আফগানিস্তানের রাজনৈতিক সমীকরণে ভূমিকা রাখছে চীন ও পাকিস্তান
গত ১১ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের কাবুলের রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে নিজেদের সাদা-কালো পতাকা উড়িয়েছে তালেবান সরকার। দিনটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার ২০তম বর্ষপূর্তি।
এ ঘটনার প্রতীকী তাৎপর্য চোখ এড়ানোর উপায় নেই। কারণ ওই হামলায় সরাসরি তালেবান জড়িত না থাকলেও পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশোধমূলক আগ্রাসনে তারাই ক্ষমতাচ্যুত হয়।
প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে পতাকা উড়িয়ে নিঃসন্দেহে ২০ বছর পর শাসকগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের ফিরে আসার বার্তা দেয় তালেবান। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় যুক্তরাষ্ট্রেরও নেই।
এরপর কিছুদিন আগে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ইংরেজি ভাষার দৈনিক 'গ্লোবাল টাইমস'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চলমান থাকার কথা জানিয়েছিলেন।
শাহিন বলেছিলেন, চলতি সেপ্টেম্বর থেকে আগামী অক্টোবরের মধ্যেই সরকার কাঠামোর পূর্ণাঙ্গ রূপ ঘোষণা হবে এবং তারা একটি সার্বজনীন সরকার গঠনের চেষ্টা করছেন।
এরপর তালেবান তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ঘোষণা দিলেও এখনো স্থায়ী সরকার গঠনের আলোচনা চলছে। আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। আফগানিস্তানের মধ্যাঞ্চলের বেশকিছু বর্ষীয়ান উপজাতি নেতা, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ ও তরুণ নেতাদের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে এক টুইটবার্তায় কারজাই বলেন, 'বৈঠকে উপস্থিত সকল বক্তা পুরো দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে, তারা স্থায়ী মন্ত্রীপরিষদে দেশের সকল মানুষের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন।'
সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকলে তা আফগানিস্তানের প্রকৃত পরিচয় তুলে ধরবে বলেও জানান দেশটির সাবেক এ রাষ্ট্রপতি।
সংখ্যালঘু শিয়া হাজারা গোষ্ঠীও এবারের তালেবানের নেতৃত্বে স্থায়ী সরকারে স্থান পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। তালেবান অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে।
অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি যখন রাজনৈতিক সংলাপের, ঠিক তখনই তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রতিক্রিয়া নির্ধারণে ব্যস্ত প্রতিবেশী দেশগুলো। উদ্যোগ গ্রহণে সবচেয়ে এগিয়ে আছে পাকিস্তান।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদের উদ্যোগে আফগানিস্তান নিয়ে প্রতিবেশী পাকিস্তান, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। তিনি প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি আফগানিস্তানে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি এড়াতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। একই সময়, তিনি সকল নৃগোষ্ঠীকে নিয়ে স্থায়ী সরকার গঠনের আহ্বান করেন তালেবানের প্রতি।
ওয়াং তালেবানের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তাদেরকে অবশ্যই একটি সার্বজনীন সরকার গঠনের পাশাপাশি মধ্যপন্থী, আধুনিক ও যুগোপযোগী অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে। দূরত্ব রাখতে হবে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে হবে।
বৈঠকে যোগদানকারী অন্যান্য দেশের মন্ত্রীদের সামনে ওয়াং বলেন, 'সম্প্রতি তারা (তালেবান) প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন ও সন্ত্রাস দমনে ইতিবাচক বিবৃতি দিয়েছে। এখন সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে দেখানোর সময় এসেছে।'
তবে নিজেদের বৈধ স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ও পুনর্গঠনের অনুকূল পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় প্রতিবেশী দেশগুলোর অনন্য ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ওয়াং।
