পারমাণবিক সাবমেরিন: অস্ট্রেলিয়া পাচ্ছে, জাপান-কোরিয়া কেন পাচ্ছে না?
গত ১৫ সেপ্টেম্বর অকাস (AUKUS) চুক্তির ঘোষণা দেয় আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া। এ চুক্তির আওতায় রয়্যাল অস্ট্রেলিয়ান নেভি (আরএএন) প্রোগ্রামের আওতায় অস্ট্রেলিয়াকে পরমাণুশক্তি চালিত সাবমেরিন তৈরিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য। জানা গেছে, প্রথম সাবমেরিনটি তৈরি সম্পন্ন হবে ২০৩৯ সালের শেষ দিকে।
এর মাধ্যমে পৃথিবীর সপ্তম দেশ হিসেবে পারমাণবিক সাবমেরিনের মালিক হবে অস্ট্রেলিয়া। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর বাইরে প্রথম দেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক সাবমেরিনের মালিক হচ্ছে।
অভাবনীয় চুক্তিটির ফলে অনেকের মনেই শঙ্কা জেগেছে যে অস্ট্রেলিয়াও হয়তো এবার পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক হয়ে যেতে পারে। কিংবা ভাগাভাগির চুক্তি হিসেবে আমেরিকার কাছ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র পেতে পারে। দ্বিতীয়টি হলে বড়সড় যুদ্ধের সময় মার্কিন পারমাণবিক অস্ত্র অস্ট্রেলিয়াকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে। ইউরোপের কিছু দেশের সঙ্গেও আমেরিকার এমন চুক্তি আছে।
ডিজেলচালিত সাবমেরিনের চেয়ে পরমাণুশক্তি চালিত সাবমেরিনে কিছু বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। পারমাণবিক সাবমেরিনের গতি ডিজেলচালিত সাবমেরিনের চেয়ে অনেক বেশি, দূরত্বও পাড়ি দিতে পারে বেশি। এছাড়াও পারমাণবিক সাবমেরিন অনেক বেশি টেকসই। ফলে রিফুয়েলিং দরকার না হওয়ায় এই সাবমেরিন অনেক বেশি সময় ধরে সমুদ্রে থাকতে পারে।
পারমাণবিক সাবমেরিনের মালিক হলে অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরে অনেক বেশি সময় ধরে সেনা নিয়োজিত রাখতে পারবে। ডিজেলচালিত সাবমেরিন যেখানে ১১ দিন দক্ষিণ চীন সাগরে থাকতে পারে, সেখানে পারমাণবিক সাবমেরিন থাকতে পারবে ৭৭ দিন। ফলে ওই অঞ্চলে চীনের শক্তি খর্ব করা সহজ হবে তাদের জন্য।
ডিজেলচালিত জ্বালানি পোড়ানোর জন্য বাতাস দরকার, আর ইলেকট্রিক ইঞ্জিনের জন্য ঘন ঘন রিচার্জ করা দরকার। এ কারণে সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির প্রথাগত সাবমেরিনও একনাগাড়ে কয়েক দিনের বেশি পানির নিচে ডুবে থাকতে পারে না। জ্বালানির জন্য তাদের পানির ওপর ভেসে উঠতে হয়, অথবা বাতাস নেওয়ার নলটিকে পানির ওপরে ভাসিয়ে রাখতে হয়। ফলে তা শত্রুপক্ষের চোখে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
অন্যদিকে এখন যেসব পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরি হচ্ছে, সেগুলো কোনো রিফুয়েলিং ছাড়াই মাসের পর মাস পানির নিচে থাকতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্রও বহন করতে পারে অনেক বেশি। এবং অস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে অনেক দূর পর্যন্ত।
এ কারণেই পশ্চিমা শক্তিগুলো পারমাণবিক সাবমেরিনকে এত গুরুত্ব দেয়। কিছু হিসাব অনুসারে, পারমাণবিক সাবমেরিনের মালিক হলে অস্ট্রেলিয়ান নৌবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগরে অনেক বেশি সময় ধরে সেনা নিয়োজিত রাখতে পারবে। ডিজেলচালিত সাবমেরিন যেখানে ১১ দিন দক্ষিণ চীন সাগরে থাকতে পারে, সেখানে পারমাণবিক সাবমেরিন থাকতে পারবে ৭৭ দিন। ফলে ওই অঞ্চলে চীনের শক্তি খর্ব করা সহজ হবে তাদের জন্য।
