আফগান ট্রাজেডির জন্য কে দায়ী? রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র নাকি পাকিস্তান?
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র প্রচণ্ড ভুল করেছে। দেশটির পরিস্থিতি ও ইতিহাস বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। মার্কিন গণমাধ্যম পিবিএস নিউজের- 'পিবিএস নিউজআওয়ার' অনুষ্ঠানে দেওয়া সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে এমন কথা বলেছেন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি আফগানিস্তানে আগ্রাসনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
তারপর অবশ্য আফগান গণমাধ্যমকে দেওয়া অপর এক সাক্ষাৎকারে সুর বদলান তিনি। পাকিস্তান তালেবানের পক্ষে কথা বলছে এমন অভিযোগকে এসময় অস্বীকার করেন ইমরান। এ দাবি কৌশলগত ভাবে সত্য, কিন্তু নিরপেক্ষতার নৈতিক দৃষ্টিকোণ দেখলে যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য হবেন; আমেরিকা একা নয়- বরং অন্যান্য দেশও আফগান ট্রাজেডির পেছনে ভূমিকা রেখেছে। এদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি ছিল পাকিস্তানের।
১৯৭০ এর দশকে পশ্চিমা দুনিয়ার একটি প্রপাগান্ডা ছিল যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারস্য উপসাগরের উষ্ণ জলরাশি পর্যন্ত পৌঁছাতে চায়। এতে সোভিয়েত নৌবাহিনী মধ্যপ্রাচ্যের তেল বাণিজ্যপথটির নিয়ন্ত্রণ নেবে বলে প্রমাদ গুণতে থাকে পশ্চিমা বিশ্ব। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে যখন সোভিয়েতরা সত্যিসত্যি আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালালো তখন আশঙ্কা করা হতে লাগলো এরপর পাকিস্তানকে নিশানা করা হবে।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যানের দৃষ্টিতে, অশুভ সাম্রাজ্য আর নাস্তিক কমিউনিস্টরা পারস্য উপসাগরের দিকে এগোচ্ছে; যেকোন মূল্যে তাদের অগ্রযাত্রা রুখতে হবে। স্নায়ুযুদ্ধের ওই শেষ সময়ের উত্তেজনাকর মুহূর্তে রিগ্যানের সুরে সুর মেলালেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল মোহাম্মদ জিয়াউল হক। জিয়াও মনে করলেন, লাল ফৌজের পরাজয় নিশ্চিত না হলে এরপর চরম বিপন্ন হবে পাকিস্তান ও ইসলাম।
কিন্তু, 'পাকিস্তান ও ইসলামি আওয়াম বিপন্ন' এমন প্রচার ছিল- ইচ্ছেকৃতভাবে সত্যের বিকৃত উপস্থাপন। বাস্তবতা হলো, ক্রমশ ধসে যাওয়া অর্থনীতি নিয়ে সোভিয়েতরা আরও ৮০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে উপকূল পর্যন্ত এলাকা দখলে যেত না।
তাছাড়া, রাষ্ট্রীয় নীতির ওই ভ্রষ্টতা ধরা পড়ে কয়েক দশক পরই, আরেকদল নাস্তিক কমিউনিস্টদের আগমনে, যাদের গুরুত্বপূর্ণ ওই জলরাশিতে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে ইসলামাবাদ। এবার কিন্তু তাতে স্বর্গের পতন হয়নি।
এবারের সমাজতন্ত্রী নাস্তিকরা হলো বেইজিংপন্থী। তাদের আনতে অধীর আগ্রহী পাকিস্তান কিন্তু লাল গালিচা বিছিয়েই অভ্যর্থনা দিয়েছে; আর মখমল মাড়িয়ে গোয়াদার বন্দরে প্রবেশ করেছে চীনারা। উইঘুর মুসলিমরা নিরাপদে না থাকলেও- জিয়াউল হকের চরম বিপদের পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণিত করে ইসলাম এবার কম্যুনিস্টদের দ্বারা বিপন্ন হয়নি। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দৃষ্টিকোণ সেটাই তুলে ধরছে।
গোপন অপারেশন:
আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন পরবর্তীকালে যা হয়েছিল- তা আজ মোটামুটি সবারই জানা। ইসলামাবাদে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস এসময় দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গোপন অপারেশন শুরু করে। মুসলিম বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়োগ দেওয়া হয় আফগান জিহাদে। আর এ প্রকল্পে পর্যাপ্ত অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা- সিআইএ'র সহযোগী হয়েছিল পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তাদের সমর্থনে সিআইএ বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক জিহাদ সৃষ্টি করে।