সোজা কথায়, তালেবানকে মধ্যপন্থী ও গ্রহণযোগ্য সরকার হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছে চীন। আর এজন্য প্রতিবেশীদের সাহায্য চাইলেন চীনের শীর্ষ এ কূটনীতিক।
মধ্য এশিয়ায় চীনের ক্রমঃবিকাশমান প্রভাবের পক্ষেই গেছে এ বৈঠকের ফলাফল। এতে যোগদানকারী রাষ্ট্র ইরান ইতোমধ্যেই আফগানিস্তান ইস্যুতে পরবর্তী বৈঠক আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে ভুলত্রুটি ও সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার মতো নানান বিষয়ে সমালোচনা করলেও, তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় এক মধ্যপন্থী অবস্থান ধরে রেখেছে তেহরান। তাই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার এ প্রক্রিয়ায় ইরানের অংশগ্রহণ সত্যিকার অর্থেই বড় পরিবর্তন আনতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি মাজিদ তাখত রাভাঞ্চি পানশির উপত্যকায় হামলার জন্য তালেবানের কড়া ভাষায় নিন্দা করেছেন।
তিনি বলেন, 'পানশিরে সাম্প্রতিক আক্রমণ ভ্রাতৃঘাতী ও নিন্দনীয় এক অপরাধ, যা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত অবস্থানের পরিপন্থী। এভাবে গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করা কোনো সরকারকে কেউই স্বীকৃতি দেবে না।'
ইরানি এ কূটনীতিকের ভাষায়, 'স্থায়ী শান্তি স্থাপনের একমাত্র পথ সকল ভাষাভাষী, নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণে গঠিত সরকার, যা জাতীয় পুনর্মিলন ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।'
ইরান চীনের চেয়ে কিছুটা কঠোর শর্তের সুরে কথা বললেও প্রতিবেশী আফগানিস্তানের নতুন শাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে দেশটিকে এখন সংযত পদক্ষেপই নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টিই তেহরানের মূল চিন্তার কারণ।
গত সপ্তাহে আফগানিস্তান ইস্যুতে ইরানের পার্লামেন্টে জবানবন্দী দেন এলিট বাহিনী কুদস ফোর্সের কমান্ডার ইসমাইল কানি। সেখানে তিনি আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে তেহরানের হাতে থাকা গোপন গোয়েন্দা তথ্য সাংসদদের জানান।
গত বছর ইরাকের রাজধানী বাগদাদে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন কুদস ফোর্সের কিংবদন্তিতুল্য কমান্ডার জেনারেল কাশেম সুলাইমানি। তার জায়গায় এখন দায়িত্বে এসেছেন কানি। তার পূর্বসূরি সুলাইমানির সঙ্গে তালেবান নেতা সিরাজুদ্দিন হাক্কানির সুসম্পর্ক ছিল বলে অভিযোগও করেছে পশ্চিমা বিশ্ব।
তবে আফগানিস্তানে জড়িত থাকতে ইরানের প্রধান আগ্রহের কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নি প্রধান রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তালেবানের অতীত ও বর্তমানের সম্পর্ক। তেহরানের ঘোর বিরোধী সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যেই আফগানিস্তানে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে গোপন তৎপরতা শুরু করেছে। আর শীর্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে কাতার।
এর আগে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ায় কাতার, সৌদি আরব ও আমিরাতের সমর্থিত ও অর্থায়নপুষ্ট উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে ইরান। আফগানিস্তানে দেশটি এমন লড়াইয়ের পুনরাবৃত্তি চায় না।
এজন্যেই সম্প্রতি ইরান পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই'র প্রধান জেনারেল ফয়েজ হামিদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ইসলামাবাদে রাশিয়া, চীন, ইরান, তাজিকিস্তান ও স্বাগতিক পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রধানরা আলোচনায় যোগ দিতে রাজি হয়।
এই আমন্ত্রণে তেহরানের সম্মতি ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একইসঙ্গে বৈঠকে রাশিয়ার উপস্থিতিও ইসলামাবাদের ভূমিকাকে আরও শক্তিশালী করবে। বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে একযোগে তালেবানের ওপর প্রভাব আরও জোরাল করতে চাইছে ইসলামাবাদ। এ ঘটনা তারই ইঙ্গিতবাহী।
আর চীন যে পাকিস্তানের এসব উদ্যোগকে সমর্থন দিচ্ছে, তাতেও সন্দেহ নেই। দুটি দেশই হয়ে উঠছে আফগানিস্তানে ক্ষমতার সমীকরণের প্রধান হিসাবকেন্দ্র।
-
সূত্র: এশিয়ান টাইমস