প্রতিবছর চুরি হয়ে যাচ্ছে বিশ্বের অর্ধেক মিঠা পানি
বিশ্বের মিঠা পানির ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ সরবরাহ প্রতিবছর চুরি যাচ্ছে। কৃষিকাজে ব্যবহার এবং খামারিরা এর জন্য দায়ি। কিন্তু, এ অপরাধের চরিত্রটি এখনও স্পষ্ট নয়, বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার এডিলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে করা এক গবেষণা ফলাফল।
বিশ্ববিদ্যালয়টির বৈশ্বিক খাদ্য ও সম্পদ কেন্দ্রের অধ্যাপক, এবং গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক ড. অ্যাডাম লক জানান, চুরির ব্যাপারে প্রকৃত তথ্যটি পাওয়া বেশ মুশকিল।কারণ, অধিকাংশ সময়েই উন্নয়নশীল দেশের দরিদ্র এবং বৈষম্যের শিকার জনগোষ্ঠী পানি চুরিতে বাধ্য হন।
''তবে আমাদের মতো (অস্ট্রেলিয়া) উন্নত দেশেও কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য পানি চুরি করা হয়'' লক বলেছেন। উন্নত দেশে অর্থের সঙ্কট নয়, বরং মুনাফা বাড়ানোর জন্যেই প্রাকৃতিক উৎস থেকে অবাধে পানি সংগ্রহের ঘটনা ঘটে।
তিনি আরো জানান, ''আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা- ইন্টারপোলের মতে, প্রতিবছর পৃথিবীর ৩০-৫০ শতাংশ মিঠা পানি চুরি হওয়া –নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অমূল্য এ সম্পদের সরবরাহ ও প্রাপ্তির সুযোগ দিনকে দিন কমছে। একারণেই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে চুরির প্রবণতা।''
এডিলেইড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় প্রাধান্য দেওয়া হয়, উন্নত বিশ্বের সম্পদটি চুরির ঘটনাকে। যা প্রকাশিত হয় ন্যাচারাল সাস্টেইনেবিলিটি নামক একটি পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক জার্নালে। গবেষকরা একটি কাঠামো ও মডেল তৈরি করে তা উন্নত বিশ্বের তিন ধরনের কৃষিকাজে প্রয়োগ করেন।
অর্থকরী ফসল উৎপাদনে যেমন; অস্ট্রেলিয়ায় তুলা, যুক্তরাষ্ট্রে গাঁজা এবং স্পেনে স্ট্রবেরি চাষের প্রাকৃতিক উৎসের পানির অনুমোদনহীন ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে মডেলটি তৈরি হয়। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।
লক জানান, গবেষণায় দেখা গেছে; সামাজিক মনোভাব, প্রতিষ্ঠান এবং ভবিষ্যৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তা উন্নত বিশ্বে মিঠা পানি চুরির প্রধান কারণ।
চৌর্যবৃত্তির এসব ঘটনা বন্ধ করতেও হিমশিম খাচ্ছে উন্নত দেশগুলো। স্পেনে পানি চুরির বন্ধ করতে গিয়ে পাল্টা শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্মীরা। যুক্তরাষ্ট্রে ফায়ার হাইড্রেন্ট বা দমকলের জন্য নির্ধারিত পানির উৎস থেকেও চুরি করছে গাঁজা চাষিরা। ফলে এসব বন্ধে অসহায় বোধ করছে মার্কিন পুলিশ বাহিনী।
গবেষণার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদটির সুষ্ঠু ব্যবহার এবং চুরি প্রতিরোধে যে মডেলটি তৈরি করা হয়- তা নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর জন্য সহায়ক হবে। এর সাহায্যে কার্যকর জরিমানা বা শাস্তিও নির্ধারণ করা যাবে। গবেষকদের আশা, চুরি বন্ধে যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা- ভবিষ্যতে এ প্রবণতা কমাতে সাহায্য করবে।
পদ্ধতিটির ব্যাখ্যায় লক বলেন, ''পানির সঙ্কট থাকলে তা চুরি হতেই থাকবে। কারণ চাষিরা তাদের ফসল রক্ষা করতে চান। ফসলের দামের চাইতে যদি পানির মূল্য কম হয়, তাহলে চুরি ঠেকানো যাবে না। কিন্তু, ফসলের সমদামে জরিমানা করা হলে- চুরির ঝুঁকিটি নিতে চাইবে না অনেকেই।''
ভূ-গর্ভস্থ স্তর, নদী, খাল-বিল থেকে মিঠাপানি অতিরিক্ত পরিমাণে আহরণ, বিশ্বের নানা দেশে পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বাড়িয়েছে মরুকরণ। অস্ট্রেলিয়ায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে তুলা চাষিদের বিপুল পরিমাণ পানি অনুমোদনহীন সংগ্রহ বিপুন্ন করেছে নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের নদীগুলোকে। ইতোপূর্বে, এবিসি টেলিভিশনের ফোর কর্নাস অনুষ্ঠানে এ চুরির ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়। পানির উচ্চতা পরিমাপে স্থানীয় সরকার যে ফলপ্রসূ পরিমাপ ব্যবস্থা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে, সেটাও তুলে ধরে প্রামাণ্য অনুষ্ঠানটি।
এরপর থেকেই প্রদেশটির বারওন-ডার্লিং নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট ও শাখা প্রশাখায় অত্যাধুনিক পানি পরিমাপক ব্যবস্থা বসানোর কাজ শুরু করেছে স্থানীয় সরকার। কিন্তু একাজে ব্যয় করতে হচ্ছে শত কোটি ডলার। সিংহভাগ খরচই হবে এর শেষ পর্যায়ে পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার প্রকল্পে।
এবিষয়ে লক বলেন, '' বিশ্বের প্রায় সকল দেশই এখন পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা যেন দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা যায়, সেদিকে নজর দিচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে মাত্র ২০-৩০ শতাংশ সুপেয় পানি রক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু, যারা মুনাফার জন্য পানি চুরি করছে, আমরা যদি তাদের শাস্তি দিতে উদ্যোগী হই- শুধুমাত্র তবেই পানি সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় উল্লেখযোগ্য সফলতা আসবে।''