সোভিয়েত আগ্রাসনের এক দশক পর পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা- আইএসআই- এর তৎকালীন প্রধান জেনারেল হামিদ গুল সাংবাদিকদের সামনে রীতিমতো গোঁফে তা দিতে দিতেই বিশ্বকে সদম্ভে জানান যে, তিনি ও তার সংস্থার কর্মীরাই সোভিয়েত দৈত্যকে বধ করেছেন।
তবে পাকিস্তান যদি যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্নায়ুযুদ্ধকালীন শত্রুকে বিনাশ করার সুযোগ না দিত, তাহলে কি ঘটতে পারতো- সেদিকটাও খতিয়ে দেখা উচিত। যদি পাকিস্তান সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় জিহাদি গোষ্ঠীগুলোকে সৃষ্টি না করতো, যদি অস্ত্র ও অর্থ না দিত এবং প্রতিরোধ সংগঠিত না করতো- তাহলে কী ঘটতো? আফগানিস্তানের ওপর যখন কেয়ামত নেমে এসেছিল সেই মুহূর্ত ঘিরে এসব প্রশ্ন তোলার কৌতূহল দমিয়ে রাখা যায় না।
বহিঃশক্তির কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না হলে আফগান কমিউনিস্ট ও ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে সাওর বিপ্লবকারীরা একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়ে বছর তিনেকের মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ব বিলীন করে দিত। তাতে করে ১০ থেকে ২০ লাখ আফগানের মৃত্যু হয়তো হতো না, সম্পূর্ণ ধবংসস্তূপ হতো না আফগানিস্তান। বড়জোর উভয়পক্ষে মাত্র কয়েক লাখ মৃত্যু হতো।
আফগান কমিউনিস্টদের দুই দল- খালক আর পারচাম পার্টি শহরের বাইরে গ্রামীণ অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে কোনোদিনই জনপ্রিয়তা পায়নি। দুর্গম গ্রামীণ এলাকার মানুষ তাদেরকে সমর্থনও দিত না। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য প্রেসিডেন্ট দাউদের বিরুদ্ধে সামরিক ক্যু'র বিরোধী ছিল। তাই অভ্যুত্থানকালে খালক আর পারচামপন্থীরা একে-অপরের বিরুদ্ধে উন্মত্তের মতো লড়েছে।
এসময় অভ্যুত্থানকারী পারচামদের নেতৃত্বে উঠে আসেন রক্তপিপাসু খুনী বলে পরিচিত হাফিজুল্লাহ আমিন। কিন্তু, তার শাসনকাল মাত্র তিন মাস স্থায়ী হয়।
তবে আফগানিস্তানের ভাগ্যে নিজ সমস্যা নিজেরাই সমাধানের নিয়তি ছিল না। তাইতো খালক ও পারচামপন্থীদের লড়াই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া মাত্র- ব্যর্থ হতে চলা সাওর বিপ্লবের পেছনে সমর্থন দিয়ে হস্তক্ষেপ করে মস্কো। ক্ষমতায় বসায় বাবরাক কারমাল নামের এক পারচাম নেতাকে।
এ ঘটনায় বিপদের চরম বিপদের ছায়া দেখে ওয়াশিংটন। এসময় যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে বলে, আফগানিস্তানের পতন হলে সোভিয়েত শক্তির দাপটে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে । তবে মুখে যাই বলুন, মার্কিন নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারেন যে, রাশিয়ার দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর এটাই মোক্ষম সুযোগ। এভাবেই যুদ্ধ শুরু হয়।
১৯৮৫ সাল নাগাদ আফগান যুদ্ধে ক্লান্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটি ছেড়ে যাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। তবে ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না রিগ্যান প্রশাসনের 'যুদ্ধংদেহী' একটি পক্ষ, ঐতিহাসিক ইকবাল আহমেদ এদেরকে 'ব্লিডার' নামে আখ্যায়িত করেছেন। রিগ্যানের সহকারী-প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিচার্ড পার্লের মতো ব্লিডাররা চাইছিলেন আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের আরও রক্ত ঝড়াতে, কমিউনিস্টদের জন্মের শিক্ষা দিতে। অচিরেই এ দলভুক্তরা ওয়াশিংটনের রাজনীতিক মহলে সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। তারা আফগানিস্তান যুদ্ধকে রাশিয়ার প্রধান সমস্যা হিসেবে তুলে ধরেন।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানের কল্যাণে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে পাওয়া মনোযোগ তখন চুটিয়ে উপভোগ করছিল পাকিস্তান। প্রতিনিয়ত আসছিল বিমানভর্তি নগদ অর্থ। জেনারেল জিয়া এসময় সোভিয়েতদের সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাবকেও প্রত্যাখ্যান করেন।
