মার্কিন জার্নালে কোভিড টিকা ট্রায়ালের বহুল প্রতীক্ষিত ফলপ্রকাশ করলো চীনের সিনোফার্ম
চীনের ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা সিনোফার্মের তৈরি টিকা সফলভাবে কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রসিদ্ধ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার তথ্যে একথা জানানো হয়। এবারই প্রথম মানব ট্রায়ালের শেষ পর্যায়ে সিনোফার্ম টিকার কার্যকারিতার বিস্তারিত তথ্য কোনো বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হলো।
বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার ফলটি গত বুধবার (২৬ মে) আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের 'জামা' জার্নালে প্রকাশিত হয়।
নিস্ক্রিয় করোনাভাইরাসের সাহায্যে দুটি প্রতিষেধক তৈরি করে সিনোফার্মের ভ্যাকসিন উৎপাদক ইউনিট চায়না ন্যাশনাল বায়োটেক গ্রুপ কো. (সিএনবিজি)। টিকা দুটি যথাক্রেমে; ৭২.৮ ও ৭৮.১ শতাংশ হারে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে পেরেছে। ইতঃপূর্বে, চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সিনোফার্ম যে কার্যকারিতা হার প্রকাশ করে, গবেষণার ফলাফলে তার সঙ্গে খুব একটা তারতম্য হয়নি।
চীনের সিনোফার্ম এবং বেইজিং ভিত্তিক সিনোভ্যাকের তৈরি টিকাগুলো উন্নয়নশীল দেশে টিকাদানের মূল উৎসে রুপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, সিশেলস বা পেরু সবখানেই টিকাকরণের মেরুদণ্ড হয়ে উঠছে চীন প্রদত্ত ভ্যাকসিনের চালান।
এই অবস্থায় সুরক্ষা তথ্য নিশ্চিত হওয়া ছিল অত্যন্ত দরকারি। কারণ, মহামারি প্রতিরোধসহ কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এর সঙ্গে জড়িত।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশসমূহ এই টিকাগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। টিকা উৎপাদকদের প্রতি নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণ বৈজ্ঞানিক তথ্য-প্রমাণ প্রকাশ না করার অভিযোগও তোলা হয় এসময়।
পশ্চিমা প্রচারণার ফলে চীনা প্রতিষেধকের প্রতিরোধ সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ বাড়ে। তার ওপর আবার, সিশেলস ও চিলির মতো দেশে যেখানে চীনা টিকার মাধ্যমেই একটি বড় অংশের জনগণের টিকাকরণ হয়েছে, সেখানে হঠাৎ করেই সংক্রমণের মাত্রা ঊর্ধ্বগামী হওয়ায় সংশয় ঘনীভূত হয়।
ওই সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ কঠোর নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার জন্য পরিচিত বেশকিছু দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ চীনা প্রতিষেধকের জরুরি অনুমোদন স্থগিত রাখে।
সিনোভ্যাকের ট্রায়ালের ফলাফল বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের সমর্থিত হলেই কেবল তাদের তৈরি টিকা অনুমোদন দেওয়ার নীতি নিয়েছিল চীনের স্বশাসিত ভূখণ্ড হংকং। চলতি বছরের শুরুতে অবশ্য সেই শর্ত তুলে নেওয়া হয়। তবে সিঙ্গাপুরের নিয়ন্ত্রকরা এখনও আরও তথ্য প্রদানের দাবি জানাচ্ছেন।
টিকাগ্রহীতাদের গুরুতর সংক্রমণ হয়নি:
জামা জার্নালে প্রকাশিত ট্রায়ালটি পরিচালিত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন, মিশর ও জর্ডানে। এসব দেশের মোট ৪০,৮৩২ জন নাগরিক ট্রায়ালে অংশ নেন। অংশগ্রহণকারীদের তিনটি গ্রুপে ভাগ করে, তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে দুটি ভ্যাকসিনের যেকোনো একটি এবং কাউকে কোনোটাই না দিয়ে প্লেসেবো বা সাধারণ কোনো প্রতিক্রিয়াহীন ওষুধের নির্যাস দেওয়া হয়।
এভাবে টিকাদানের তিন সপ্তাহ পর WIV04 নামক টিকাগ্রহণকারীদের ২৬ জনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়ে, HBO2 নামে সিনোভ্যাকের দ্বিতীয় টিকা নেওয়া ২১ জন এবং প্লেসেবো গ্রহীতাদের ৯৫ জন আক্রান্ত হন।
ভ্যাকসিন নেওয়া সংক্রমিতদের কেউই গুরুতর অসুস্থ হননি, সেই তুলনায় প্লেসেবো নেওয়াদের মধ্যে দুজন মারাত্মক সংক্রমণের শিকার হন।
গত ১৭ মার্চ ট্রায়ালের বিশ্লেষিত ফলাফল জামা জার্নালে প্রকাশের জন্য জমা দেয় সিনোফার্ম। তারপর যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এটি নিরীক্ষার পর তা প্রকাশের অনুমোদন দেন, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানকে বিশ্লেষণের এই প্রক্রিয়া 'পিয়ার রিভ্যিউ' বলেই পরিচিত। এরপর গত ১২ মে প্রকাশনার জন্য এটি অনুমোদিত হয়, বলে এক বিবৃতিতে উল্লেখ করে সিনোফার্মের সহযোগী সংস্থা সিএনবিজি।
তবে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ট্রায়ালের কিছু সীমাবদ্ধতাও উঠে আসে। যেমন; অংশগ্রহণকারীদের সিংহভাগ বা ৮৫ শতাংশই ছিলেন পুরুষ। বয়সের বিচারে মাত্র ২ শতাংশ ছিলেন ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সের। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন অন্যান্য রোগমুক্ত ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। ফলে নারী, বয়োবৃদ্ধ এবং অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের মধ্যে টিকাগুলোর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিয়ে এখনও রয়েছে কিছুটা অনিশ্চয়তা।
তারপরও, চলতি মাসের শুরুতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিনোফার্মের একটি টিকাকে জরুরি অনুমোদন দেয়। এর ফলে জাতিসংঘের জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষটির কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় বিশ্বব্যাপী এটি বিতরণের পথ উন্মুক্ত হয়।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