মার্কিনী সাহায্য পায় বলেই ইজরায়েল প্যালেস্টাইনে নির্বিচার গণহত্যা চালাতে পারে: নোয়াম চমস্কি
ইজরায়েলের একের পর এক ধারাবাহিক সরকারগুলো বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনীদের জেরুজালেমের পবিত্র নগরী থেকে বের করে দেবার চেষ্টা করছে এবং ইজরায়েলের সর্বশেষ আক্রমণও সেই অভিমুখ লক্ষ্য করেই পরিচালিত হয়েছিল। তবে সে আক্রমণের তীব্রতার শেকড়-স্বরূপ এবং এক সর্বাত্মক যুদ্ধের সম্ভাব্য হুমকিকে বুঝতে হলে মার্কিনী সমর্থনপুষ্ট ইজরায়েলী সরকারের সন্ত্রাস ও বহিষ্কার নীতির মাধ্যমে ফিলিস্তিনীদের হত্যা এবং বিতাড়ন করে রাষ্ট্রের ভূখন্ডগত পরিসর বাড়ানোর নীতির নিরীক্ষা প্রয়োজন, খ্যাতনামা ভাষাবিদ ও চিন্তক নোয়াম চমস্কি এমনটিই বলেছেন তাঁর সাম্প্রতিক এক আলাপচারিতায়- ট্রুথ আউট পত্রিকার সাথে। ট্রুথ আউট পত্রিকার পক্ষ হয়ে তাঁর সাথে গত ১২ই মে ২০২১ তারিখে কথা বলেছেন সি.জে.পলিক্রোনিয়ু।
চমস্কি- ইউনিভার্সিটি অফ এ্যারিজোনায় ভাষাতত্ত্বের খ্যাতনামা অধ্যাপক এবং এমআইটি-র এমেরিটাস অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সঙ্ঘাত এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বিষয়ে বিশ্লেষক হিসেবে বিখ্যাত এবং প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করার আন্দোলনে এক অগ্রবর্তী কণ্ঠস্বর। এই বিষয়ে তাঁর নানা লেখার ভেতর রয়েছে "ভবিষ্যতসূচক ত্রিভুজ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইন; সঙ্কটে গাজা: প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যুদ্ধ বিষয়ক প্রতিচ্ছবি এবং প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গ।
সি.জে.পলিক্রোনিয়ু: নোয়াম, আমি উচ্ছেদ প্রচেষ্টার ভেতরেই আল-আকসা মসজিদে প্যালেস্টাইনীদের প্রতি সঙ্ঘটিত আক্রমণের প্রেক্ষিত থেকে শুরু করে গাজায় সর্বশেষ ইজরায়েলী বিমান আক্রমণের প্রসঙ্গে আপনাকে জিজ্ঞাসা করা শুরু করতে চাই। ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকতে জেরুজালেমে মার্কিনী দূতাবাস সরিয়ে নেয়ার সাথে নব্য-উপনিবেশবাদী ইজরায়েলী সন্ত্রাসের সর্বশেষ এই হামলা কতটা সম্পর্কিত এবং নতুন ও পুরণো কোন্ কোন্ উপাদান এই আক্রমণে রয়েছে?
