নির্বাচনে হারলে ট্রাম্পের কী পরিণতি হবে!
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেখানে হারার পরিণতি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য মারাত্মক হতে পারে।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে অনেক আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান তার। কিন্তু, ক্ষমতা হারালে একাধিক অভিযোগে তদন্ত শুরু হতে পারে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। সম্ভাব্য, বাণিজ্যিক জালিয়াতি বা আর্থিক কেলেঙ্কারি-সহ অনেক ধরনের অনুসন্ধান শুরু করতে পারে নতুন মার্কিন প্রশাসন।
শুধু ব্যবসা নয়, ব্যক্তি হিসেবেও তিনি কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর নজরদারির আওতায় চলে আসবেন বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা সিএনএন।
মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে ঘিরে কেলেঙ্কারি অসংখ্য। অভিযোগের মাত্রাও নানা ধরনের। বাদ পড়েনি নারীদের যৌন হয়রানির কেলেঙ্কারি। প্রেসিডেন্ট থাকার সময়েই একাধিক নারী তার বিরুদ্ধে শারীরিক হেনস্থার অভিযোগ করেছেন। ইতোপূর্বে প্রাক্তন কলাম লেখিকা ই জিন ক্যারল তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগও আনেন।
তাছাড়া, নিজ পদকে কাজে লাগিয়ে তিনি ব্যবসায় সুবিধা লাভ করছেন এমন দাবি করা হচ্ছে।
পদমর্যাদা ব্যবহার করে ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে অনেক তদন্ত বা মামলা হয় বন্ধ, নাহলে তার তাতে বাধা সৃষ্টি করেছেন। এরমধ্যে তার আয়কর রিটার্ন নথি চেয়ে কংগ্রেসের 'সাবপিওনা' আবেদনও রয়েছে।
অধিকাংশ তদন্ত এখন আদালতে চলমান মামলায় রূপ নিয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, এক সময় না এক সময় এগুলোর সুরাহা হবে।
তবে প্রাক-নির্বাচনী জরিপ অনুসারে প্রেসিডেন্ট হওয়ার দৌড়ে ট্রাম্পের চাইতে অনেক এগিয়ে আছেন, তার ডেমোক্রেট প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন। নির্বাচনে হারলে আদালতের রায়ে ট্রাম্প কঠিন সাজার মুখে পড়তে পারেন। তখন বিচারক ট্রাম্পের বিশেষ সাংবিধানিক পদমর্যাদা না থাকায়, রায় দিতেও বাধা পাবেন না। ফলে হারটা ট্রাম্পের জন্য মারাত্মক পরিণতি তৈরি করবে।
অভিযোগের পাল্লা এত ভারি যে, নির্বাচনের পরও নতুন তদন্ত চলবে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যেই, নিউইয়র্কের কৌসুলিরা তার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগের কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে অপরাধী তৎপরতার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। নির্বাচনের সপ্তাহ খানেক পর এসব নিয়ে তদন্ত শুরুর কথা তারা বলেছিলেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন কৌসুলি হ্যারি স্যান্ডিক জানান, ''বলা যায় প্রায় সকল ভাবেই, তিনি হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করা মাত্রই কৌসুলি এবং তদন্তকারীরা তার বিরুদ্ধে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে মামলা দায়ের করতে পারবেন।''
ব্যাখ্যা করে স্যান্ডিক জানান, ''এখন জরুরি কোনো নথি দাখিলে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের নির্দেশ মেনে বা বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের আইনি কার্যালয়কে তথ্য সহযোগীতা দিচ্ছেন না ট্রাম্প। পদবলে তিনি এসবের ঊর্ধ্বে এমন যুক্তি বার বার দিয়েছেন। এই দাবি যথার্থ না হলেও, রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি এধরনের তথ্য না দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।''
ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নতুন করে অনুসন্ধান শুরুতে পরামর্শ দিচ্ছেন প্রাক্তন কৌসুলিরা।
বিরোধী রাজনীতিবিদেরাও হাত গুটিয়ে বসে নেই। প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্রেট দলীয় সদস্য এরিক সোয়ালওয়েল 'রাষ্ট্রপতির অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড অনুসন্ধানে স্বাধীন কমিশন' গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন।
