচুয়ান ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়া অধ্যয়ন কেন্দ্রের অধ্যাপক ঝাং লি মন্তব্য করেন, "আফগানিস্তানে প্রভাবকে ভারতের বিরুদ্ধে সুবিধা আদায়ে কাজে লাগাতে চায় পাকিস্তান। কিন্তু, চীনের লক্ষ্য ভিন্ন। বেইজিংয়ের প্রধান প্রত্যাশা তালেবান একটি অংশগ্রহণমূলক ও মধ্যপন্থী সরকার গঠন করুক। এতে করে জিনজিয়াং প্রদেশে অশান্তির আগুন ছড়াবে না। এর বাইরে নীতিনির্ধারক মহলের অন্যান্য হিসাবনিকেশ সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পাবে।"
মার্কিন সরকারের দাবি আনুষ্ঠানিক সংগঠন হিসেবে আর ইটিআইএম- এর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু, চীন এই সংগঠনের ট্যাগ উইঘুরসহ মুসলিম সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর ওপর গণহারে আরোপ করে দমনপীড়ন চালাচ্ছে। তবে বরাবর উইঘুর নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে বেইজিং।
এনিয়ে পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক শীর্ষ গবেষক ও নয়াদিল্লি ভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের অধ্যাপক ব্রহ্ম চেলানী বলেছেন, আফগানিস্তান শাসনে তালেবানের মূল যে দুটি সহায়তা দরকার, তা হলো- কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা। দু'দিকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বেইজিং।
"সুযোগ-সন্ধানী চীন নতুন সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করবে না। ফলে আফগানিস্তানের বহুমূল্য খনিজ সম্পদ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পাকিস্তান, ইরান ও মধ্য এশিয়ায় চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব নিঃসন্দেহে বাড়তে চলেছে।"
তিক্ত অভিজ্ঞতা:
নিউইয়র্কের ইথাকা কলেজের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজা আহমেদ রুমি জানান, ঘটনাবলীর সাম্প্রতিক ধারাপ্রবাহে ভারতের সুনিশ্চিত পরাজয়ে উচ্ছ্বসিত গোটা পাকিস্তান। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভাজিত হয়ে রাষ্ট্র দুটির স্বাধীনতা লাভের সময় থেকেই তারা একে-অপরের প্রাণের শত্রু। কাশ্মীর ইস্যুসহ আজপর্যন্ত স্থায়ীভাবে কোনদিন উত্তেজনার কারণ নিরসন হয়নি।
"পাকিস্তানী নীতিনির্ধারকরা সাবেক প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি ও তাঁর প্রশাসনকে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠতাঁর কারণে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন। তাই এখন সামাজিক মাধ্যম আর টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখলেই ভারতীয় প্রভাবের অবসানে পাকিস্তানীদের উচ্ছ্বাস চোখে পড়ছে।"
পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী এবং ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথমবার তালেবানের শাসন নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে ভারতের।
১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে কান্দাহারে নিয়ে যায় জঙ্গিরা। তখন তালেবান সরকার ক্ষমতায়, নিরুপায় নয়াদিল্লি যাত্রীদের মুক্তির বিনিময়ে পাকিস্তানপন্থী তিনজন জ্যেষ্ঠ জঙ্গি নেতাকে মুক্তি দেয়।
কাবুলে নিয়োজিত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত জয়ন্ত প্রসাদ বলেন, "বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য। আফগানিস্তানে আমাদের দীর্ঘ 'খেলা'র জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। দেশটির সাথে সীমান্ত না থাকলেও, সেখানে আমাদের স্বার্থ জড়িত।"
গত বছর কাতারের দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় যোগ দেওয়ার পর থেকে তালেবান একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। ভারতীয় কূটনৈতিকরাও গোষ্ঠীটির সাথে নেপথ্য আলোচনা করেছেন বলে নয়াদিল্লির সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে।
ঘানি সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে এবং অনেক দেরীতে তালেবানের সাথে আলোচনা শুরু করার কারণেই ভারত আজ নিরুপায় হয়ে পড়েছে, দেশবাসীর কাছ থেকে এমন সমালোচনার মুখে পড়েছে ভারত সরকার। এ অবস্থায় আলোচনার বিস্তারিত উল্লেখ না করে কূটনৈতিকদের একজন বলেছেন, "আমরা সকল পক্ষের সাথেই কথা বলছি।"
"পুনরাবৃত্তি হবে না"
তবে অতিরিক্ত চীন-নির্ভরতা লাঘবে তালেবানের কাছে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারত আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে বলে উল্লেখ করেন নাম-প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কূটনীতিক।
আফগানিস্তানের ৩৪টি প্রদেশের সব কয়টিতেই ছোট-বড় নানান রকম উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে ভারতের। কাবুলে অবস্থিত পার্লামেন্ট ভবনও ভারতীয় সহায়তায় তৈরি যা গেল সপ্তাহে তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
এব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে তিনটি গ্রন্থের লেখক ও সাবেক রয়টার্স সাংবাদিক মায়রা ম্যাকডোনাল্ড বলেন, তালেবানের ক্ষমতা দখল প্রতিযোগিতায় ভারতকে পিছিয়ে দিয়েছে নিঃসন্দেহে; কিন্তু তার মানেই নয়াদিল্লির জন্য খেলার সমাপ্তি নয়।
"এবার অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে না। ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অবস্থান নিয়ে সকল পক্ষই চিন্তিত। এদিকে সবার নজর থাকবে। তালেবানকেও সতর্ক থাকতে হবে। আবার তুলনামূলক বিচারে অর্থনৈতিক দিক থেকেও পাকিস্তানের চাইতে অনেকগুণ শক্তিশালী ভারত।"
তালেবানের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য বার্তাসংস্থা রয়টার্সের কাছে আফগানিস্তান পুনর্গঠনে সকল পক্ষের সহায়তা যে প্রয়োজন সে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়াসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য শক্তিগুলোও সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসলে তালেবানও স্বাগত জানাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তালেবানের শুরা পর্ষদের অন্যতম সদস্য ওয়াহিদুল্লাহ হাশিমি বলেন, "আমরা চাই সবাই আমাদের সাহায্য করুক। বিশেষত স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও খনি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা আমাদের জনগণকে সমর্থন দিতে পারে। এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য বিদেশী শক্তিদের আশ্বস্ত করা।"
- সূত্র: রয়টার্স