ফিদেল কাস্ত্রোর দেশের মানুষ ফুঁসছে যে কারণে
গত ১১ জুলাই রাস্তায় নেমে আসে কিউবার বিক্ষুব্ধ জনগণ। খাদ্য সংকট, ওষুধ ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন তারা। 'মুক্তি' ও 'স্বৈরতন্ত্রের' অবসানের দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন অনেকে। জো বাইডেনসহ কিউবান-আমেরিকান রাজনীতিবিদদের দাবিই যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তাদের মুখে।
গত কয়েক দশকের মধ্যে কিউবায় এটিই সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ। টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল-দিয়াজ ক্যানেল অভিযোগ আনেন, যুক্তরাষ্ট্রের উসকানিতে রাস্তায় নেমেছে জনগণ। দেশটিতে চলমান সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এবং তা দমনে নিরাপত্তা বাহিনীর বলপ্রয়োগে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিক্ষোভকারীদের কঠোরহস্তে দমনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তার ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত একজন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন শতাধিক।
হঠাৎ এভাবে ফুঁসে উঠলেন কেন কিউবার জনগণ? কেন সরকারের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে রাজপথে? কিউবার বর্তমান পরিস্থিতি এবং জনবিক্ষোভের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো এই লেখায়।
২০১৮- নতুন প্রেসিডেন্ট:
১৯৫৯ সালের কিউবা-বিপ্লবের পর থেকে কিউবা শাসন করছে কমিউনিস্ট পার্টি। টানা পাঁচ দশক দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন আমেরিকাবিরোধী বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো। কাস্ত্রো দেশ শাসন করেন ২০০৮ সাল পর্যন্ত। তারপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফিদেল কাস্ত্রোর স্থলাভিষিক্ত হন তার ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রো।
রাউল কাস্ত্রো রাজনীতিতে তার দলের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখেন। তবে তিনি কিউবার সোভিয়েত-স্টাইল অর্থনীতিকে উদার করে দেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা করার অনুমতি দেন কিউবানদের। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অনুমোদন দেন। বারাক ওবামার শাসনকালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্কের বৈরিতা কমিয়ে আনেন তিনি।
২০১৮ সালে রাউল কাস্ত্রো অবসরে যান। তার সঙ্গে অবসান ঘটে বিপ্লব-যুগের। কিন্তু ২০১৯ সালে দিয়াজ-ক্যানেলকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করলে কিউবায় নতুন যুগের সূচনা বাধাগ্রস্ত হয়।
রাউল কাস্ত্রোর বাছাই করা কমিউনিস্ট পার্টিরই সদস্য দিয়াজ-ক্যানেল। রাউল কাস্ত্রো ২০২১ সাল পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে কিউবা সরকারে থেকে যান। মনে করা হয়, এই পদটি প্রেসিডেন্ট পদের চেয়েও ক্ষমতাধর।
দুর্বল অর্থনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কসহ অনেকগুলো গুরুতর সমস্যার বোঝা মাথায় নিয়ে দায়িত্বে আসেন দিয়াজ-ক্যানেল।
এসবের সঙ্গে যোগ হয় নতুন চ্যালেঞ্জ—ইন্টারনেট। এই জিনিসটি তখন সবে সাধারণ কিউবানদের কাছে ব্যাপকভাবে সহজলভ্য হয়েছে। জনসাধারণ অনলাইন তথ্যভাণ্ডার এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সহজেই প্রবেশাধিকার পেয়ে যাওয়ায় বিরুদ্ধমত দমন করা দিয়াজ-ক্যানেলের জন্য পূর্বসূরিদের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন হয়ে ওঠে। বর্ধিত ইন্টারনেট-সুবিধার কল্যাণে দ্বীপ দেশটিতে অসংখ্য অভ্যন্তরীণ সমালোচক গজিয়ে ওঠে।
২০১৯- নতুন সংবিধান:
২০১৯ সালে কিউবান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে কিউবার নতুন সংবিধান পাস হয়। এর সুবাদে নতুন সমালোচকদের ক্ষোভ প্রদর্শনের সুযোগ ও স্বাধীনতা আরও বেড়ে যায়। জনগণকে আরও বেশি 'সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার' প্রদানের অঙ্গীকার করে একটি বিধান রাখা হয় নতুন সংবিধানে।
নতুন পাওয়া অধিকারগুলোর একটি ছিল সমাবেশ করার স্বাধীনতা।
আগে কিউবান জনগণের নামেমাত্র 'শান্তিপূর্ণ' বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সমাবেশ করার অধিকার ছিল। নতুন সংবিধানে জনগণের অধিকার আরও বিস্তৃত হয়। তবে এরপরও কিউবায় স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ ও বিক্ষোভকে সুদৃষ্টিতে দেখা হয় না। সরকার এ ধরনের যেকোনো কার্যক্রমকে বিদেশী শক্তি দ্বারা মদদপুষ্ট বলে মনে করে।