সম্পূর্ণ দলমত নিরপেক্ষ তদন্তকারীদের মাধ্যমে কমিশনটি পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি, গত আগস্টে দেওয়া এক টুইট বার্তায়।
তবে সবচেয়ে বড় হুমকি হবে ম্যানহাটন অঞ্চলের অ্যাটর্নির কার্যালয়ের আনা অভিযোগগুলো। ট্রাম্পের মালিকানাধীন সংস্থার আর্থিক লেনদেনে অসাধু উপায় অবলম্বনের বিস্তারিত প্রমাণাদি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন সেখানকার কৌসুলিরা।
এবিষয়ে আদালতে জমা দেওয়া নথিতে তারা ব্যক্তি ট্রাম্প আর তার কোম্পানি- ব্যাংক ও বিমা জালিয়াতি, কর ফাঁকি এবং বাণিজ্যিক নথিপত্রে ভুয়া তথ্য যোগ করেছে- এমন অভিযোগ তদন্ত করার অনুমতি চেয়েছেন।
অনুসন্ধানটির কারণে যে প্রতিষ্ঠানটি ট্রাম্পের হিসাবরক্ষণের কাজ করে তাদের কাছে হিসাবের নথি চাওয়া হয়েছে। তবে নিজ ক্ষমতার দোহাই দিয়ে এই প্রক্রিয়াকেও চ্যালেঞ্জ করে বসেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
যদিও, পাঁচ পাঁচটি আদালত এসব নথি চাওয়া বৈধ বলে রায় দিয়েছেন। এবং গত সপ্তাহেই আরেকটি আইনি পরাজয়ের মুখে পড়েন ট্রাম্প। ওই সময় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও সাবপিওনাগুলোকে খারিজে করা ট্রাম্পের আর্জি নাকচ করে দেন।
আদালতের বিচারকমণ্ডলী জানান, ট্রাম্পের যুক্তি অনুসারে তদন্ত প্রক্রিয়াটি অবৈধ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, তারা এমন প্রমাণ পাননি।
এরপর তথ্য দেওয়ার আর্জিটি সচল না করতে সর্বোচ্চ আদালোতকে অনুরোধ করেছেন ট্রাম্পের আইনজীবীরা। পুনরায় আপিল করার সময় চেয়েই তারা এ অনুরোধ করেন।
গত জুলাইয়েও সর্বোচ্চ আদালতে হেরে যান ট্রাম্প। বিচারপতিদের বিশেষ বেঞ্চ ওই সময় দেওয়া রায়ে জানান, প্রেসিডেন্ট হলেও কোনো রাজ্যের বিচার প্রক্রিয়া থেকে তিনি অব্যাহতি পেতে পারেন না।
গত এক বছর ধরেই নিউইয়র্কের তদন্তটি ট্রাম্পের অসহযোগিতায় স্থবির হয়ে পড়েছে। অপরাধ তদন্তে আয়কর রেকর্ড, ব্যবসায়িক দলিলাদি এবং আর্থিক লেনদেনের রশিদ পরীক্ষা করা আবশ্যক বলেই জানিয়েছেন ম্যানহাটনের কৌসুলিরা।
তবে সবকিছুর পরও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে রাজ্যের কৌসুলিরা অভিযোগ দায়ের করতে পারেন কিনা- তা নিয়ে আইনি প্রশ্ন রয়েই গেছে।
''তার এখন অনেক ক্ষমতা। সব ধরনের প্রমাণ সংগ্রহ করে তার বিরুদ্ধে মামলা সাজানো এই মুহূর্তে বেশ জটিল। কিন্তু, ট্রাম্প যদি নির্বাচনে হেরে তার দপ্তর ছাড়তে বাধ্য হন, তখন তদন্তে নতুন গতি ফিরবে,'' বলছিলেন সিএনএন- এর আইন বিশ্লেষক জেনিফার রজার্স। এর আগে তিনি, একজন কেন্দ্রীয় কৌসুলি হিসেবেও কাজ করেছেন।
মামলার তোড়ে ভেসে যাবেন ট্রাম্প:
পুনঃনির্বাচিত না হলে একের পর এক মামলার বাধ খোলা স্রোতের মুখে পড়বেন ট্রাম্প। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে আদালতের স্বতন্ত্র বিবেচনাও তখন কাজ করবে না। ফলে অনেক নতুন মামলার প্রস্তুতিও শুরু হবে।
২০১৭ সালে ওয়াশিংটন ডিসি এবং মেরিল্যান্ডের রাজ্যের কৌসুলিরা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পদমর্যাদা ব্যবহার করে মার্কিন জাতীয় স্বার্থের চাইতে নিজের আর্থিক মুনাফা অর্জনেই ব্যস্ত ট্রাম্প, অভিযোগপত্রে এমন কথা উল্লেখ করা হয়।
মামলার আওতায় ওই দুই রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস ৩০টি সাবপিওনা আবেদন প্রস্তুত করেছেন। এর আওতায় ট্রাম্পের বাণিজ্যিক সংস্থা এবং তার অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজের তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়েছে। আর সাংবিধানিক ক্ষমতার যুক্তি দিয়ে ইতোমধ্যেই ওই প্রক্রিয়া বন্ধ করার পাল্টা আবেদন করেছেন ট্রাম্পের আইনজীবীরা।
এসব জটিলতা কেটে যাবে ক্ষমতার পট-পরিবর্তন হলেই। হোয়াইট হাউজের দপ্তরের বাইরে তখন ট্রাম্পকে একাই লড়তে হবে আদালত, গণমাধ্যম এবং জনতার কাঠগড়ায়। বাইডেন এগিয়ে থাকায় সেদিকেই মোড় নিতে পারে ৩ নভেম্বরের নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি।
- সূত্র: সিএনএন