নোয়াম চমস্কি: ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন সঙ্কটে সবসময়ই নতুন কোন না কোন বাঁক যুক্ত হচ্ছে তবে মূলত: এটি একটি পুরণো গল্পই যার শুরু হয়েছিল প্রায় এক শতাব্দী আগে এবং ১৯৬৭ সালে প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের দখল প্রতিষ্ঠা এবং ইজরায়েলের প্রধান দুই রাজনৈতিক পক্ষ কর্তৃক নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক নিষ্পত্তির উপরে রাষ্ট্রীয় সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে শতাব্দী প্রাচীন গল্পটি নতুন রূপ লাভ করে- গোটা বিষয়টিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাশা মাফিক বস্তুগত ও কূটনৈতিক সমর্থন যুগিয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে জায়নবাদী আন্দোলনে প্রধান যে প্রবণতাটি দেখা দেয়, সেই প্রবণতায় প্যালেস্টাইন প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট, দীর্ঘস্থায়ী লক্ষ্য ছিল। চাঁচা-ছোলা ভাবে বললে, এই লক্ষ্যটি হলো গোটা ইজরায়েল রাষ্ট্রকে ফিলিস্তিনী মুক্ত করা এবং ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দিয়ে শূন্যস্থাণ পূরণ করা এবং ইহুদি বসতি স্থাপণকারীদেরই "ভূমির ন্যায্য অধিকারী'' হিসেবে সস্রাব্দের নির্বাসনের পর প্রতিষ্ঠা করা।
শুরুতে গোটা ঘটনার দায়িত্বে থাকা বৃটিশই জায়নবাদী আন্দোলনের এই প্রকল্পকে ন্যায্যতা দিয়েছিল। লর্ড বালফুর, প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের একটি "জাতীয় বসতভূমি'' দেবার ঘোষণা দেন এবং পশ্চিমের অভিজাত, নৈতিক বিচারবোধ বেশ ভালভাবেই এমনটা ঘোষণা করেন যে "জায়নবাদ, সঠিক হোক আর ভুল হোক, ভাল বা মন্দ, বহু যুগের ঐতিহ্যে প্রোথিত এর শেকড়। এর শেকড় বর্তমানের প্রয়োজনে, ভবিষ্যতের আশায়, সুপ্রাচীন সেই ভূমিতে বর্তমানে বসবাসকারী সাত লক্ষ আরবের বাসনা ও কুসংস্কারের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবসম্পন্ন এই ইহুদি অভিবাসনকারীদের ফিরে আসায় প্রোথিত।''
এই অনুভূতিগুলো খুব অপরিচিত নয়।
জায়নবাদী নীতিমালা তখন থেকেই সুবিধাবাদী। যখনি সম্ভব, ইজরায়েলী সরকার- এবং প্রকৃতপক্ষে গোটা জায়নবাদী আন্দোলন- সন্ত্রাস এবং বিতাড়নের নীতিই অবলম্বন করে আসছে। পরিস্থিতি অবশ্য যখন একটু অন্যরকম হয়ে পড়ে এবং নির্বিচার সন্ত্রাস ও বিতাড়নকে অনুমোদন করেনা, তখন জায়নবাদী সরকার কিছুটা কোমলতর পন্থা গ্রহণ করে। এক শতাব্দী আগে, জায়নবাদী কৌশল ছিল নিছকই একটি প্রহরীদুর্গ ও প্রতিরক্ষাবেষ্টনী নির্মাণ করা এবং দ্রুতই এটি পরিণত হবে এক নয়া অভিবাসনে, পরিণত হবে চাঁচাছোলা তথ্যে। আর আজ কিনা অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ইজরায়েলী রাষ্ট্র আরো অধিকতর সংখ্যায় প্যালেস্টাইনী পরিবারগুলোকে তাদের ভিটে-মাটি থেকে বিতাড়ন করছে যেখানে তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করছে- এই কাজটি তারা করছে একধরণের আইনী বৈধতা অর্জনের ইশারার মাধ্যমে যাতে করে ইজরায়েলে বসবাসরত "সুন্দর আত্মা''র মানুষেরা প্যালেস্টাইনীদের প্রতি নিজেদের আচরণ নিয়ে কোন মনস্তাপে না ভোগে। অবশ্যই প্যালেস্টাইনীদের বহিষ্কারের জন্য গৃহীত সবচেয়ে উদ্ভট আইনী অজুহাতগুলো (অটোমান ভূমি আইন যেমন) একশ ভাগ বর্ণবাদী। যেখান থেকে বিতাড়িত হয়েছে সেই স্বদেশ ভূমে প্যালেস্টাইনীদের ফিরতে দেয়া অথবা তাদের ভাগ্যে এখনো যেটুকু জমি অবশিষ্ট আছে সেখানে বসতি গাঁড়ার অধিকার তাদের (প্যালেস্টাইনীদের) দেবার কোন ভাবনাই ইজরায়েলের নেই।
