কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন হয়তো কখনই সম্ভব হবে না
গত বছরের শুরুতে যখন বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের তাণ্ডবলীলা শুরু হয়, তখন বাঁচার উপায় হিসেবে অনেকেই 'হার্ড ইমিউনিটি'র আশা করেছিলেন। যেকোনো রোগ বা মহামারির ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি এমন একটি অবস্থাকে নির্দেশ করে, যখন জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায় এবং ভাইরাসটি বিস্তারের জন্য যথেষ্ট বাহক না পাওয়ায় ধীরে ধীরে তার অবসান ঘটে। করোনা মহামারির বিরুদ্ধে হার্ড ইমিউনিটির এই ধারণা গবেষকদের কাছে এখন অনেকটা কল্পনাপ্রসূতই মনে হচ্ছে।
অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সংক্রমণ ছড়াতে থাকা ভাইরাসটির ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট হার্ড ইমিউনিটির আশাকে ম্লান করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মত দেশগুলোয়, যেখানে মোটামুটি ৫০ শতাংশের উপরে জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া হয়েছে সেখানেও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভাইরাসটি নির্মূল করতে সক্ষম হওয়া আস্ট্রেলিয়া কিংবা চীনের মত দেশগুলোতেও নতুন করে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ হতে দেখা গেছে।
ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা অ্যান্থনি ফাউসির মতো যারা হার্ড ইমিউনিটির আশা করেছিলেন, তারা বেশ বিতর্কে পড়েছেন।
মিনেসোটার মায়ো ক্লিনিকের ভ্যাকসিন রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক গ্রেগ পোল্যান্ড বলেন, "আমরা কি হার্ড কি ইমিউনিটি অর্জন করে পারবো? না, এটা প্রায় অসম্ভব।"
তিনি আরও বলেন, মর্ডানার মতো ৯৫ শতাংশ সুরক্ষা দেওয়া টিকাও হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করতে পারবে না। কারণ ভাইরাসটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ধরন বদলাতে এবং সংক্রমিত করতে সক্ষম।
প্রাকৃতিকভাবেও এই সমস্যার সমাধান হওয়ার তেমন সম্ভবনা নেই। কোভিড-১৯ এর মাঝে বেঁচে থেকে প্রাকৃতিকভাবে যতটুকু প্রতিরক্ষা ক্ষমতা মানবদেহ অর্জন করবে, তা কতদিন মানুষকে সুরক্ষা দিবে কিংবা ভাইরাসের নতুন ধরণের ক্ষেত্রে সেই সুরক্ষাব্যবস্থা কতটুকু কার্যকর হবে তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে গবেষকদের।
ভাইরাসটি এমন নয় যে, কেউ একবার সংক্রমিত হলে তার শরীরে পরবর্তী জীবনের জন্য শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে এবং তিনি আর সংক্রমিত হবে না। গবেষকদের মতে, নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা একই ব্যক্তির একাধিকবার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
ইতোমধ্যেই ব্রাজিল সহ দক্ষিণ আমেরিকার বেশকিছু দেশে ভাইরাসের নতুন ধরণের দ্বারা দ্বিতীয়বারের মতো সংক্রমণের চিত্র দেখা গেছে।
হার্ড ইমিউনিটি ব্যাতীত এই মহামারি দশকের পর দশক ধরেও চলতে পারে। তাই এখন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি কার্যক্রম ও সীমান্ত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তে পরিবর্তন নিয়ে আসাটাই হয়তো অধিক যুক্তিযুক্ত।
সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে চীন যেখানে ভাইরাসটি সম্পূর্ণভাবে নির্মূলের কৌশল অবলম্বন করেছিলো, এখন হয়তো দেশটিকে ধীরে ধীরে শিথিলতার পথে হাঁটতে হবে। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যও সংক্রমণের ঝুঁকির মুখেই বিধিনিষেধ শিথিল করেছে।