সোভিয়েত পরবর্তী তালেবান যুগ:
কমিউনিস্টদের উচিত শিক্ষা দিয়ে আমেরিকা তো বিজয়ীর বেশে ফিরে গেল, সুর্যাস্ত দেখা দিল সোভিয়েত সাম্রাজ্যে। কিন্তু, যে মুজাহেদিনদের রিগ্যান হোয়াইট হাউজে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান, তারাই যে পরবর্তীতে 'ডেল্টা ভেরিয়েন্ট' হবে উঠবে- সেটা হয়তো তিনি বুঝতে পারেননি।
মুজাহেদিনদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব আর লড়াইয়ের সুযোগ নেয় তালেবান। অভিযোজিত নতুন এ শক্তি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে গুড়িয়ে দিতে আল কায়েদাকে সাহায্য করে। এর আগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে উগ্রপন্থীদের ওয়াশিংটন ব্যবহার করেছিল, এবার তাদেরকেই ধবংস করার হুঙ্কার দিয়ে, আফগানিস্তানকে 'সভ্য' করার অঙ্গীকার ঘোষণা করে।
কিন্তু, হায় সাম্রাজ্যের কবরিস্তানে বিজয়ী কে হয়েছে? ২০ বছর পর আমেরিকাকেও ফিরতে হয়েছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মার্কিনীরা হারিয়েছে তাদের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মনোবল আর পরাক্রান্ত শক্তির অহমিকা। অনেকেই বলবেন, বেশ হয়েছে, এতদিনে ন্যায়বিচার হয়েছে। বাস্তবিক অর্থে- অল্পস্বল্প হলেও আফগানিস্তানের মাটিতে আমেরিকার বিচার হয়েছে।
নাকে খত দিতে দিতে মার্কিনীরা আফগানিস্তান ছাড়ার কালে দেশটির সামনে দোযখের দুয়ার খুলে রেখে যাচ্ছে। কারণ, একের পর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নিচ্ছে তালেবান। মুখ থুবড়ে পড়েছে শান্তি আলোচনায় সুরাহার আশা। এরপর বড় শহরগুলোর পতন শুরু হওয়া মাত্র ফিরে আসতে পারে সেই ১৯৯৬ সালের চিত্র। যখন কাবুলের ল্যাম্পপোস্টে ঝুলেছে ফাঁসি দেওয়া লাশ, পুরুষদের দাঁড়ি রাখতে বাধ্য করা হয়েছে এবং নারীদের ওপর বোরখা চাপিয়ে দিয়ে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল।
আফগানিস্তানের করুণ পরিণতির জন্য রাশিয়া আর আমেরিকা উভয়েই প্রাথমিকভাবে দায়ী। কথায় আছে, হাতির লড়াইয়ে ঘাসের জঙ্গল সমান হয়, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে পাকিস্তান এ দুইয়ের কাতারে পড়ে না। পাকিস্তানের ভূ-রাজনীতির অন্যতম কুশীলব জেনারেল মির্জা আসলাম বেগ শুধুমাত্র ভারতীয় হুমকি মোকাবিলাকে মাথায় রেখে আফগান নীতি প্রণয়ন করেন।
তাই কয়েক দশক ধরে তালেবান নেতা, যোদ্ধা ও তাদের পরিবারকে বাসস্থান, স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা দিয়েছে পাকিস্তান। তাই আমরা যখন একথা অস্বীকার করি, তখন কেউই তা বিশ্বাস করে না।
আফগানিস্তানকে সভ্য দেশ হতে হলে সবার আগে একটি সাংবিধানিক শাসন কাঠামোয় পরিচালিত হতে হবে; যে ব্যবস্থা ইসলামিক মূল্যবোধের পাশাপাশি সকলের মত-প্রকাশের অধিকার, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করবে। কিন্তু, যুদ্ধবাজরা ক্ষমতা দখল করলে পরবর্তী বিপর্যয়ে পড়বে দেশটি।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে আর্মি পাবলিক স্কুলে শিশুদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি তালেবান। ভুলে গেলে চলবে না এরা আফগান তালেবানের আদর্শিক সহোদর। এদের একদল চায় কাবুলের দখল, আরেকদল চাইছে ইসলামাবাদের পতন। লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হলে তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। তাই আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বার তালেবান শাসন ফেরার চাইতে সেখানে সাংবিধানিক গণতন্ত্র সুনিশ্চিত হলেই পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থপূরণ হবে।
লেখক: পারভেজ আমিরালি হুদভয় একজন পাকিস্তানী পরমাণু বিজ্ঞানী এবং অধিকার কর্মী। তিনি জোহরা অ্যান্ড জেজে ফাউন্ডেশনে যুক্ত আছেন এবং ফোরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজের সম্মানীয় অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। পাকিস্তানে বাক-স্বাধীনতা, ধর্মীয় উদারবাদ, বিজ্ঞান চর্চা ও শিক্ষা বিস্তার নিয়ে সরব ভূমিকা রেখে চলেছেন তিনি।
- সূত্র: দ্য ডন