তালেবানের অধীনে প্রকল্প পরিচালনা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগকারীরা
আফগানিস্তান থেকে নিজ নাগরিক সরিয়ে নিতে ব্যতিব্যস্ত বিদেশি সরকারগুলো। দাতা সংস্থা, আন্তর্জাতিক ত্রাণ সহায়তার বিভিন্ন সংগঠন ও বিদেশি কোম্পানি ফিরিয়ে আনছে কর্মীদের।
এ বাস্তবতায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে: আফগানিস্তানে ছেড়ে চলে যাওয়াই কী তাদের জন্য একমাত্র সমাধান? দুই দশকের শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ কী তবে বৃথা যাবে? তিন কোটি ৮০ লাখ আফগানের স্বার্থের চিন্তা করেই তাদের কী তবে তালেবান শাসকদের সঙ্গে কাজ করা উচিত?
গেল সপ্তাহে বিশ্বের সকল দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের আগ্রহ ও অঙ্গীকার করে তালেবান। দেয় নারী অধিকার রক্ষা ও স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রতিশ্রুতি। তবে কয়েকজন সাবেক কূটনৈতিক ও গবেষক বলছেন, ১৯৯০ এর দশকের তুলনায় গণমাধ্যমমুখীতা বাড়ার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারে অনেক বেশি পারঙ্গম হওয়ার পরও কট্টরপন্থী তালেবান লড়াকুরা আগের মতোই নৃশংস রয়ে গেছে।
৯০ এর দশকে নারীদের কর্মস্থলে যোগদান বন্ধ করেছিল তালেবান। মেয়েরা যোগ দিতে পারেনি স্কুল-কলেজে। তালেবান শাসন বিরোধীদের প্রকাশ্যে অঙ্গহানি অথবা হত্যা করা হয়। গোষ্ঠীটি আল-কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনকে আশ্রয় দেয়, যারা ৯/১১ হামলা পরিচালনা করেছিল পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বুকে। এরপরই আফগানিস্তান আর বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেনি। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে পতন ঘটে প্রথম দফা তালেবান শাসনের।
তারপর চলতি বছর জোট বাহিনী প্রত্যাহার শুরু সঙ্গে সঙ্গেই দুর্বার গতিতে প্রায় সমস্ত আফগানিস্তানের দখল নেয় তালেবান। সরকারও তারাই গঠন করছে।
তালেবানের দ্বিতীয় মেয়াদে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বিদেশি ত্রাণ সংস্থাগুলোর জন্য এক 'জটিল ধাঁধাঁ' বলে মন্তব্য করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ২০১৫ সালে প্রকাশিত বই- আফগান মডার্ন: দ্য হিস্টোরি অব অ্যা গ্লোবাল নেশন- এর লেখক রবার্ট ক্রিউজ।
তিনি বলেন, "ধরে নিন আপনি একজন বিদেশি ত্রাণ কর্মী। তালেবান সরকারের একটি হাসপাতালে কাজ করছেন। কিন্তু, আপনি এমন এক শাসকগোষ্ঠীর অধীনে কাজ করছেন, যাদের নিজেদের বৈধতাই প্রশ্নের মুখে। আবার সবাই যদি এভাবে চলে যায়, তাহলে জনসেবার অধিকাংশ খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। বড় প্রশ্ন হচ্ছে; রাষ্ট্রও ভেঙ্গে পড়বে কিনা?"
২০১৫-১৬ কাবুলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মাইকেল ম্যাককিনলে। তিনি জানান, আফগানিস্তানের জাতীয় বাজেটের ৭০-৮০ শতাংশ সরবরাহ করে আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠী। যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেয় ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট।
এসব সাহায্য ছাড়া দেশটির অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে।
ম্যাককিনলের মতে, "১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত যেভাবে দৈন্যদশার অর্থনীতির মডেলে দেশ চালিয়েছে তা এড়াতে তালেবানকে বিদেশ থেকে বড় অঙ্কের তহবিল সহায়তা পেতে হবে।"
বর্তমানে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে কৌশলগত পরামর্শ প্রদানকারী সংস্থা কোহেন গ্রুপ কনসালটেন্সিতে কর্মরত সাবেক এ রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, ১৯৯৬ সনের তালেবান ছিল আর্থিকভাবে দুর্বল। খরচের সর্বনিম্ন পর্যায়ে তারা সরকার পরিচালনা করতো। কারণ, মাদক ব্যবসা থেকে অর্জিত আয়ে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকা নিশ্চিত হয়নি।"
তবে সবচেয়ে বড় ভয়; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবানের সঙ্গে আগামী দিনে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ হলে- 'আরো বড় সংকট দেখা দেবে' এমন আশঙ্কা করছেন অনেকে।
ওয়াশিংটন ভিত্তিক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ট্রাডিজের উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল রুন্ডে বলেছেন, "সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার একটা সহজাত তাগিদ সবাই অনুভব করবে। কিন্তু, ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার আগেও আমরা একই কাজ করেছিলাম, তার এক যুগ পর আবার আমাদের সেদেশে ফিরতে হয়েছিল।"
অনিশ্চয়তায় শত শত কোটি ডলারের বিনিয়োগ:
বিদেশি সরকার ও সহায়তা গোষ্ঠীগুলো হাজার হাজার লোককে সরিয়ে নিলেও পেছনে ফেলে যাচ্ছে অসমাপ্ত অনেক প্রকল্প। ইতোমধ্যেই এসব প্রকল্পে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর যেগুলো সম্পন্ন হয়েছে সেগুলোর ভবিষ্যতও এতে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ প্রকল্পই চালিত হয়েছিল আফগানিস্তান রিকন্সট্রাকশন ট্রাস্ট ফান্ডের অধীনে।
২০০২ সালের পর থেকে আফগানিস্তান পুনর্নির্মাণে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি ডলার একা যুক্তরাষ্ট্রই দিয়েছে। গত ৩০ জুলাই দেশটির আফগানিস্তান বিষয়ক বিশেষ মহাপরিদর্শকের দপ্তরের রিপোর্ট সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।
অন্যদিকে, বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের ২০০ কোটি ডলার অর্থায়নে আফগানিস্তানে কমপক্ষে ২৭টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। উদ্যান ভিত্তিক চাষবাস থেকে শুরু করে স্বয়ংক্রিয় অর্থ লেনদেনের মতো নানা খাতের এসব প্রকল্প আসলে দেশটির উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে এপর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের ৫৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগেরই অংশ।
গত মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) বিশ্বব্যাংক জানায়, আফগানিস্তানে তারা নিজেদের তহবিল বিতরণ স্থগিত করেছে এবং সার্বিক পরিস্থিতির ওপর ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছে।
গত শুক্রবার কাবুল থেকে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের কর্মকর্তাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থায় কর্মরত ৩৫০ জন বিদেশি নাগরিককে বহনকারী একটি ফ্লাইট ইসলামাবাদে অবতরণ করে।
রয়টার্সের দেখা বিশ্বব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ নথি অনুসারে, কাবুল থেকে আফগান কর্মীসহ সকল কর্মীকে সপরিবারে সরিয়ে নিয়েছে সংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস নথিতে মন্তব্য করেন, "আফগানিস্তানে আমাদের কার্যক্রম ছিল সমগ্র অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে অপরিহার্য। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় আমরা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারব বলে আশা করছি।"
তবে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, "আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"
সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে চলতি বছরের শুরুতে মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয়। সেখানকার সঙ্গে তুলনা করলে ভবিষ্যতের একটি আভাস পাওয়া যায়।
অভ্যুত্থানের পর ফেব্রুয়ারিতে সকল তহবিল ছাড়করণ বন্ধ করে দেয় বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। দেশটিতে কোভিড-১৯ মহামারি মারাত্মক আকার ধারণ করার পরও তহবিল ফ্রিজের পদক্ষেপ থেকে সরে আসেনি সংস্থা দুটি।
দুটি সংস্থাই বলছে, সদস্য দেশগুলোর মতামতের ভিত্তিতে তারা যেকোনো দেশে আকস্মিক সরকার পরিবর্তনের পর সেখানে দেওয়া সহায়তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রই উভয় সংস্থার সিংহভাগ মালিকানার অধিকারী।
স্বচ্ছতার অভাব:
এদিকে নয়া আফগান সরকারের প্রতি সদস্য দেশগুলোর অনাস্থার কথা জানিয়ে সেদেশে প্রদত্ত সকল তহবিল স্থগিত করেছে আইএমএফ। এর মধ্যে আছে ৪৪ কোটি ডলার মুদ্রা রিজার্ভ বিষয়ক সহায়তা- যা গত সোমবারই বরাদ্দের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
অন্যদিকে, তালেবান ইস্যুতে বিভাজিত যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যম ও প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো। গোষ্ঠীটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখা বা সম্পূর্ণভাবে তাদের পরিহারের এ বিভাজন আসলে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মতপার্থক্যেরই ক্ষুদ্রতর প্রতিফলন।
রুন্ডে বলেন, "তালেবান নেতৃত্বের কাছ থেকে যেসব বিবৃতি আসছে, আমাদের উচিত সেগুলোকে কিছু পরিমাণে হলেও গুরুত্ব দেওয়া। তখন তারা বাধ্য হয়েই বক্তব্যগুলো যে সত্য তা প্রমাণের চেষ্টা করবে।"
অবশ্য ২০১১-১২ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রায়ান ক্রুকার যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, তালেবানকে বিশ্বাস করা কোনভাবেই উচিত হয়নি।
কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস- থিঙ্ক ট্যাঙ্কের ব্লগ পোস্টে তিনি লিখেছেন, "তালেবান আবার ক্ষমতায় এসেছে। এবার তারা আল কায়েদাকে ডেকে আনবে। এটি কোনো তাত্ত্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি নয়। ৯/১১ হামলার আগেও তারা জোট বেঁধেছিল। এরপর দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলেও এখনও তারা ভদ্র ও দয়ালু হয়নি।"
- সূত্র: আল জাজিরা