'তুমি আর আমার মা না': বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ট্রাম্পের যুগ শেষ হওয়ার পরও ভুগতে হবে
জীবনের অধিকাংশ সময় ডেমোক্রেট দলের সমর্থক ছিলেন ৪১ বছরের মার্কিন নারী মায়রা গোমেজ। কিন্তু এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পাঁচ মাস আগে নিজ সিদ্ধান্তের কথা তার ২১ বছরের ছেলেকে জানান। আর সঙ্গে সঙ্গেই মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা সাফ জানিয়ে দেন তার সন্তান।
মিলওয়াকি রাজ্যের এ স্বাস্থ্যকর্মী বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, 'ছেলে আমাকে জোর দিয়েই বলেছে; তুমি ট্রাম্পকে ভোট দিতে চলেছ, তাই তুমি আর আমার মা নও।'
দুজনের মধ্য শেষ সংলাপ এতটা তিক্ততাপূর্ণ ছিল যে ট্রাম্প হেরে গেলেও তাদের মধ্যে মীমাংসা হবে কিনা- তা নিয়ে সন্দিহান মায়রা গোমেজ।
'ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গেছে। মানুষের কাছে ট্রাম্প একটা দানব। ব্যাপারটা দুঃখজনক। অনেকেই সিদ্ধান্তটি জানার পর আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না। তাদের মনোভাব পরিবর্তন হবে কিনা! সত্যিই আমার জানা নেই,' বলছিলেন গোমেজ।
তিনি অবৈধ অভিবাসন বন্ধ এবং অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ট্রাম্পের নীতির কারণে তাকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শুধু গোমেজ নন, যুক্তরাষ্ট্রে হাজার হাজার পরিবার এবং বন্ধু –বান্ধবের সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছে এবারের নির্বাচন ঘিরে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান। ট্রাম্প হোয়াইট হাউজের দপ্তরে থাকুন বা নাই থাকুন- তাতেও এ দূরত্ব সহজে দূর হবে না।
এর জন্য দায়ী ২০২০ সালের নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক বৈরিতার পরিবেশ। উত্তেজনাও তুঙ্গে ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান দলের সমর্থকদের মধ্যে। নির্বাচন নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে সমর্থন সব-সময় থাকলেও; এবার তা বিদ্বেষে রূপ নিয়েছে অনেকক্ষেত্রেই। আর প্রত্যক্ষভাবে এ পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স ১০ জন ভোটারের সাক্ষাৎকার নেয়। এদের ৫ জন ছিলেন ট্রাম্প সমর্থক। বাকিরা ভোট দেবেন ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী সাবেক ভাইস- প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে।
তাদের কেউ কেউ জানান, ট্রাম্পের শাসনামলে আপনজনদের সঙ্গে তাদের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে- তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আর অধিকাংশই মনে করেন, কিছু সম্পর্ক চিরতরেই ভেঙ্গে গেছে।
চার বছরের মেয়াদে ট্রাম্প একের পর এক প্রথাবিরোধী কাজ করেছেন। এসব কীর্তিকালাপ তার সমর্থক এবং বিরোধী- উভয় পক্ষের মধ্যেই তীব্র আবেগের জন্ম দেয়।
অভিবাসন সংস্কারে নেওয়া উদ্যোগ, রক্ষণশীল বিচারপতি নিয়োগ, চুক্তি বাতিল করা এবং সেগুলোর স্বপক্ষে কড়া নিন্দা জানানো ট্রাম্পকে তার সমর্থকরা এমন কারণেই পছন্দ করেন। ট্রাম্পের কটুক্তি তাদের কাছে সোজাসাপ্টা কথা।
অন্যদিকে, ডেমোক্রেট সমর্থক এবং অন্যদের কাছে সাবেক এই আবাসন ব্যবসায়ী হচ্ছেন- গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক এক ব্যক্তিত্ব। একজন ধারাবাহিক মিথ্যাচারকারী ও প্রকাশ্য বর্ণবাদী।
ট্রাম্পের অবহেলাতেই করোনাভাইরাস মহামারিরতে ২,৩০,০০০ মার্কিন নাগরিকের প্রাণহানি হয়েছে, এমন অভিযোগ তাদের।
জনগণের একটি বড় অংশ যে তাকে নিয়ে এমন ধারণা পোষণ করেন, তা বরাবরই অস্বীকার করেছেন ট্রাম্প। এসব 'ভুয়া খবর' বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিভাজিত জনমত তৈরি হয় ট্রাম্প আমলেই। আর প্রাক-নির্বাচনী মতামত জরিপে এখনও ট্রাম্পের আগে রয়েছেন বাইডেন। তাই ট্রাম্প হেরে গেলে প্রিয়জনদের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা দূর হবে কিনা- সেটাই ভাবা শুরু করেছেন অনেকে।