১৯৬৭ সালে ইজরায়েলের দ্বারা সম্পন্ন বিজয় বা দখলের ফলে বিজিত ভূখন্ডে একই ধরণের আরো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ ইজরায়েলের পক্ষে সম্ভব হয় এবং সেটা সম্ভব হয় আন্তর্জাতিক আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘনের মাধ্যমেই, যেহেতু কিনা ইজরায়েলী নেতৃবৃন্দকে তাদের সর্বোচ্চ আইনী কর্তৃপক্ষ এমনটাই অবহিত করেছেন। নতুন প্রকল্পগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইজরায়েলী সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক সব পরিবর্তনের মাধ্যমে তরান্বিত হয়েছিল। প্রাক-১৯৬৭ পর্বে ইজরায়েল-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ছিল মোটের উপর উষ্ণ তবে অনিশ্চিত। ১৯৬৭-এর যুদ্ধেও পরে ইজরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আশ্রিত রাষ্ট্র হিসেবে অভুতপূর্ব সাহায্য লাভের শিখরে ওঠে।
১৯৬৭-এর যুদ্ধে ইজরায়েলের জয় ছিল মার্কিনী সরকারের প্রতি এক বড় উপহার। ইতোমধ্যেই উগ্রবাদী বা র্যাডিক্যাল ইসলাম (যার ভিত্তি ছিল সৌদি আরবে) এবং ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের (নাসেরের নেতৃত্বাধীন মিশর) ভেতর একটি ছায়া যুদ্ধ চলছিল। অতীতে বৃটেন যেমন করেছে, ঠিক তেমনভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও উগ্রবাদী ইসলামকেই বেছে নিয়েছিল যা কিনা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের তুলনায় অনেক কম হুমকিদায়ক হবে। ইজরায়েলই ধ্বংস করলো আরব জাতীয়তাবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা।
ইতোমধ্যে ইজরায়েলের সামরিক পরাক্রম সেই ১৯৪৮ সালেই মার্কিনী সামরিক কর্তাদের মুগ্ধ করেছে এবং ১৯৬৭ সালের বিজয় এটা খুবই স্পষ্ট করে তুললো যে ইজরায়েল রাষ্ট্রটি আরব এলাকায় মার্কিনী ক্ষমতার একটি শক্ত ঘাঁটি হতে পারে এবং সেই সাথে মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদী লক্ষ্যসমূহের স্বপক্ষে মাধ্যমিক স্তরের যাবতীয় পরিষেবা যোগাতে পারে। মার্কিনী আঞ্চলিক আধিপত্য এই অঞ্চলে বা আরব ভূ-খন্ডে মূলত: তিনটি স্তম্ভের উপর নির্ভরশীল ছিল: ইজরায়েল, সৌদি আরব, ইরান (ইসলামী বিপ্লব পূর্ববতী শাহের ইরান)। কৌশলগতভাবে আপাত:দৃষ্টে মনে হয় এই তিনটি রাষ্ট্র বুঝি সর্বদা পরষ্পর যুদ্ধরত ছিল, তবে বাস্তবে তাদের মৈত্রী বা মিত্রতা ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ প্রকৃতির, বিশেষত: ইজরায়েল এবং খুনে প্রকৃতির ইরানী স্বৈরাচারী শাসন (শাহের সময়ে)।
