গবেষণার অর্থ সাবাড় করছে জার্নালগুলো, বেরোচ্ছে মানহীন-সন্দেহজনক গবেষণাপত্র
বিশ্বের বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা ব্যবস্থায় অদ্ভুত পরিবর্তন তৈরি হয়েছে। হঠাৎ করে অ্যাকাডেমিক জার্নালগুলোতে প্রকাশনার সংখ্যা হু-হু করে বেড়ে গিয়েছে। যেসব জার্নাল আগে সাপ্তাহিক বা দ্বিসাপ্তাহিক ছিল, সেগুলো হুট করে একদিনেই একাধিক ইস্যু প্রকাশ করতে শুরু করেছে।
বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশের এ হার অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক। যেমন পরিবেশ ও স্বাস্থ্য গবেষণা সংক্রান্ত জার্নাল ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অভ এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথ (আইজেইআরপিএইচ) গত বছর ১৭ হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকাশ করেছে যা এটির ২০১৬ সালের প্রকাশনার তুলনায় ১৩ গুণ বেশি।
প্রকৌশলী পাবলো গোমেজ ব্যারেইরো জানান, এমডিপিআই নামক একটি প্রকাশনা সংস্থার মালিকানাধীন জার্নালটি কাগজে-কলমে দ্বিসাপ্তাহিক হলেও এটি দৈনিক ছয়টি পর্যন্ত বিশেষ ইস্যুও প্রকাশ করেছে। চীনা রসায়নবিদ শু-কুন লিন সুইজারল্যান্ডে এমডিপিআই প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটি ইতোমধ্যে এর আয় কয়েকগুণ বাড়িয়েছে স্রেফ এ ধরনের জার্নাল আর্টিকেল প্রকাশের ফি থেকে। এভাবেই বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য বরাদ্দ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে এসব প্রকাশনা সংস্থা ও জার্নালগুলোর কাছে।
গোমেজ ব্যারেইরো লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনস, কিউ-এর মিলেনিয়াম সিড ব্যাংক-এ কাজ করেন। তিনি ও তার তিন সহকর্মী — ইতালিয়ান অর্থনীতিবিদ পাওলো ক্রোসেত্তো, কানাডিয়ান ইমিউনোলজিস্ট মার্ক হ্যানসন ও ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ ড্যান ব্রকিংটন — ২০১৮ সাল থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রকাশনার দুনিয়ার ভেতর কী ঘটছে তা জানার চেষ্টা করছেন। তারা চারজন মিলে বিশ্বের প্রধান সব প্রকাশনীর ওয়েবসাইট থেকে সব তথ্য কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে একত্র করেন। সে ডেটা থেকে তারা দেখতে পান, বিশ্বে প্রতি বছর প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণার সংখ্যা 'জ্যামিতিকহারে' বেড়েছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত গবেষণার সংখ্যা ২৮ লাখ ছাড়িয়েছে, যা কেবল ছয় বছর আগের তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি।
এসব প্রকাশনা সংস্থার মধ্যে তিনটির আচরণ বিশেষভাবে অস্বাভাবিক। এগুলোর বিশেষ ইস্যুগুলোতে অতি উচ্চ শতাংশে গবেষণা প্রকাশের তথ্য দেখতে পান ব্যারেইরো ও তার দল। এ তিনটি প্রকাশনা সংস্থা হলো সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ফ্রন্টিয়ার্স (৬৯%), লন্ডনভিত্তিক হিনডাওই (৬২%), এবং সর্বোপরি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক এমডিপিআই (৮৮%)।
গোমেজ ব্যারেইরো এ ধরনের প্রকাশনার চরম একটি উদাহরণ দিয়েছেন। মিশরের কায়রোর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সিটি অভ দ্য ফিউচার-এর প্রকৌশল অনুষদের ডিন অধ্যাপক এলসায়েদ তাগ এলদিনের আগে খুব বেশি প্রকাশিত গবেষণা ছিলই না। কিন্তু এ বছর তিনি ইতোমধ্যে ৪১৮টি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। সেগুলোও আবার ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে: কোভিড-১৯, সোলার প্যানেল, ন্যানোফ্লুইড, কৃষি থেকে শুরু করে এমনকি সাইবার আক্রমণ। বিশ্বের আর কোনো গবেষকের চেয়ে তিনি বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।
