আমিরাতের সঙ্গে চুক্তিতে লাভটা শুধু ইসরায়েলের
মধ্যপ্রাচ্যে ঐতিহাসিক অর্জনের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। গত মঙ্গলবার (যুক্তরাষ্ট্র সময়) ওয়াশিংটনের মধ্যস্ততায় ইসরায়েল এবং আরব আমিরাতের মধ্যে চুক্তিকে ঘিরে এ দাবি করা হয়। চুক্তিটির আওতায় এখন থেকে প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক করবে দেশদুটি। এর বিনিময়ে অবশ্য পশ্চিম তীরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের জন্য নির্ধারিত ভূমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া বন্ধ রাখবে ইসরায়েল।
চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর আমিরাত ও ইসরায়েলের দেওয়া যৌথ বিবৃতি টুইটারে নিজ অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। পোস্ট করার সময় তিনি লেখেন, ''বিশাল এক অর্জন এসেছে আজ। আমাদের ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ঐতিহাসিক এক শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।''
চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের বিবৃতিতে বলা হয়, ''মধ্যপ্রাচ্যে এ চুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখবে। তিন নেতার (ডোনাল্ড ট্রাম্প, নেতিনিয়াহু ও বিন জায়েদ) দূরদর্শী কূটনীতিক বিবেচনা এবং লক্ষ্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এ চুক্তি। যার মধ্যে দিয়ে অত্র অঞ্চলে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে আমিরাত ও ইসরায়েল।''
''কূটনীতিক সমঝোতার আলোকে; মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুরোধে এবং আরব আমিরাতের সমর্থনের কারণে- ইসরায়েল নির্দিষ্ট এলাকার উপর নিজ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ রাখবে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার আওতায় আরব এবং মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ হিসেবে ইসরায়েল এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে'' আর জানায় বিবৃতিটি। খবর মেমো ও মিডল ইস্ট আইয়ের।
অর্জন না বিসর্জন:
আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অধিগ্রহণ সম্পূর্ণ বন্ধ করেছে বলে আনন্দ প্রকাশ করেছেন। দাবি করেছেন তিনি বিশাল কিছু জয় করে ফেলেছেন।
এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ''প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতিনিয়াহুর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়েছে। যা ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ড অধিগ্রহণ বন্ধ করবে।''
যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে; ইয়েমেনে আগ্রাসন, মিশরে সিসি সরকার প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক মতামত দমনের মতো- আরব এবং মুসলিম বিশ্বের চোখে যেসব অপরাধ করেছেন বিন জায়েদ, নিজের হাত থেকে সেই কলঙ্কের দাগ মুছে যাবে এমন আশা করেন এ চুক্তির মাধ্যমে।
তবে ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি তার প্রতিষ্ঠিত অপরাধের তালিকা ভারি করেছে, কমায়নি একটুও। গৌরব তিলক নয়, বরং আরেক কলঙ্কের তাজ মাথায় পড়লেন বিন জায়েদ। জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালালেও- দিন শেষে সত্যটি ছিল পরিষ্কার। আলোচ্য চুক্তির পর দেওয়া যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আপাতত বাতিল করা হয়েছে।
এ বাতিলও বিন জায়েদের জন্য কোনো বিজয় নয়, যার মূল কারণ দুইটি। প্রথমত, আলোচ্য অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার সতর্কবানীতে ইতোমধ্যেই স্থগিত রেখেছে ইসরায়েল। তবে এনিয়ে পরস্পর বিরোধী কিছু কথাও শোনা যায়। ইসরায়েলি এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু সংবাদে বলা হচ্ছে, অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াটি এখনও ইসরায়েলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের আলোচনার টেবিলে রয়েছে। অন্যকিছু সংবাদে বলা হচ্ছে, এসব আলোচনা আপাতত বন্ধ আছে। সত্য যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে- দখলদার ইসরায়েলি নেতৃত্বের চিন্তা থেকে এ পরিকল্পনা মোটেও দূর হয়নি।