সেই আন্তর্জাতিক পরিকাঠামোর ভেতরেই ইজরায়েল কিন্তু সেই সব নীতি গ্রহণের প্রশ্নে স্বাধীন ছিল যা আজো ইজরায়েলে অনুসৃত হচ্ছে। এসব নীতিমালাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই সর্মথন দিয়ে থাকে যদিও মাঝে মাঝে উভয়ের ভেতর কিছু মতান্তর দেখা দেয়। ইজরায়েল সরকারের আশু নীতিগত লক্ষ্য হচ্ছে একটি "বৃহত্তর ইজরায়েল'' গড়ে তোলা যেখানে থাকবে চারপাশের আরব গ্রামগুলোকে বেষ্টন করে থাকা ও বিপুলভাবে সম্প্রসারিত এক "জেরুজালেম,'' জর্ডান উপত্যকা, আবাদী জমির অনেকটা অংশ নিয়ে পশ্চিম তীরের বড়সর একটি ভাগ; এবং ইহুদিদের সাথে নিয়ে পশ্চিম তীরের অনেকটা ভেতরে অবস্থিত বড় শহরগুলো-শুধুমাত্র অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোই এই পশ্চিম তীরকে ইজরায়েল রাষ্ট্রের সাথে একাত্ম ও সংহত করবে। এই প্রকল্প এড়িয়ে যায় পশ্চিম তীরে নাবলুসের মত ফিলিস্তিনী জনবহুল এলাকাগুলো যাতে করে ইজরায়েলী নেতারা যাকে কিনা বলেন ভীতিকর "জনসংখ্যাগত সমস্যা'', তেমন সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া যায়: "বৃহত্তর ইজরায়েলে''র প্রস্তাবিত "গণতান্ত্রিক ইহুদি রাষ্ট্রে'' এত বিপুল সংখ্যক অ-ইহুদির উপস্থিতি যেন একটি সোনার পাথর বাটি যা প্রতিটি বছর চলে যাওয়ার সাথে সাথে গলাধকরণ করা আরো কঠিন হয়ে ওঠে।
"বৃহত্তর ইজরায়েল'' রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ১৬৫টি ছিটমহলে প্যালেস্টাইনীদের একরকম বন্দী করে রাখা হয়েছে, এক বৈরী সামরিক বাহিনী কর্তৃক তারা তাদের ভূমি এবং জলপাইকুঞ্জগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন, সহিংস ইহুদি গ্যাং বা দলগুলো (পর্বত শিখরের তরুণেরা বা হিলটপ ইয়ুথস নামের কুখ্যাত ইহুদি গ্যাং যেমন) কর্তৃক তারা (প্যালেস্টাইনীরা) ধারাবাহিক আক্রমণের শিকার আর এই কুখ্যাত ইহুদি গ্যাংগুলোকে ইজরায়েলী সেনাবাহিনীই নিরাপত্তা প্রদান করে থাকে।
ইতোমধ্যে ইজরায়েল জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের আদেশ অমান্য করেই গোলান মালভূমিকে নিজ ভূখন্ডের সাথে যুক্ত করেছে (ঠিক যেমনটি করেছিল জেরুজালেমের ক্ষেত্রেও)। গাজার বিভীষিকা জাগানো গল্পটি এতটাই জটিল যে এই স্বল্প পরিসরে সেটা বলা কঠিন। এটা সাম্প্রতিক সময়ের অপরাধগুলোর ভেতর মন্দতম আর এই অপরাধ কিনা প্রতারণা ও নিষ্ঠুরতার পক্ষে অনুনয় বিনয়ের চাদরে আবৃত করা হয়েছে।
ট্রাম্প ইজরায়েলের অপরাধকে লাগামহীন মুক্তি দেবার ক্ষেত্রে তাঁর পূর্বতনদের সব কাজকে ছাপিয়ে গেছেন। ইজরায়েলের স্বপক্ষে ট্রাম্পের অন্যতম বড় কাজ ছিল আব্রাহাম চুক্তিকে কাজে লাগানো যা কিনা ইজরায়েল এবং সাতটি আরব একনায়ক শাসিত রাষ্ট্রের ভেতর দীর্ঘস্থায়ী, মৌন এক ধরণের বোঝা-পড়াকে আনুষ্ঠানিকতা দান করেছে। এই চুক্তি ইজরায়েলের সন্ত্রাস ও সম্প্রসারণের উপর আরব রাষ্ট্রগুলোর রাশ পরানোর ক্ষমতাকে আরো সীমিত করেছে।