রাউল কাস্ত্রোর অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ৫ বছরের মেয়াদে দুবারের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে না পারার নিয়মের বৈধতাও দান করে ২০১৯ সালের সংবিধান।
২০২০- শিল্পীদের বিদ্রোহ:
গুরু রাউল কাস্ত্রোর পথ ধরে কিউবানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতার আওতা বাড়াচ্ছিলেন দিয়াজ-ক্যানেল। কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কারের চাপ তিনি উপেক্ষা করে যাচ্ছিলেন। তার এসব কর্মকাণ্ডেরই প্রতিফলন ঘটেছে কিউবার নতুন সংবিধানে।
কাস্ত্রো ২০০৯ সালে ক্ষুদ্র ব্যবসা বৈধ করার যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার একটি ফল হলো প্রতিবাদী শিল্পের বিকাশ।
এ পদক্ষেপের পর কিউবায় অনেক নতুন গ্যালারি ও মঞ্চ চালু হয়। এর ফলে বেসরকারি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোতে নিজেদের কাজ দেখানোর সুযোগ পান শিল্পীরা। নতুন পাওয়া এই সুবিধার বদৌলতে সরকারবিরোধী শিল্পীরা তাদের রাজনৈতিক দাবি জনসমক্ষে তুলে ধরতে থাকেন।
২০১৮ সালে স্বাধীন শৈল্পিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর বিধিনিষেধ করে দিয়াজ-ক্যানেল সরকার। এর ফলে বহু শিল্পী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারপর ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রকাশ্যে এই আদেশের বিরোধিতা করেন এক শিল্পী। তার বাড়িতে রেইড দেয় সরকার।
প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে কিউবার শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী মহল। সরকারের রেইডের পরদিন প্রায় ৩০০ জন শিল্পী হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের ডাক দেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেবার জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার দাবি জানান তারা।
সেই আলোচনা অল্প সময়ের মধ্যেই ভেস্তে যায়। বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর শুরু হয় দমন-পীড়ন। কিন্তু শিল্পীদের প্রতিবাদ চলতে থাকে। সরকার কল্পনাও করতে পারেনি এত তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী প্রতিবাদের মোকাবিলা করতে হবে তাদের।
কাস্ত্রো যুগের অবসান:
এ বছরের এপ্রিলে সর্বোচ্চ পদ থেকে ইস্তফা দেন রাউল কাস্ত্রো। পেছনে রেখে যান বদলে যাওয়া এক কিউবা।
দেশটি আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সোভিয়েত মদদপুষ্ট প্রতিপক্ষ কিংবা পারমাণবিক হুমকি হয়ে টিকে থাকতে পারল না।
কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার কারণে বাকি বিশ্ব থেকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন কিউবা ধুঁকতে থাকল।
ফিদেল কাস্ত্রো তার ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব দিয়ে কিউবার জনগণকে এক সুতোয় গেঁথে রেখেছিলেন। কিন্তু দিয়াজ-ক্যানেলের মধ্যে ফিদেল কাস্ত্রোর সম্মোহনী গুণ নেই। কিউবার তরুণ প্রজন্ম প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে কেবল নানা ধরনের সংকটই দেখে এসেছে।
কিউবা সরকার এখনও বিনামূল্যে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা দিয়ে যেতে পারছে। এ দুটোই কাস্ত্রো যুগের অবদান। কিন্তু তরুণ প্রজন্ম জানে, এই সরকারের অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য নেই।
অন্নসংস্থানের জন্য কিউবানদের আজ কঠিন সংগ্রাম করতে হচ্ছে। অনেকেই দুটি চাকরি করছেন। সম্প্রতি দেশটিতে মুদ্রা পরিবর্তন হয়েছে। এর মানে, দেশটিতে নগদ টাকার সংকট দেখা দিয়েছে। মানুষ বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারছে না। অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন, আগামী কয়েক মাসে কিউবায় নিত্যপণ্যের দাম ৫০০ থেকে ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে।
এসবের সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেশটিতে আবার বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। করোনা পরিস্থিতি ঠিকমতো সামাল দিতে পারছে না সরকার। অভিযোগ করা হচ্ছে, সরকার করোনায় মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা লুকিয়েছে। অনেক করোনা রোগী হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে ফিরে গেছেন। অ্যাসপিরিনের মতো প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও পাওয়া যাচ্ছে হাসপাতাল ও ফার্মেসিতে।
সরকারের এসব ব্যর্থতা ঘি ঢেলেছে মানুষের ক্ষোভের আগুনে। সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে উত্তাল রাজপথে।
- সূত্র: দ্য কনভারসেশন