অকাস চুক্তির পর প্রশ্ন উঠেছে, কেবল অস্ট্রেলিয়াকেই কেন পরমাণুশক্তিচালিতে সাবমেরিন তৈরি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো? এর একটা কারণ হলো, ফ্রান্সের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া ডিজেলচালিত সাবমেরিন কেনার যে চুক্তি হয়েছিল, তা বাগিয়ে নেওয়া।
অকাস চুক্তির পর অস্ট্রেলিয়া ফ্রান্সের কাছ থেকে ১২টি ডিজেলচালিত সাবমেরিন কেনার জন্য করা চার হাজার কোটি ডলারের চুক্তিটি বাতিল করছে। এই চুক্তি বাতিল করলে ফ্রান্সের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তবে অকাস চুক্তির সবচেয়ে বড় কারণটা হলো, অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ চীন সাগরে অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েন করলেই সবচেয়ে লাভবান হবে আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য। অন্য কোনো দেশকে পারমাণবিক সাবমেরিন দিয়ে এত লাভবান হতে পারবে না তারা। এ চুক্তির আওতায় সাবমেরিন পেলে দক্ষিণ চীন সাগরে নৌবাহিনীর ক্ষমতা বাড়াবে অস্ট্রেলিয়া। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে পারবে অস্ট্রেলিয়া।
এ কারণেই জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এমন কোনো চুক্তি করেনি আমেরিকা-যুক্তরাজ্য। যদিও প্রতিরক্ষা খাতে জাপান-কোরিয়ার বাজেট অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক বেশি। জাপান-কোরিয়াকে এই প্রযুক্তি না দেওয়ার আরও বেশ কটি কারণ রয়েছে।
পূর্ব এশিয়ার দুটো দেশই আমেরিকার বড় শত্রু চীন, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত। দেশগুলোর সঙ্গে জাপান-কোরিয়ার দূরত্ব কম হওয়ায় ওই অঞ্চলের জলে তৎপরতা চালানোর জন্য জাপান-কোরিয়ার জন্য ডিজেলচালিত সাবমেরিনই যথেষ্ট। এত কম দূরত্বের জন্য পারমাণবিক সাবমেরিনের কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রথম কারণ হলো, পূর্ব এশিয়ার দুটো দেশই অনেক বেশি শিল্পনির্ভর। এছাড়াও জাপান-কোরিয়ার নিজেদেরই বড়সড় সাবমেরিন শিল্প আছে। দুটো দেশই নিজস্ব ব্যবস্থায় উৎপন্ন ডিজেলচালিত সাবমেরিনের মালিক। ধারণা করা হয়, জাপানের ডিজেলচালিত সাবমেরিনগুলো তাদের পশ্চিমা মিত্রদের সাবমেরিনের চেয়ে অনেক বেশি চুপিসারে চলাফেরা করতে পারে।
জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া সামরিক শিল্পের দিক বিবেচনায় তো পিছিয়ে পড়েছেই, সেইসঙ্গে দেশ দুটোর ভৌগোলিক অবস্থানও তাদের পক্ষে কাজ করেনি। এ দুই দেশকে পারমাণবিক সাবমেরিন প্রযুক্তি দিলে আমেরিকা-যুক্তরাজ্যের তেমন একটা লাভ হতো না।
পূর্ব এশিয়ার দুটো দেশই আমেরিকার বড় শত্রু চীন, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত। দেশগুলোর সঙ্গে জাপান-কোরিয়ার দূরত্ব কম হওয়ায় ওই অঞ্চলের জলে তৎপরতা চালানোর জন্য জাপান-কোরিয়ার জন্য ডিজেলচালিত সাবমেরিনই যথেষ্ট। এত কম দূরত্বের জন্য পারমাণবিক সাবমেরিনের কোনো প্রয়োজন নেই।
স্বল্প দূরত্বে কাজ চালাবার জন্য ডিজেলচালিত সাবমেরনই বেশি কাজে আসে। কেননা ডিজেলচালিত সাবমেরিন তৈরি ও চালনায় একদিকে যেমন খরচ কম পড়ে, তেমনি চলাফেরাও অনেক বেশি নিঃশব্দে করে।
এছাড়াও অভ্যন্তরীণ পরমাণু অস্ত্রবিরোধী আইনও জাপানের পারমাণবিক সাবমেরিন না পাওয়ার একটা অন্যতম কারণ বলে ধারণা করা হয়।
সব মিলিয়ে এসব কারণেই জাপান-কোরিয়াকে না দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকা-যুক্তরাজ্য।
- সূত্র: দ্য ডিপ্লম্যাট