কোভিডের অননুমোদিত ওষুধ বন্ধের আহবান, বাবা রামদেবের বিরুদ্ধে ভারতীয় চিকিৎসকেরা
কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য আধুনিক ওষুধকে নাকচ করে দিয়ে অননুমোদিত বিকল্প ওষুধ ব্যবহারের নিন্দা জানিয়েছে ভারতীয় মেডিকেল এসোসিয়েশন।
গত মাসেই ভারতের যোগব্যায়াম গুরু রাম কিষাণ যাদব ('বাবা রামদেব' নামেও পরিচিত) অ্যালোপ্যাথি বা প্রমাণভিত্তিক ঔষধাদিকে 'মূর্খ বিজ্ঞান' বলে অভিহিত করে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন। রামদেব আরো দাবি করেন যে হাজার হাজার মানুষ আধুনিক ওষুধ গ্রহণের ফলে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। নিজের যুক্তি দাঁড় করাতে তিনি রেমডেসিভির ও ফ্যাবিফ্লু এর মতো ওষুধের প্রসঙ্গ টানেন।
রামদেবের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ভারতীয় মেডিকেল এসোসিয়েশন (আইএমএ) দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন বরাবর একটি চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, 'স্বামীজী যা যা করছেন তা শুধুমাত্র পরিস্থিতির সুযোগ নেয়া এবং জনগণের মধ্যে মিথ্যা ভয়ভীতি ও হতাশা তৈরি করার প্রচেষ্টা; যাতে করে তিনি নিজের অবৈধ ও অননুমোদিত ওষুধগুলো বিক্রি করতে পারেন এবং জনগণের জীবনের বিনিময়ে নিজে টাকার পাহাড় গড়তে পারেন।'
যদিও রামদেব পরবর্তীতে নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়ে জানিয়েছেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি তার কোনো মন্দ উদ্দেশ্য নেই।
রামদেব দাবি করেন যে, তিনি নিয়মিত যোগব্যায়াম করেন ও আয়ুর্বেদ দ্বারা সুরক্ষিত থাকায় তার কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হয়নি। ভারতের ফেডারেশন অফ রেসিডেন্ট ডক্টরস এসোসিয়েশনের (ফোরডা) প্রেসিডেন্ট মনীশ বলেন, 'রামদেব সাধারণ মানুষের মনে গুজব ছড়াচ্ছেন এবং চিকিৎসক গোষ্ঠীকে অপমান করছেন। অনেক মানুষ এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। আমরা নিজের পরিবার ও প্রিয়জনকে পর্যন্ত ঝুঁকিতে ফেলছি নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। তাই তার এ ধরনের বিবৃতি দেয়া অনুচিত। সরকারের উচিত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া।'
গত মে মাসে ভারতে কোভিড বিপর্যয়ের ফলে অক্সিজেন ঘাটতি দেখা দিলে রামদেব সাধারণ মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, তারা যেন 'ঈশ্বর প্রদত্ত ফুসফুস' ব্যবহার করে নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য। এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আইএমএ'র ভাইস প্রেসিডেন্ট নবজোত সিং দাহিয়া তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান।
রামদেবের কথার গুরুত্ব কতটুকু
যোগব্যায়াম গুরু হিসেবে ভারতে বাবা রামদেবের বিশেষ জনপ্রিয়তা রয়েছে। ইতিমধ্যেই তিনি বেশ উচ্চাসনে পৌঁছেছেন এবং তার অসংখ্য অনুসারী রয়েছে। তিনি যোগব্যায়াম নিয়ে বিশাল বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন এবং সেই সেশনগুলো তার নিজস্ব টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়। এছাড়াও, তিনি 'পতঞ্জলি আয়ুর্বেদ' নামক একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিরও মালিক। তার এই কোম্পানি খাবার থেকে শুরু করে সাবান পর্যন্ত নানা ভোগ্যপণ্য বিক্রি করে।
ক্ষমতাধীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে রামদেবের। এদের মধ্যে রয়েছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ থেকে শুরু করে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও।
রামদেব কোভিড-১৯ মোকাবিলার জন্য নিজের আবিষ্কৃত ভেষজ মিশ্রণ 'করোনিল' ব্যবহার করা যাবে বলে দাবি করেন। এই মিশ্রণটি এখনো চিকিৎসা পরিষদ দ্বারা অনুমোদিত নয়। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন নিজে একজন অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার হওয়া সত্ত্বেও রামদেবের এই ভেষজ ওষুধ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
রোগ মোকাবিলায় আয়ুর্বেদ ও ঘরোয়া চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার ভারতে অত্যন্ত পরিচিত একটি দৃশ্য। চিকিৎসক গোষ্ঠীও এখন পর্যন্ত সরাসরি এসব পদ্ধতির ব্যবহার বন্ধ করতে বলেননি। এমনকি সরকারের একটি এজেন্সিও রয়েছে। এই 'আয়ুশ মন্ত্রণালয়' বিকল্প ওষুধের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করে।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রামদেবের আবিষ্কৃত ওষুধগুলো চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনো শাখার মধ্যেই পড়ে না। রামদেব মিথ্যা দাবি করে এও জানান যে 'করোনিল' বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত একটি ওষুধ। যোগব্যায়াম গুরুর ওষুধের ব্র্যান্ডের প্রতি অনেকের বিশ্বাস থাকলেও, ডাক্তাররা জানিয়েছেন যে তার এসব ওষুধের কার্যকারিতার পেছনে কোনো যৌক্তিক প্রমাণ তো নেইই; বরং করোনাকালে এসব ওষুধ ব্যবহারের ফলে বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের 'ব্ল্যাক ডে' প্রতিবাদ
বাবা রামদেবের দেয়া বক্তব্যের বিরুদ্ধে গত ১ জুন সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের নিয়ে 'ব্ল্যাক ডে' নামক প্রতিবাদ মঞ্চায়ন করেছে ফোরডা।
'সারা দেশ থেকে আমাদের ১০ হাজার স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এই প্রতিবাদ সভায় যোগ দেন, তবে এর ফলে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়া থেমে থাকেনি। আমরা কালো ব্যাজ ও আর্মব্যান্ড পরেছিলাম। কেউ কেউ তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রোফাইল ছবি বদলে একদম কালো ছবি দিয়েছে।'
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবিতে দেখা যায়, ডাক্তাররা 'হাতুড়ে ডাক্তার রামদেব'কে গ্রেপ্তারের দাবিতে পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। টুইটারেও দেখা গেছে 'অ্যারেস্ট রামদেব' হ্যাশট্যাগ।
আইএমএ আরো বলে যে রামদেবের বক্তব্য একটি 'অপরাধ' এবং তারা এর জন্য ভারতের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনে রামদেবের বিচার দাবি করেন।
'রামদেব ভেবেছিল দেশের কোভিড-১৯ চিকিৎসা প্রটোকল ও জাতীয় টিকাদান কর্মসূচীর বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের বাণিজ্যিক পণ্যের ব্যবসা চালিয়ে নেবে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে এহেন কাজের মাধ্যমে সে সরকারের মহামারি নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার অপূরণীয় ক্ষতি করছে', বলে আইএমএ।
এদিকে সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভারতে করোনাভাইরাসের আক্রমণে এখন পর্যন্ত ১২০০ ডাক্তারসহ ৩৩০,০০০ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।
- সূত্র-ডয়েচে ভেলে