এশিয়ায় সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী দেশ? যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে থাকলেও চীন দ্রুত ব্যবধান কমিয়ে আনছে
কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবিলায় অব্যবস্থাপনার কারণে বিশ্বব্যাপী যখন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি সঙ্কট তৈরি হয়েছে, ঠিক তখনই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বাড়ছে চীনের। এ অঞ্চলে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্র হলেও, চীন যে দ্রুত সে ব্যবধান কমিয়ে আনছে- সাম্প্রতিক এক গবেষণাতে সেটাই উঠে আসে।
রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক আর ক্ষমতার বলয় নিয়ে এ গবেষণা করেছে সিডনি ভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক লোয়ি ইনস্টিটিউড।
সংস্থাটির প্রতিবেদনে সেরা পরাশক্তি হিসেবে এখনও এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকেই সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ বলে উল্লেখ করা হয়। পররাষ্ট্র সম্পর্কের বিবেচনায় এ অঞ্চলে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দেশ- যুক্তরাষ্ট্র দুই বছর আগে চীনের চাইতে দশ পয়েন্ট এগিয়ে ছিল। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে সেই ব্যবধান পাঁচ পয়েেন্ট নেমে এসেছে।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৬টি দেশ ও স্বশাসিত ভূখণ্ডে বিদেশি রাষ্ট্রের প্রভাব স্থান পায়- লোয়ি ইনস্টিটিউডের এশিয়া পাওয়ার ইনডেক্স' শীর্ষক চলতি বছরের তালিকায়।
গবেষণায় নেতৃত্ব দেন লোয়ি'র এশীয় শক্তি এবং কূটনীতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক হার্ভে লামাহিউ।
মহামারি মোকাবিলায় দুর্বল নেতৃত্ব, একাধিক বাণিজ্য বিরোধ এবং সেই কারণে বেশকিছু বহুপাক্ষিক চুক্তি থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়া; এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের 'মর্যাদাহানি' করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ব্লুমবার্গকে দেওয়া টেলিফোন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ''বিশ্ব মহামারি সব হিসাব দ্রুত বদলে দিয়েছে। এ সঙ্কট যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দ্বিধারি তলোয়ার হয়ে ওঠে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় নেওয়া দুর্বল পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কেবল দেশটির সুনাম নষ্ট করেনি, পাশাপাশি এর ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উঠে আসতেও অনেক বছর সময় লেগে যাবে।''
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি প্রাক-মহামারি পর্যায়ে ফিরে আসতে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময় নিতে পারে, বলে ইনস্টিটিউটটি জানিয়েছে। বিপরীতে, চীনের অর্থনীতি মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে সচল হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালে বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীনই প্রবৃদ্ধি উত্তরণের পথে থাকবে, ইতোমধ্যেই এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে।
বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক পরাশক্তির এ উত্থান, আগামী এক দশকে এশিয়া- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রতিবেশীদের কাছে চীনের গুরুত্ব আরও বাড়াবে।
উহান নগরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সময় প্রথমদিকে চীন সে তথ্য গোপন করেছিল, বলে ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্র-সহ নানা পশ্চিমা দেশ সমালোচনা করে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ভারতের মতো এশীয় মিত্র দেশগুলোও এনিয়ে বেইজিংয়ের নিন্দা করেছে।
তারপরও, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অবিশ্বাস্য সফলতা দেখিয়েছে চীন। এবং দ্বিতীয় শীর্ষ প্রভাবশালী দেশ হিসাবে টানা তিন বছরের ন্যায় নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে।
অবশ্য, এর আগে প্রতিবেশীদের সঙ্গে বেপরোয়া মনোভাবের 'লোন উলফ' পররাষ্ট্রনীতি চীনের ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষুণ্ণ করেছিল, বলে উল্লেখ করেন লামাহিউ।
নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে চীনের সঙ্গে আরেক দফা কূটনৈতিক বাগযুদ্ধের শঙ্কা করছেন তিনি। তবে, এই মুহূর্তেই চীনের জন্য অত্র-অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পূর্ণ বিকল্প শক্তি হয়ে ওঠা কঠিন হবে, সেকথাও জানিয়েছেন।
''তবে আমি মনে করি এক সময় চীন আন্তর্জাতিক প্রভাবের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমান পর্যায়ে চলে আসবে এবং এই দশকের শেষভাগে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অবশ্য, সেই এগিয়ে যাওয়াটাও খুব বড় ব্যবধানের হবে না,'' লামাহিউ বলছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ''ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিত হলে এশিয়ার অধিকাংশ দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা এড়িয়ে চলবে। কিন্তু, জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে পরিস্থিতি বদলাবে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করতেই বেশি আগ্রহী হবে এশিয়া-প্যাসিফিকের দেশসমূহ।''
এশিয়ার অন্যান্য প্রভাবশালী দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে জাপান। তারপরের চতুর্থ স্থান ভারতের। তবে মহামারিতে দেশটির অর্থনীতি পর্যদুস্ত এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধির উচ্চ-সম্ভাবনা হারিয়ে গেছে। এর মধ্যেই হিমালয়ের বিতর্কিত অঞ্চলে চীনের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ 'বিশাল অঞ্চল' হারিয়েছে দেশটি। যদিও, দেশটির নেতৃত্ব এবং সরকার সেকথা স্বীকার করতে নারাজ।
তবে লোয়ি ইনস্টিটিউডের অনুমান, ২০৩০ সাল নাগাদ চীনের সামগ্রিক উৎপাদন অর্থনীতির মাত্র ৪০% অর্জন করতে পারবে ভারত। গত বছর তা ৫০ শতাংশ অনুমান করা হয়েছিল।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশীয় দেশগুলোতে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ দিনে সাড়ে ৫ মার্কিন ডলারের কম আয়কারী নতুন দরিদ্রে পরিণত হতে পারেন। মহামারি এজন্য দায়ি বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়- ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউড ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্স রিসার্চ।
মহামারির আগে বাকি বিশ্বের অর্থনীতির চাইতে এশীয় দেশগুলোর মোট অর্থনীতি বড় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখিয়েছিল। কিন্তু, এখন জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়, আর্থ-সামাজিক এবং কৌশলগত নানামুখী চ্যালেঞ্জে পড়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রে। লোয়ির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে একথাও তুলে ধরা হয়।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