টিকার মাধ্যমে যতখানি সুরক্ষর আশা করা হয়েছিলো তা পূরণ হয়নি। বিশ্বের সর্বোচ্চ টিকা নিশ্চিতকারী দেশের মধ্যে অন্যতম ইসরায়েলে এখন বুস্টার ডোজ দেয়া হচ্ছে; কারণ টিকার কোর্স সম্পন্ন করার পরেও মানুষ সেখানে আক্রান্ত হচ্ছে।
বৈজ্ঞানিকদের মতে, হাম থেকে শুরু করে পোলিও'র মতো ভাইরাসঘটিত রোগগুলোর ক্ষেত্রে হার্ড ইমিউনিটি সত্যিই কাজ করে। এমনকি, পৃথিবী থেকে গুটিবসন্ত নির্মূল হয়েছে হার্ড ইমিউনিটির কল্যাণেই। এক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান করা এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখারও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলো। তবে, এটি একটি ভুল ধারণাকেই প্রসারিত করেছে।
"হার্ড ইমিউনিটিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করলে তা নিঃসন্দেহে হবে ক্ষতিকর"- বলেছেন মহামারি বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম হ্যানেজ।
যুক্তরাজ্যের মতো ইন্দোনেশিয়াও হার্ড ইমিউনিটিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলো প্রথমে। এরপর কোভিড-১৯ এর সাম্প্রতিক তাণ্ডবে দেশটি প্রায় দিশাহারা হয়ে পড়ে। তাই এখন সেদেশের সরকার জনসাধারণের মাঝে দ্বিগুণ হারে মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে; সেই সঙ্গে বুস্টার ডোজের কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে।
যদিও গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, হার্ড ইমিউনিটির অর্জন অনেকটা অসম্ভব, তারপরেও অনেক জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা এ ব্যাপারে একেবারে হাল ছেড়ে দিতে নারাজ। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী সরকার দেশে দেশে টিকার কর্মসূচিকে জোরদার করেছে। তবে টিকা স্বল্পতা সরকার কর্তৃক এই কর্মসূচিকে ব্যাহত করছে।
পৃথিবীর কোনো একটি দেশেও সংক্রমণের হার উচ্চ থাকার অর্থ হলো, পৃথিবীর প্রায় সবগুলো দেশই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকবে।
খুব দ্রুত হলেও ২০২২ সালের আগে এই মহামারি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে, ভাইরাসের ক্রমাগত ধরন পরিবর্তনে এই সময়সীমা অনির্দিষ্টভাবে বৃদ্ধিও পেতে পারে।
হয়তো নতুন কোনো শক্তিশালী টিকার আবিষ্কার এই ভাইরাসকে দ্রুত প্রতিরোধ করতে পারবে। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হলো এমন কোনো টিকা এই মুহূর্তে ট্রায়ালে নেই।
যেহেতু হার্ড ইমিউনিটির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ, তাই মাস্ক পরিধান, টিকা গ্রহণ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা হয়ত সংক্রামণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করতে পারে, বলে মত দিয়েছেন গবেষকগণ।
গবেষক গ্রেগ পোল্যান্ড ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু-এর কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, কোভিড-১৯ তারচেয়েও মারাত্মক হতে চলেছে। নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট বুস্টার ডোজের প্রতিরক্ষাকেও ভেদ করে আক্রমণ করতে পারে।
"তবে আমরা যদি ভাগ্যবান হই তাহলে কোভিড-১৯ একসময় ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো হয়ে যাবে, যেটা সবসময়ই আমাদের সঙ্গে থাকবে। প্রতিবছরই এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে, যেমনটা এখনও হচ্ছে। এবং আমাদেরকে শুধু টিকাই নিতে হবে"- বলেন পোল্যান্ড।
যদি এটা ফ্লু-এর মতোই হয়ে যায় তাহলে হয়তো এখন থেকে একশ বছর পরে পৃথিবী কোভিড-১৯ এর নতুন কোনো এক সংস্করণ দেখতে পাবে।
- সূত্রঃ ব্লুমবার্গ