এই "আব্রাহাম চুক্তি'' ট্রাম্পের ভূ-তাত্ত্বিক পরিকল্পনা বা দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রধান অংশ বা উপাদান ছিল: নিষ্ঠুর এবং দমমূলক কতিপয় রাষ্ট্রের একটি প্রতিক্রিয়াশীল মৈত্রী জোট গঠন করা, যা ওয়াশিংটন থেকে দৌড় শুরু করে বোলসোনারোর ব্রাজিল, নরেন্দ্র মোদির ভারত, ভিক্টর ওর্বানের হাঙ্গেরী এবং এমন আরো কিছু রাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত হয়েছে। এই জোটের ভেতর মধ্যপ্রাচ্য-উত্তর আফ্রিকার অংশটি আল-সিসির শাসনাধীন ছদ্ম মিশরীয় স্বৈরাচার এবং মরক্কো থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন অবধি বিস্তৃত পারিবারিক একনায়কতন্ত্রের শাসনাধীন রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত। ইজরায়েল এই জোটের সামরিক পেশীশক্তি গঠন করে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যোগায় প্রত্যক্ষ পটভূমি।
আব্রাহাম চুক্তি ট্রাম্পের আর একটি উদ্দেশ্যকেও পূরণ করে: ওয়াশিংটনের ছাতার নিচে এই অঞ্চলের প্রধান সম্পদশালী এলাকাগুলোকে আনা, যাতে করে পরিবেশগত বিপর্যয় তৈরির ঘোড় দৌড়টা আরো জোরে করা যায় আর এই লক্ষ্যেই ট্রাম্প এবং তাঁর সহযোগীরা বিপুল উদ্দীপনায় নিজেদের নিযুক্ত করেছে। এই জোটের ভেতর রয়েছে মরক্কো, যাদের কিনা রয়েছে খনিজ সম্পদ ফসফটের, বলতে গেলে একচেটিয়া আধিপত্য আর মরক্কো শিল্পায়িত কৃষির কাজে এই ফসফেট ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে যা ধ্বংস করছে মৃত্তিকা এবং পরিবেশকে বিষাক্ত করছে। মরক্কোদেশীয়দের এই প্রায়-একাধিপত্যকে বাড়াতেই ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে পশ্চিম সাহারায় মরক্কোর নিষ্ঠুর এবং বেআইনী দখলকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, দিয়েছেন জোর সমর্থন। উল্লেখ্য যে পশ্চিম সাহারায়ও রয়েছে ফসফেটের বিপুল সঞ্চয়। সত্যিই এই বিষয়টা খানিকটা কৌতুকোদ্দীপক যে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর, নির্যাতনমূলক এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের মৈত্রীজোটের এই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিদান নানা মতের মানুষের দ্বারা বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
যাহোক এখন জো বাইডেন এই প্রকল্পগুলোর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ট্রাম্প জমানার অকৃত্রিম বর্বরতা (উদাহরণ হিসেবে গাজায় ভঙ্গুর জীবনরেখা রক্ষার শেষ সুযোগটুকুও বাতিল করা, যেহেতু ট্রাম্পের ব্যখ্যা মতে ফিলিস্তিনীদের ন্যায্য আকাঙ্খা ট্রাম্প গুঁড়িয়ে দেয়ায় তারা যথেষ্ট পরিমাণে কৃতজ্ঞ হয়নি) বাইডেন বাতিল করেছেন। অন্যথায় ট্রাম্প-কুশনারের অপরাধের হর্ম্যপ্রাসাদ আজো অক্ষত থাকত। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, এই হর্ম্যসৌধ আল-আকসা মসজিদে প্রার্থনারত প্যালেস্টাইনীদের উপর পুন: পুন: ইজরায়েলী আক্রমণের কারণে বা ইজরায়েলের চালানো নির্বিচার সন্ত্রাসের কারণেও টলে যেতে পারত।
পলিক্রোনিয়ু: ইজরায়েল কর্তৃক এই বসতি স্থাপনের কোন আইনী বৈধতা নেই। তাহলে কেন তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মার্কিনী আইনের লঙ্ঘন করে ইজরায়েলকে সাহায্য দিচ্ছে এবং কেন প্রগতিশীল মহল এই বেআইনী কাজের দিকে দৃষ্টি ফেরাচ্ছে না?
