পুতিন ও জিনপিংয়ের অনুপস্থিতিতে কেমন হবে বাইডেনের প্রথম জি-২০ সম্মেলন?
জি-২০ সম্মেলনের প্রথম দিনে নীল কার্পেটে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেন ২০ দেশ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে আগত রাষ্ট্রপ্রধানরা। তবে, বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই মানুষদের সারিতে ছিল কয়েকটি অপরিচিত মুখ।
চীন, রাশিয়া, জাপান এবং মেক্সিকোর অনুপস্থিত রাষ্ট্রপ্রধানদের পরিবর্তে দাঁড়িয়েছেন তাদের মন্ত্রীপদস্থ প্রতিনিধিরা। চলতি বছর সশরীরে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে যোগ না দিতে শীর্ষ নেতারা যেন জোট বেধেছেন।
এর মধ্যে জো বাইডেনের অন্যতম দুই প্রতিপক্ষ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং এবং রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নামও আছে। ফলে, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বাইডেন আগ্রহী থাকলেও তা আর হচ্ছে না।
কোভিডের কারণে জি-২০ সম্মেলন ও সোমবার শুরু হতে যাওয়া স্কটল্যান্ডের জলবায়ু সম্মেলনে অনুপস্থিত থাকবেন পুতিন ও জিনপিং। রাশিয়ায় সংক্রমণ সংখ্যা আবারও বাড়ছে। অন্যদিকে, জিনপিং ভাইরাস ছড়ানোর পর থেকে গত ২১ মাস ধরে চীনের বাইরে ভ্রমণ করা থেকে বিরত আছেন। জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিলে চীনে ফিরে জিনপিংকে কোয়ারেন্টাইন পালন করতে হতো, যার কারণে আসন্ন পার্টি কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যোগদান তার পক্ষে সম্ভব হতো না।
কিন্তু, সাইবার আক্রমণ, সামরিক আগ্রাসন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে শি এবং পুতিনের বিশ্বের অন্যতম এই কূটনীতিক সম্মেলন এড়িয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ এও হতে পারে যে, তারা বৈশ্বিক সহযোগিতার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী নন।
শি এবং পুতিনের অনুপস্থিতি বাইডেনের জন্য ভালো-মন্দ দুটোই
হোয়াইট হাউজ কর্মকর্তাদের দাবি পুতিন এবং শি কনফারেন্সে অনুপস্থিত থাকায় সুযোগ হারিয়েছেন। পরিবর্তে, এই শূন্যস্থান যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজেদের এজেন্ডা স্থাপন এবং জলবায়ু ও বৈশ্বিক মহামারি রোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারণ সাপেক্ষে আলোচনার সুযোগ দিয়েছে।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কনফারেন্সে জলবায়ু, কোভিড, জ্বালানি সংকট, সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত, ইরানের পরমাণু প্রকল্প ইত্যাদি প্রধান ইস্যুগুলো নিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
বাইডেন সশরীরে অনুষ্ঠিত সামিটকে গুরুত্ব দিলেও তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ হারালেন।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের অ্যাম্বাসেডর রিচার্ড হ্যাস শি ও পুতিনের ভার্চুয়ালি সম্মেলনে যোগদান সম্পর্কে বলেন, "এটা আসলে তারা কোন জিনিস প্রাধান্য দিচ্ছেন তা প্রকাশ করে।"
"আসলে সুযোগের চেয়ে বাস্তবতাটাই আগে দেখতে হবে। ইউরোপীয়রা কী তাইওয়ানের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে কিংবা তারা কি রাশিয়ান জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমাতে পারবে? আমরা ঢালাওভাবে সুযোগের কথা বলতে পারি, কিন্তু আমার মনে হয় যে নীতি ও বাস্তবতার প্রতিফলন থেকেই এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব।"