বিখ্যাত ব্রিটিশ বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা সংস্থা নেচার একটি গবেষণার মান যাচাই করতে ও সেটি প্রকাশনার সিদ্ধান্ত নিতে গড়ে ১৮৫ দিন সময় নেয়। অন্যদিকে এমডিপিআই একই কাজের জন্য কেবল ৩৭ দিন সময় নেয়। এছাড়া এটির প্রবন্ধ গ্রহণের হারও ৬০ শতাংশ।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার দুনিয়া বর্তমানে 'পাবলিশ অর পেরিশ' (প্রকাশ অথবা পতন)-এর নীতিতে চলে। আর এরই মাঝে এমডিপিআই-এর মতো কিছু প্রকাশনাসংস্থা নিজেদের ব্যবসায়িক মডেলেও পরিবর্তন এনেছে। এখন আর গবেষণাপত্র পাঠের জন্য পাঠককে অর্থ খরচ করতে হয় না, বরং গবেষণাকে উন্মুক্ত রাখতে গবেষকেরাই তাদের গবেষণা প্রকাশের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থ প্রদান করেন। যেমন এমডিপিআই-এর শীর্ষস্থানীয় জার্নাল আইজেইআরপিএইচ প্রতিটি গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য গবেষকদের থেকে দুই হাজার ৬৬৫ ডলার করে ফি নেয়।
অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অভ বার্সেলোনা'র ইনস্টিটিউট অভ এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স-এর নৃতত্ত্ববিদ ড্যান ব্রকিংটনের অনুমান, ২০২১ সালে এ ধরনের ফি থেকে এমডিপিআই প্রায় ৩৩০.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে। এ আয় তাদের বছর ছয়েক আগের আয়ের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। বর্তমান ব্যবস্থায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি অর্থের জন্য তাদের মান নিচে নামাতে পারে। আবার নিজেদের সিভি ভারী করতে গবেষকেরাও অন্তঃসারশূন্য গবেষণা প্রকাশ করতে পারেন।
চার গবেষক বিশ্বের বড় বড় বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ২০১৬ সাল থেকে প্রকাশিত ৮০ লাখ গবেষণাপত্র থেকে পাওয়া ডেটা বিশ্লেষণ করেছেন। এ সংস্থাগুলোর মধ্যে বড় পাঁচটি প্রকাশনাও রয়েছে: এলসেভিয়ার (২০২২ সালে প্রকাশিত মোট প্রবন্ধের ১৮ শতাংশ), এমডিপিআই (৯.৪%), স্প্রিঙ্গার (৮.৯%), উইলি (৮%), ও ফ্রন্টিয়ার্স (৪%)। বিশ্লেষণের ফলাফল থেকে দেখা যায়, গবেষণাপত্র প্রকাশ সবচেয়ে বেশি করেছে এমডিপিআই (২৭ শতাংশ বৃদ্ধি), এলসেভিয়ার (১৬%), এ ফ্রন্টিয়ার্স (১১%)। এ তিনটি প্রকাশনী থেকেই মিশরীয় ডিন এলদিনের গবেষণাগুলো বেরিয়েছে।
তবে এমডিপিআই-এর একজন মুখপাত্র সংস্থাটির প্রবৃদ্ধির জন্য এর ওপেন অ্যাক্সেস মডেল ও সারাবিশ্বের গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত থাকার বিষয়ের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে একসময় ঐতিহাসিকভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা গবেষকদের সংযুক্তির কথা বলেন তিনি। তার মতে, এমডিপিআই-এর বিশেষ ইস্যুগুলো নিয়মিত ইস্যুগুলোর মতোই মান বজায় রাখে। যদিও অর্থনীতিবিদ পাওলো ক্রোসেত্তোর দাবি, 'বিশেষ ইস্যুগুলো দেখে মনে হয় এগুলোতে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা সহজ।'
এমডিপিআই-এর মুখপাত্রের মতে, চার গবেষকের এ বিশ্লেষণে এমডিপিআই-এর ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। এমডিপিআই-এর মতে, গবেষণা মূল্যায়ন ও গ্রহণে এটির কেবল ৩৭ দিন লাগে কারণ এটির প্রায় ৬,০০০-এর মতো কর্মী রয়েছে। এছাড়া ফ্রন্টিয়ার্স-এর মুখপাত্রও চার গবেষকের বিশ্লেষণকে 'উল্লেখযোগ্যভাবে সীমাবদ্ধ ও সম্ভাব্য একপেশে' বলে অভিযোগ করেছেন।
তবে হিনডাওই এক্ষেত্রে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। আমেরিকান উইলি হিনডাওইকে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয়। পরের বছর নতুন মালিক কয়েক মাস ধরে বিশেষ ইস্যু প্রকাশ বন্ধ রাখে। গত মে মাসে হিনডাওই চারটি জার্নাল বন্ধ করেছে এবং প্রায় ১,৭০০ অস্বাভাবিক প্রবন্ধ সরিয়ে নিয়েছে।