জনপ্রিয়তার রাজনীতি বনাম স্বৈরশাসক
যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র এক মেয়াদে চার বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই সময়ের প্রায় পুরোটা জুড়ে বিরোধী রাজনীতিকরা তাকে অবহিত করেছেন একজন ফ্যাসিস্ট স্বৈরশাসক হিসেবে। শুধু ডেমোক্রেটরা নন, রিপাবলিকান দলের অনেকেও ট্রাম্পের সম্পর্কে এমন ধারণাই পোষণ করেন। কিন্তু, ট্রাম্প হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নেওয়ার পর তার সম্পর্কে আগের সংজ্ঞাটিও বাতিল হয়ে পড়ে। ইতালীয় যে নেতার সঙ্গে ট্রাম্পের ভীষণ মিল, তিনি বেনিতো মুসোলিনি নন বরং কেলেঙ্কারি তাড়িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি।
ধনকুবের বা জনপ্রিয় গণমাধ্যম সেলিব্রেটি থেকে রাষ্ট্রনায়ক হওয়া ট্রাম্প ও বার্লুসকোনির মতো ব্যক্তিত্বরা প্রধানত প্রতিষ্ঠিত ধ্যান-ধারণা ও রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে গিয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তারা জনগণের একটি ডানপন্থী অংশকে আরও ভীত-সন্ত্রস্ত করে বিচার- বিবেচনাহীন প্রতিশ্রুতির জোয়ারে ভাসান। এভাবে সমর্থকদের সঙ্গে তাদের পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের পেছনে যা ছিল প্রধান কারণ। তিনি ভয়, ঘৃণা কখনোবা বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে জনপ্রিয়তা পান।
পশ্চিমা গণতন্ত্রে ইদানীং এমন নেতাদের সংখ্যা কম নয়। চেক রিপাবলিকের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দেশটির সবচেয়ে ধনী আন্দ্রেজ ব্যাবিস। ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কো- ক্ষমতায় আসার আগে 'চকলেট কিং' হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তার উত্তরসূরি ভোলোদোমির জেলেনস্কি পেশায় ছিলেন একজন কৌতুকাভিনেতা। সত্যিকারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি সেই ভূমিকায় অভিনয় করে মানুষকে হাসিয়েছেন।
প্রচলিত রাজনীতির ত্রুটি বা কমতি নিয়ে জনগণের অবিশ্বাস ও আবেগকে যারা কাজে লাগান, তারাই হচ্ছেন 'ডেমোগগ'। এরা যুক্তির দুনিয়ায় আস্থা কমই রাখেন। আর সমর্থকদের মধ্যেও সেই যুক্তিহীনতার বীজ রোপণ করেন। বেশিরভাগ সময় এরা যুক্তিহীন মানুষের অন্ধ ও উগ্র বিশ্বাসকেই নিজেদের রাজনৈতিক প্রচারণার মূল 'অস্ত্র' রূপে ব্যবহার করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত প্রথম সত্যিকারের 'ডেমোগগ' ছিলেন ট্রাম্প। ধনী এই ভাঁড় দায়িত্ব নিয়ে নিজেকে সাধারণ জনতার নায়ক বলে দাবি করতে থাকেন। ইতোপূর্বে, মেয়র বা গভর্নর নির্বাচনের প্রার্থীদের মধ্যে এমন আচরণ দেখা গেছে। কিন্তু, মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি। তবে একথাও সত্য, যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রকার নির্বাচনে ক্রমশ জনপ্রিয় মিডিয়া সেলিব্রেটিদের জয়ী হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে।
উদ্বেগটা সেখানেই। যারা জনগণের আবেগকে নিজ স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যবহার করেন, তারা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। তবে, রাজনীতি বহির্ভূত নতুনদের অনেকে ভালো কাজও করেন।
অতীতে, ১৯৩০ এর দশকে কান্ট্রি মিউজিক ধারার গায়ক ডব্লিউ লি প্যাপি ও' ড্যানিয়েল টেক্সাসের গভর্নর নির্বাচিত হন। তারপর সিনেটরও হন। ১৯৬০'র দশকের শেষদিকে হলিউড অভিনেতা থেকে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর হন রোনাল্ড রিগ্যান। পড়ে তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। একইভাবে প্রয়াত মার্কিন সিনেটর জেসি হেলমস ডানপন্থী রেডিও ধারাভাষ্যকার হিসেবে রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৩ সালে আরেক হলিউড তারকা আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হন। রাজনীতির সঙ্গে আগে তার কোনো সংশ্রব ছিল না।
জনপ্রিয় আবেগের ভিত্তিতে রাজনীতি যারা করে তারা চাইলেই প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে পুলিশি রাষ্ট্র করতে পারে না। চেষ্টা করলেও সেক্ষেত্রে তারা সফলতা পায় না। অন্যদিকে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়কালের উদ্ভূত ফ্যাসিবাদী শাসকেরা সেনাবাহিনী, ব্যবসায়ী, আমলা এবং প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। যার বিপরীতে, জনপ্রিয়বাদীরা সমাজের অভিজাত নয়- এমন জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে পুঁজি করে। তাদের ভাবাবেগ যখন মূলধারার রাজনীতি বা গণমাধ্যমে উপেক্ষিত হলে, প্রসার বাড়ে ডেমোগগদের।
এদের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো; তারা সমর্থকদের দেওয়া বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন না। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নিজের আখের গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির পাল্লা ভারি করেন। কাঠামোগত সংস্কারের মতো উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে এমন রাজনীতিকদের প্রচেষ্টা খুব একটা চোখেও পড়ে না।
ট্রাম্প সেদিক থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি জনপ্রিয়তার রাজনীতি করেও স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করেছেন। জড়িয়েছেন কেলেঙ্কারিতে। বার্লুসকোনির অভিসার আর পার্টির মতো- ট্রাম্পও কুখ্যাতি পান নারীদের শারীরিকভাবে হয়রানি করার অভিযোগে।
অস্বীকার করার উপায় নেই ট্রাম্পের উস্কানিতেই তার সমর্থকেরা ক্যাপিটল হিলে হামলা চালায়। এরা নাৎসি সেনাদের মতোই আগ্রাসী ছিল। ইতালির কুখ্যাত ব্ল্যাক শার্টরা তাদের অনুপ্রেরণার উৎস। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্রের নিজ ইতিহাসই কট্টর ডানপন্থীদের এই উত্থানকে ব্যাখ্যা করতে পারে।
বাস্তবতা হচ্ছে, স্বৈরশাসক না হয়েও জনপ্রিয়বাদীরা আধুনিক গণতন্ত্রে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করার ক্ষমতা রাখে। তারা বন্দি শিবির কিংবা পুলিশি রাষ্ট্র তৈরি করতে না পারলেও রেখে যায় গভীর বিভাজনের ক্ষত। তাই শুধু কোনো জনপ্রিয়তাকামী নেতার উত্থান নিয়ে সতর্ক হলে চলবে না। কোন ধরনের পরিবেশে এধরনের অবার্চিন শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে সেদিকেও মূল ধারার রাজনীতিকদের মনোযোগ দিতে হবে।
- লেখক: ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের লিন্ডন বি. জনসন স্কুল অব পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অধ্যাপক। তার লেখা গ্রন্থের মধ্যে অন্যতম- দ্য নিউ ক্লাস ওয়ার: সেভিং ডেমোক্রেসি ফ্রম ম্যানেজেরিয়াল এলিট'।