তবে, পুতিন এবং শি কারোর কূটনৈতিক অবসর নেই। দুজনেই নিয়মিত সমকক্ষীয় বৈদেশিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেন। গত মাসে বাইডেনের সঙ্গে ফোনে আলাপ করেছেন শি। জুনে সুইজারল্যান্ডে সামিটে পুতিন ও বাইডেন ঘনিষ্ঠভাবে অংশ নেন।
উভয়েই ইরানের পারমানবিক চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ছিলেন। বাইডেনের পরিকল্পনা ছিল তাদের ফিরিয়ে আনা। দুদেশই চলতি বছর হোয়াইট হাউজে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। এছাড়া, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের পর রাশিয়া ও চীন দুদেশই তালিবানের সঙ্গে যোগাযোগে প্রধান ভূমিকা অবলম্বন করেছে।
তবে, তা সত্ত্বেও তাদের এই সংযোগ প্রায়ক্ষেত্রেই বাছাইকৃত এবং আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও তারা বাধ্যবাধকতা মানেনি।
সাইডলাইন আলোচনাও হবে না
শনিবার জি-২০ তে এক ভিডিও বার্তায় শি ও পুতিন উভয়েই বৈশ্বিক টিকাদান নিয়ে উদ্বেগ জানান। উভয় দেশই অভিযোগ জানায় যে তাদের দেশের ভ্যাকসিনগুলো আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বীকৃত নয়। সম্মেলনের শেষে অতিরিক্ত আয়োজনে তারা ভার্চুয়ালি অংশ নিবেন বলে আশা করা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে কী আলোচনা হবে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগে থেকেই আলোচনা করা হয়ে থাকে। অপ্রত্যাশিত কোনো সংবাদ সাধারণত সামনে আসে না।
তবে, ২০১৬ সালের জি২০ সামিটে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পুতিনকে নির্বাচনে আগে রাশিয়ার সাইবার হামলা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছিলেন, 'কমিয়ে ফেলু্ন'।
দুই বছর পর জি-২০ সম্মেলনে নেতাদের এক ডিনারে পুতিন এবং ট্রাম্প কোনো স্টাফ বা নোট টেকারকে ছাড়াই একান্তে কথা বলতে দেখা যায়। একই সামিটে ট্রাম্পের সঙ্গে শি জিনপিং এক সাইড আলোচনায় স্থগিত বাণিজ্য বিষয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু করেন।
চীন এখনও আলোচনার কেন্দ্রে
তবে, শি জিনিপিংয়ের অনুপস্থিতির কারণে চীন যে তাদের এজেন্ডা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে, তা নয়। ইউরোপীয় নেতারা ওয়াশিংটন এবং বেইজিংয়ের মধ্যে বাড়তে থাকা উত্তেজনা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
চলতি সপ্তাহে সিএনএনের এক সাক্ষাৎকারে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট প্রথমবারের মতো দ্বীপটিতে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের উপস্থিতির কথা স্বীকার করেন। বেইজিং বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই ভালোমতো নেয়নি। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই জি-২০ সম্মেলনে শি কে প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে তাইওয়ানের বিষয়ে না জড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলোকে সতর্ক করেছেন।
শুক্রবারের আলোচনায় ম্যাক্রো এবং বাইডেন অধিকাংশ সময় চীন নিয়ে আলোচনা করেন। শীর্ষ এক কর্মকর্তা বিষয়টি 'তিনমুখী আলোচনা' বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি জানান, নতুন কোনো স্নায়ুযুদ্ধ কেউ চায় না। কিন্তু, চীনের উত্থান গণতন্ত্র, মিত্র ও বাজার অর্থনীতির জন্য যে হুমকি নিয়ে দাঁড়িয়েছে তা মোকাবেলা করার পথ খুঁকজছেন দুই রাষ্ট্রনেতা। দেশের স্বার্থ ও মূলনীতি রক্ষা করে কোনো দ্বন্দ্বে না জড়িয়ে কীভাবে এর সমাধান বের করা যায় সেটা নিয়েই ভাবছেন তারা।
- সূত্র: সিএনএন