ট্রাম্পের মূর্খতা, উন্মত্ততা ও অসাধু কাজকর্মের সময় শেষ: আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার
আমেরিকায় নিজের ভাগ্য খোলার বহু আগে থেকেই দেশটির জন্য আমার নিবিড় অনুভূতি ছিল। আমেরিকার একজন বিখ্যাত মডেল, বডিবিল্ডার, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার আগ থেকেই আমার মনে হতো, আমি এখানকারই মানুষ। যেহেতু আমেরিকার প্রতিষ্ঠা এবং এদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে আমার কিছুটা হলেও জ্ঞান রয়েছে, তাই আমেরিকাকে যেন আরও গভীরভাবে অনুভব করতে পারি।
আজ এই দেশ নিয়ে আমি চিন্তিত। একজন অভিবাসী হিসেবে, একজন আমেরিকান হিসেবে, একজন রিপাবলিকান হিসেবে আজ আমার দায়িত্ব হবে আওয়াজ তোলা।
আমার বেড়ে ওঠার দিনগুলোতে এ দেশে কোনো গণতন্ত্র ছিল না; আমরা এর জন্য মাসুলও দিয়েছি অনেক। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এ ব্যাপারে আমি একটু বেশিই অনুভূতিপ্রবণ। কিন্তু বিষয়টা হলো, এ রকম পরিবেশের ভেতর মাসের পর মাস কাটালে, সত্যি তা আপনাকে ভাবাবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুই বছর পর ১৯৪৭ সালে আমার জন্ম। ঠিক সেই সময়ে অস্ট্রিয়ায় দুর্ভিক্ষ চলছিল। বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ইতিহাসে যাদের অংশগ্রহণ ছিল, তাদের মাঝেই আমার বেড়ে ওঠা। তারা সেই নির্মম নীতির একটি অংশ ছিল যেখানে অন্তত ৬ মিলিয়ন ইহুদি এবং অন্য আরও পাঁচ মিলিয়ন নিষ্পাপ মানুষকে নির্যাতন, হত্যা করা হয়। আর তা শেষ পর্যন্ত একটি যুদ্ধের রূপ এনে দিয়েছিল বিশ্ববাসীকে। ওই যুদ্ধে প্রাণ হারায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষ।
আমেরিকা কখনো এ রকম নিষ্ঠুরতা বেছে নেবে বলে আমি মনে করি না। কিন্তু নির্বাচন ঘিরে আমাদের মাঝে যে স্বার্থপরতা, মূর্খতা ও ধূর্ততা দেখা যাচ্ছে আজকাল, তার পরিণতি সত্যিই ভয়াবহ। তাই আমি নিশ্চিত হতে চাই, আমরা নিজেদেরকে এই দুর্ভাগ্যজনক পথে পরিচালিত করব না।
তাই নির্বাচনকে ঘিরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই অযাচিত কর্মকাণ্ডগুলোর প্রতিবাদ জানাতে হবে আমাদের। নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক নেতাকে সর্বজনীন নিন্দা জানাতে হবে। নির্বাচনে কে জয়ী হয়েছেন, তা স্পষ্ট। এ নিয়ে এখনো এই প্রহেলিকা মূর্খতা, উন্মাত্ততা ও অসভ্যতা ছাড়া আর কিছুই না।
জর্জিয়ার স্টেট সেক্রেটারি ব্র্যাড রাফেন্সপারগারের সঙ্গে ট্রাম্পের ফাঁস হওয়া সেই ফোনকলের জন্য আমি ব্র্যাডকে সম্মান জানাতে চাইছি। এই মার্কিন-আমেরিকান নির্বোধের বিরুদ্ধে তিনি একজন সত্যিকারের নায়ক।
৬ জানুয়ারি যখন নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভোট গণনা করা হবে, ওয়াশিংটন ডিসির নেতাদের তখন একটি বাছাই পর্যায়ের সম্মুখীন হতে হবে। একদা আমি একটি 'টার্মিনেটর' ফিল্ম করেছিলাম, নাম ছিল 'জাজমেন্টাল ডে'। এটি তো শুধু একটি হলিউড কাজ। প্রকৃত 'জাজমেন্ট ডে' আসছে চলতি জানুয়ারি মাসেই। সেদিন রাজনীতিবিদরা বাছাই করবেন, তারা কি ভোটারদের নাকি তাদের দল ও স্বার্থপর প্রেসিডেন্টের পক্ষে যাবেন?
আর আমি আমার দলের সদস্যদেরও বলে রাখছি, আপনারা যারা ভোটারদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, তারা জেনে রাখুন, আমাদের নাতি-নাতনিরা আপনাদের নামগুলো শুধু ভিলেন হিসেবেই জানবে। সেসব ভিলেন, যারা আমেরিকার এই সফল সুষ্ঠু নির্বাচনের এবং ভোটারদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। শুধু তাই নয়, সারাজীবন এই কুখ্যাতি নিয়ে বাঁচতে হবে আপনাদের।
জন এফ. কেনেডির 'প্রোফাইল ইন কারেজ' আমার অন্যতম প্রিয় বই। গভর্নর থাকাকালে বইটি আমাকে নেতৃত্বদানে অনেক সাহায্য করেছে। কিন্তু সম্প্রতি যে তাণ্ডব চলছে আমেরিকায়, তাতে বোধহয় সেই বইয়ের নামে সাহসিকতার ('কারেজ') পরিবর্তে 'প্রোফাইল ইন কাওয়ারডিস' রাখা হতো!
মনে পড়ে, অফিস ত্যাগের সময় জর্জ ওয়াশিংটন একটি বিদায় সম্বোধন লিখেছিলেন, সেটি আজও আমাদের মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়। একমাত্র স্বতন্ত্র প্রেসিডেন্ট হিসাবে রাজনৈতিক দল সম্পর্কে তিনি ছিলেন বেশ সতর্ক। আজ মনে হচ্ছে, বর্তমান সময়কে তিনি বহু আগেই অনুভব করতে পেরেছিলেন।
ওই সম্বোধনপত্রে লেখা ছিল, 'এক পক্ষের প্রতি অন্য পক্ষের এই আধিপত্য, প্রতিশোধের চেতনা, দলীয় মতবিরোধ- এ সবকিছুই বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন দেশে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এগুলোও এক ধরনের স্বৈরাচারী মনোভাব এবং এই বিষয়গুলোই ধীরে ধীরে ব্যাধি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আর তখন মানুষ নিজ স্বার্থে জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়।'
আমার দলের সদস্যদের উচিত এখন আর কোনো পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ না করে এই নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়া। আমেরিকার ভবিষ্যৎ এসব দলেরও ঊর্ধ্বে। তাই দলের বাইরে গিয়ে আমাদের এখন আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে ভাবতে হবে।
সবার আগে আমাদের বড় পরিচয়, আমরা আমেরিকান। এ কথা আমাদের কখনোই ভুলে যাওয়া চলবে না। ঈশ্বর এই দেশ ও গণতন্ত্রপ্রেমী সাহসী আমেরিকানদের মঙ্গল করুন,এই কামনা করি।
- লেখক: হলিউড তারকা এবং ক্যালিফোর্নিয়ার সাবেক গভর্নর (২০০৩-২০১১)
দ্য ইকোনোমিস্ট থেকে অনুবাদ: রাফিয়া মাহমুদ প্রাত
[ঈষৎ সংক্ষেপিত]