চমস্কি: ১৯৬৭ সালে সন্ত্রাসে দক্ষতা অর্জনের যে বিশাল উদাহরণ ইজরায়েল প্রদর্শন করে, তারপর থেকেই ইজরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক অত্যন্ত উচ্চ মূল্যায়িত, আশ্রিত রাষ্ট্র। আইন এক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারসমূহ বরাবরই মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদী অনুশীলনের জায়গা থেকে দেশীয় আইনের প্রতি দর্পিত মনোভাব দেখিয়েছে: মার্কিনী সংবিধান মার্কিনী সরকার কর্তৃক গৃহীত চুক্তিগুলোকে "দেশের সর্বোচ্চ আইন'' হিসেবে ঘোষণা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রধান চুক্তি বা ইউএন চার্টার (জাতিসঙ্ঘ সনদ) আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীতে "বলপ্রয়োগের হুমকি বা বলপ্রয়োগ''-এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে (ব্যতিক্রম সাপেক্ষে যা সত্যিকারের নানা ঘটনার ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক)। কিন্তু বাস্তবে কি আপনি এমন একজন রাষ্ট্রপতির কথা ভাবতে পারেন যিনি দেশের সর্বোচ্চ আইন প্রায়ই ভঙ্গ করেননি? উদাহরণ হিসেবে, সেই ঘোষণার কথাই বলা যাক যেখানে বলা হয়েছিল যে ইরান মার্কিনী আদেশ লঙ্ঘন করলে সব বিকল্প খোলা আছে- এছাড়া "সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক অপরাধের'' (ন্যুরেমবার্গ বিচার) পাঠ্য-পুস্তক দৃষ্টান্তের কথা বলতে হলে ইরাক আক্রমণের কথা না হয় বাদই দিন।
ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রাগার নিয়ে বরং মার্কিনী আইনের আওতায় প্রশ্ন ওঠা উচিত যে ইজরায়েলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার আইনী বৈধতার ভিত্তি কি? এই আইনগত অস্বাচ্ছন্দ্যকে ইজরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রাগারের অস্তিত্বকে স্বীকার না করে দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যায়; এটা এমনই এক নিরবিচ্ছিন্ন প্রহসন এবং এই প্রহসনের ফলাফলের অনিবার্যতা আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা, যেমনটা আগেই আলোচিত হয়েছে। ইজরায়েলকে প্রদত্ত মার্কিনী সামরিক সাহায্য লিহি আইনকেও লঙ্ঘন করে যা কিনা ধারাবাহিক ও নিয়মিত মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যপৃত সব খাতে সামরিক সাহায্য প্রদানকে নিষিদ্ধ করেছে। ইজরায়েলী সামরিক বাহিনীগুলো এক্ষেত্রে অনেক প্রতিযোগীর জন্ম দিয়েছে।
কংগ্রেসওম্যান বেটি ম্যাককলাম এমন এক উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্যালেস্টাইনীদের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের ভয়ানক সব অপরাধের ক্ষেত্রে মার্কিনী সাহায্যকে যারা সমর্থন করেন, তাদের জন্য এহেন উদ্যোগকে সামনে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই প্রধান প্রতিশ্রুতির জায়গা। যদিও ইজরায়েলকে দেওয়া বিপুল পরিমাণ মার্কিনী সাহায্য প্রবাহকে সামান্য হুঁশিয়ারী দিলেও নাটকীয় অভিঘাতের জন্ম হতে পারত।
- সি.জে.পলিক্রোনিয়ু
রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ/রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যিনি ইউরোপ ও আমেরিকার অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রে শিক্ষকতা ও কাজ করেছেন। বর্তমানে তাঁর প্রধান গবেষণার আগ্রহের ক্ষেত্রগুলো হলো ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সংহতকরণ, বিশ্বায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং নিউ লিবারেল মতবাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রকল্পের বিনির্মাণ। অসংখ্য বই এবং নানা ধরণের জার্ণাল, পত্রিকা, সংবাদপত্র ও জনপ্রিয় নানা সংবাদ ভিত্তিক ওয়েব-সাইটে অসংখ্য নিবন্ধ তিনি প্রকাশ করেছেন। তাঁর নানা প্রকাশনা বেশ কিছু বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে যাদের ভেতর রয়েছে আরবী, ক্রোয়েশীয়, ডাচ, ফরাসী, গ্রিক, ইতালীয়, পর্তুগীজ, রুশ, স্প্যানিশ ও তুর্কী। তাঁর সাম্প্রতিকতম বই "হতাশার উপরে আশা: পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্য ও সামাজিক পরিবর্তন বিষয়ে নোয়াম চমস্কি,'' ট্রুথ আউট পত্রিকায় প্রকাশিত চমস্কির বেশ কিছু আলাপচারিতার একটি সঙ্কলন; জলবায়ু সঙ্কট ও বৈশ্বিক সবুজ নতুন চুক্তি: গ্রহকে বাঁচানোর রাজনৈতিক অর্থনীতি (নোয়াম চমস্কি ও রবার্ট পলিন প্রাথমিক লেখক): এবং "প্রাক্কলন: নিও লিবারেল মতবাদ, অতিমারী ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জরুরি প্রয়োজন'' শুরুতে ট্রুথ আউটে প্রকাশিত হয়েছে এবং পরে হেমার্কেট বুকস কর্তৃক সঙ্কলিত হয়েছে (২০২১-এর জুনে প্রকাশিত হবার কথা)।
- ভাষান্তর: অদিতি ফাল্গুনী