বিশেষজ্ঞরাও বলছেন সহজে সামাজিক ও মানসিক দূরত্ব কাটিয়ে ওঠা যাবে না।
মিশিগানের রচেস্টার সেন্টার ফর বিহেভিওরাল মেডিসিনের মনোবিজ্ঞানী জেইমি সাল বলেন, 'প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন সহজ। কিন্তু, জাতি হিসেবে আমরা যেভাবে বিভাজিত হয়েছি, যেভাবে দূরত্ব বেড়েছে তা কাটিয়ে ওঠাটা সহজ হবে না।'
'এজন্য সময় এবং চেষ্টা দুটোই দরকার। সকল পক্ষকেই সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। অতীতের বিবাদ পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এটাই হতে পারে একমাত্র উপায়,' তিনি যোগ করেন।
জেইমি জানান, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা ইস্যু নিয়ে জটিল সমীকরণ মার্কিন নাগরিকদের ব্যক্তিগত সম্পর্কেও চরম উত্তেজনা তৈরি করেছে। রাজনীতি নিয়ে বাবা- মা, সন্তান বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও মনোমালিন্যের ঘটনা তিনি প্রায়শই দেখছেন বলেও উল্লেখ করেন।
প্রতিবেশী বিরুদ্ধে প্রতিবেশী:
শুধু পরিবার আর বন্ধু-বান্ধব নয়। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যের বন্ধন নষ্ট হয়েছে। পরস্পর শত্রুতে পরিণত হওয়ার ঘটনাও অসংখ্য।
ট্রাম্প সমর্থক প্রতিবেশীর মনে আঘাত করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটারের ব্যবহার করে তীব্র সমালোচনাপূর্ণ পোস্ট করেছেন অনেকে। আবার ট্রাম্প সমর্থকেরা তার সমালোচকদের তুলোধুনো করে অগণিত পোস্ট করেছেন। সঙ্গে ট্রাম্পের নিয়মিত বিদ্বেষী টুইটের জ্বালানি তো ছিলই। অশান্তি আর তিক্ততার আগুন তাতে আরও বেড়ে গ্রাস করেছে সামাজিক পরিমণ্ডলকে। উস্কানি দিয়েছে উত্তেজনায়।
গত সেপ্টেম্বরেই এনিয়ে একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে পিউ রিসার্চ সেন্টার। সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশ ট্রাম্প এবং বাইডেন সমর্থকেরা জানান, অপরদলের সমর্থকদের মধ্যে তাদের খুব কম বন্ধুই আছে। এবং অনেকের ক্ষেত্রে বন্ধু নেই বললেই চলে।
নির্বাচনী জরিপ সংস্থা গ্যালোপের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ট্রাম্পের তৃতীয় বছরের শাসনামলে নাগরিকদের রাজনৈতিক দলভিত্তিক মেরুকরণ এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে।
২০১৯ সালের ওই জরিপে অংশ নেওয়া ৮৯ শতাংশ রিপাবলিকান দলের সমর্থক ট্রাম্পকে যোগ্য বলে রায় দেন। মাত্র ৭ শতাংশ ডেমোক্রেট এতে সম্মতি দেন।
অর্থাৎ, রাষ্ট্র নেতৃত্ব নিয়ে চরম বিভাজন স্পষ্ট ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক কয়েক দশকের ইতিহাসে যা নজিরবিহীন ঘটনা।
বিভাজনের আগুনে পুড়েছে ৭৭ বছরের বৃদ্ধা গেইল ম্যাক-করমিকের সংসার। ২০১৬ সালে তার স্বামী উইলিয়াম ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন। তারপরেই ৮১ বছরের উইলিয়ামের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
করমিক বলেন, 'ট্রাম্প যা রেখে গেছে- তা সে চলে গেলেও বিদায় নেবে না। আরও অনেকদিন এই বোঝা আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।'
করমিক এখন কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে থাকেন। আর উইলিয়াম যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায়। সুযোগ পেলে তারা এখনও একসাথে সময় কাটান। তবে করমিকের দুই নাতি তার সঙ্গে কথা বলে না। চার বছর আগে ডেমোক্রেট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দেওয়াটাই তাদের কাছে অপরাধ। পাশাপাশি ট্রাম্প সমর্থক অন্য আত্মীয় এবং বন্ধুদের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে এই বৃদ্ধার।
তিনি মনে করেন, ট্রাম্প সমর্থক আর তার বিরোধীরা সম্পূর্ণ অচেনা দুই দুনিয়ার বাসিন্দা। একে-অন্যের কাছে তারা আদর্শের দিক থেকে ভিনগ্রহের প্রাণি। বন্ধু ও পরিবারের মাঝে সম্পর্ক জোড়া লাগাটা তাই ভাগ্যের উপরই নির্ভর করছে।
এমন অভিজ্ঞতা ও উপলদ্ধির কথা রয়টার্স সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া অন্যরাও জানিয়েছেন।
- সূত্র: রয়টার্স