চুক্তিটি ফিলিস্তিনিদের জন্য অন্তসার শূন্য হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হলো; ইসরায়েলের পরিকল্পিত অধিগ্রহণ আজ হোক বা কাল অবশ্যই আবার শুরু হবে। তাই বাস্তবিক অর্থে তো নয়ই- বিন জায়েদ চুক্তিতে কাল্পনিক অর্জনও করতে পারেননি। চুক্তিটি প্রকৃতপক্ষে যার অর্জন, তিনি হচ্ছেন- ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতিনিয়াহু। কারণ, চুক্তির ঘোষণায় স্পষ্ট করেই উচ্চারিত হয়েছে, এর মাধ্যমে আরব আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতার মাত্রা বাড়বে।
লাভবান হয়েছে ইসরায়েল:
''দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় আনা এবং শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মদ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং বিশ্বস্ত দুই আঞ্চলিক সহযোগী পরস্পরের আরো ঘনিষ্ঠ হবে। এখন মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক, বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা বৃদ্ধির যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-কৌশলগত লক্ষ্য পূরণে সহযোগী হিসেবে একত্রে কাজ করতে পারবে দেশদুটি'' চুক্তির ঘোষণায় আরো জানানো হয়।
তাই একে ফিলিস্তিনিদের জন্য নিজের অর্জন দাবি করে বিন জায়েদ তাদের সীমাহীন আত্মত্যাগ, ভোগান্তি এবং সংগ্রামকে চূড়ান্ত অসম্মান করেছেন। বিশেষ করে, যখন খোদ আমিরাতেই তার নির্দেশে ফিলিস্তিনি অধিকার কর্মীদের ধরপাকড় চলছে- তখন এ দাবি আরো অসঙ্গতিপূর্ণ।
আমিরাতে ফিলিস্তিনি প্রবাসীরাও ভিসার মেয়াদ বাড়াতে পারছেন না সহজে। ইচ্ছে করে দেরি করিয়ে হোক বা হয়রানিমূলক জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে; প্রতিনিয়ত তাদের জীবনকে চাপের মুখে রাখা হচ্ছে। চলমান মহামারির মাঝেও যা বন্ধ হয়নি।
ফিলিস্তিনিদের দমন:
''আমিরাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রত্যাশী ফিলিস্তিনিদের কয়েক দফা জেরা এবং সরকারি তদন্তের সম্মুখীন হতে হয়। এসব ছাড়া সেখানে ফিলিস্তিনিদের জন্য চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবার সুযোগ পাওয়া বর্তমানে একেবারেই অসম্ভব'' বলছিলেন সম্প্রতি আমিরাত ত্যাগ করে চলে যাওয়া এক ফিলিস্তিনি- আবু ফাহদ দাবাশাহ।
তিনি আরো জানান, ''উপসাগরীয় দেশটিতে ফিলিস্তিনিদের দূর্ভোগ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে, তৈরি হচ্ছে শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা।''
এতকিছুর পর বিন জায়েদ অন্তত ফিলিস্তিনিদের জন্য সাফল্য অর্জনের দাবি করতে পারেন না। ফিলিস্তিনিদের বন্ধু হলে তিনি তাদের শত্রুর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টা করতেন না।
বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়, ওয়াশিংটনে নিযুক্ত আমিরাতি রাষ্ট্রদূতের ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক লেখায়; সেখানে তিনি রাখঢাক ছাড়াই বলেন, ''ইসরায়েল শত্রু নয়, বরং একটি সম্ভাবনা।''
বস্তুত, ইসরায়েল ও আমেরিকার স্বার্থরক্ষায় মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স। এজন্যেই ২০০৬ সাল থেকেই ফিলিস্তিনিদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দমন করার চেষ্টায় বিন জায়েদের যে ভূমিকা-ফিলিস্তিনি জাতি বা মুসলিম বিশ্ব তাকে কোনোদিনই ক্ষমা করবে না।
আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়া:
আমিরাত-ইসরায়েল চুক্তি নিয়ে প্রতিক্রিয়া আরব বিশ্বের বিভাজন আরো স্পষ্ট করে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ দেশগুলো এ চুক্তিকে স্বাগত জানালেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষায় সমর্থন দেওয়া রাষ্ট্রসমূহ।
বাহারাইন:
ইসরায়েল এবং আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগের প্রশংসা করে একে স্বাগত জানিয়েছে বাহারাইন।
রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা- দেশটির সরকারের এক মুখপাত্রের বরাত দিয়ে জানায়: ''সংযুক্ত আরব আমিরাতের গৃহীত কূটনীতিক প্রচেষ্টাকে আমরা স্বাগত জানাই। ঐতিহাসিক এ পদক্ষেপ আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার আবহকে শক্তিশালী করবে।''
মিশর:
মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল-সিসি এ প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, তিনি আশা করছেন চুক্তিটি ইসরায়েলের ভূমি অধিগ্রহণ পরিকল্পনা বন্ধ করে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার সহযোগী হবে।
''আমাদের অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি আনয়নের এ চুক্তিটির মূল কুশীলবদের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই'' বলেন সিসি।
ইরান:
আমিরাত ও ইসরায়েলের মধ্যকার চুক্তিকে ''কৌশলগত মুর্খতার'' চুক্তি বলে সমালোচনা করেছে ইরান। ঐতিহাসিক এ চুক্তির ফলে সৃষ্ট পরিণতি মেনে নিতে আবু ধাবিকে সতর্ক করে দেশটি।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ''আবুধাবির এ সিদ্ধান্ত আসলে কৌশলগত মুর্খতার প্রতীক। এর মাধ্যমে অত্র অঞ্চলে ওয়াশিংটন-তেল আবিভ এবং আবুধাবির প্রভাবই শুধু বাড়বে।''
এসময় আরো বলা হয়, নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনতা এবং পৃথিবীর স্বাধীন দেশগুলো অপরাধী দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের এ পদক্ষেপকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। এর মধ্য দিয়ে আমিরাত ইসরায়েলের অপরাধের সহযোগী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের নাম লেখাল।
জর্ডান:
চুক্তিটির প্রশংসা বা সমালোচনা কোনটাই করেনি- ইসরায়েলের প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্র জর্ডান। তবে সতর্ক এক প্রতিক্রিয়ায়; চুক্তির প্রভাব ইসরায়েলের কার্যকালাপের মাধ্যমেই নির্ধারিত হবে, বলে দেশটি জানিয়েছে।
জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান আল-সাফাদি বলেন, ''আলোচিত সমঝোতার পর ইসরায়েল কী পদক্ষপে নেয় সেটাই এখন দেখার বিষয়, তার উপরই শান্তিচুক্তির ফলাফল নির্ভর করছে।''
এসময় তিনি আরো বলেন, ''ইসরায়েলি দখলদারিত্ব অবসান এবং স্থায়ী ফলপ্রসূ শান্তি প্রতিষ্ঠার যেকোনো উদ্যোগকে জর্ডান সব সময়েই সমর্থন দেয়। বিশেষ করে, ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নেওয়া সকল পদক্ষেপকে আমরা সমর্থন করি।''
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ:
চুক্তি ঘোষণার পরই সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিযুক্ত নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয় পশ্চিম তীরের পশ্চিমা অনুমোদিত সরকার। স্বাভাবিকীকরণের তীব্র প্রতিবাদ হিসেবে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিয়াদ-আল-মালিকি বার্তা সংস্থা এএফপি'কে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, ''প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নির্দেশে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষনিকভাবে আমিরাতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে তলব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।''
তুরস্ক:
মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক আমিরাত-ইসরায়েল চুক্তির নিন্দা করেছে। একে ''ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার সমঝোতা'' বলে সমালোচনা করে আঙ্কারা।
''নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে আমিরাত একে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য করা ত্যাগ হিসেবে প্রচার করার চেষ্টা চালাচ্ছে'' জানায় তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতি।
সেখানে আরো বলা হয়, '' ইতিহাস এবং এ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ কখনই একে ক্ষমা করবে না এবং আমিরাতের ভণ্ডামি আচরণের কথাও তারা মনে রাখবে।''