যে কারণে চীনের সাথে ট্রাম্পের ব্যর্থ বাণিজ্য যুদ্ধ ত্যাগ করা উচিত বাইডেনের
আগামী সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কিন অনেক নীতিতেই বদল আনতে হবে জো বাইডেনকে। ব্যতিক্রম থেকে যাবে শুধু চীনের ক্ষেত্রে। তবে বাইডেন যদি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির প্রতি বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই সংঘাতপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখেন, তাহলে এর জন্য তাকে অনুতপ্ত হতে হবে একসময়।
ট্রাম্পের চেয়ে কম চীন বিরোধী হলেও বাইডেন ইতোমধ্যে চীনের বাণিজ্যচর্চা সম্পর্কে হোয়াইট হাউজে তার পূর্বসূরীদের অনেক অভিযোগের প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি এর আগে অভিযোগ করেছিলেন, চীন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি চুরি করছে, বৈদেশিক বাজারে পণ্য ফেলে আসছে এবং আমেরিকান কোম্পানিগুলোর কাছে থেকে প্রযুক্তি স্থানান্তরে বাধ্য করছে। তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে গত বছর হওয়া 'ফেইজ ওয়ান' দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি অথবা ২৫% শুল্ক অপসারণ করবেন না, যা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রপ্তানির প্রায় অর্ধেককে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বাইডেনের দৃষ্টিতে, 'একটি সুসংহত কৌশল নির্মাণের' লক্ষ্যে বিদ্যমান চুক্তির পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা না করা পর্যন্ত চীনের প্রতি চলমান দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না করাই শ্রেয়। তার মনোনীত মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি ক্যাথরিন তাই – যিনি একজন এশিয়ান-আমেরিকান বাণিজ্য আইনজীবী (যিনি অনর্গল ম্যান্দারিন ভাষায় কথা বলতে পারেন), চীনে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা থাকায় তিনি পর্যালোচনা প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
তবে উচ্চ শুল্ক এবং 'ফেইজ ওয়ান' এর চুক্তিটি যে অসঙ্গতিপূর্ণ তা বোঝার জন্য একটি বিস্তৃত পরীক্ষা নেওয়া উচিত নয়।
গত দুই বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনা রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কের অনুপাতের পরিমাণ বেড়েছে ৭০ শতাংশের'ও বেশি। এবং শুল্ক সাপেক্ষে চীনে মার্কিন রপ্তানির শেয়ার হয়েছে আকাশছোঁয়া, যা ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ২ শতাংশ থেকে দুই বছর পরে হয়েছে ৫০ শতাংশের বেশি।
একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র চীনা নানান সংস্থার বিরুদ্ধে ১১ বার নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করেছে। গত মাসে মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের রপ্তানি নিয়ন্ত্রক সংস্থার তালিকায় ৫৯টি চীনা প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিকে যুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে এখন পর্যন্ত সংস্থাটির তালিকায় যুক্ত হয়েছে ৩৫০টি চীনা নাম, যা যে কোন দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি।
এত উচ্চ খরচ এবং রপ্তানির উপর কঠোর সীমাবদ্ধতা থাকায় চীন সম্ভবত তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবে না, যার মধ্যে রয়েছে প্রথম পর্যায়ের চুক্তির অধীনে ২০২০-২১ সালে প্রায় ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমেরিকান পণ্য ও সেবা কেনার শর্ত। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে চীনে মার্কিন রপ্তানি চুক্তির লক্ষ্যমাত্রার থেকে অনেক কম রপ্তানি করা গেছে। ফলস্বরূপ, ২০২০ সালের নভেম্বরে বার্ষিক ক্রয় প্রতিশ্রুতির মাত্র ৫৭ শতাংশ পূরণ করেছে চীন।
দ্রুত গতিতে অগ্রগতির জন্য চীনের কাছে বিকল্প পন্থা খুবই সীমিত। মার্কিন আমদানির জন্য চীনা চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ এত উচ্চ শুল্কে আমেরিকান পণ্য কেনার জন্য বেসরকারি খাতকে নির্দেশ দেওয়া যাবে না। এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই শিথিলতা তুলে নিতে বাধ্য করা হলে তার নিজস্ব সমস্যার সৃষ্টি হবে।
উপসংহারটি পরিষ্কার: যতক্ষণ বাইডেন ট্রাম্পের সংঘাতপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখবেন, প্রথম পর্যায়ের চুক্তি মৌলিকভাবে অকার্যকর হবে এবং একটি পারস্পরিক লাভজনক বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকে অগ্রগতি আরও কঠিন হবে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যও ভেঙ্গে পড়তে পারে।
কিন্তু এর মানে এই নয় যে বাইডেন প্রশাসনের শুধুমাত্র শুল্ক অপসারণ করা প্রয়োজন। প্রথম পর্যায়ের চুক্তিটিও গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ, অন্তত তা মেনে চলার কারণে চীনকে অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি কমাতে বাধ্য করবে। চীন অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি উল্লেখযোগ্য সুবিধা প্রদান করে, ফলে এই চুক্তি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈষম্যহীনতার নীতিও লঙ্ঘন করতে পারে।
তাই অন্যান্য দেশ চেষ্টায় আছে প্রতিযোগিতার মাঠ সমান করার। ২০২০ সালের শেষে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চীন বিনিয়োগ সম্পর্কিত বিস্তৃত চুক্তি সমাপ্ত করে এবং চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত দশটি দেশ অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যাণদের সঙ্গে আঞ্চলিক বিস্তীর্ণ অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব (আরসিইপি) স্বাক্ষর করে।
এর কোনটাই আমেরিকার স্বার্থে নয়। স্টার্টারদের জন্য, সম্মিলিতভাবে আমেরিকার চতুর্থ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার আসিয়ান দেশগুলো সম্ভবত তাদের আরসিইপি অংশীদারদের কাছে আরো বাণিজ্য স্থানান্তরিত করতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে যে আরসিইপি কানাডা, মেক্সিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তিতে থাকা শ্রম এবং পরিবেশগত মানের অভাব এই পরিবর্তনকে শক্তিশালী করবে।
এছাড়াও অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড থেকে কৃষি ও জ্বালানী রপ্তানির জন্য চীনা চাহিদা বৃদ্ধি করতে পারে আরইসিপি। এবং পরোক্ষভাবে চীন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে- তথাকথিত 'আয়রন ট্রায়াঙ্গেল' এর মাধ্যমে এটি উত্তর-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সরবরাহ শৃঙ্খল মজবুত করবে। যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র একটি ক্রমবর্ধমান কৌশলগত অসুবিধার সম্মুখীন হবে।
ট্রাম্পের সংঘাতপূর্ণ চীন নীতি বজায় রাখার পরিবর্তে, বাইডেনের উচিত বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের কেন্দ্রীয় ভূমিকা গ্রহণ করা এবং একটি পারস্পরিক লাভজনক, বৈষম্যহীন বাণিজ্য চুক্তি অনুসরণ করা। ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্বের জন্য বিস্তৃত ও অগ্রসরমান চুক্তিতে যোগ দেওয়ার জন্য চীনের প্রচেষ্টা- যা ট্রান্স-প্যাসিফিক অংশীদারিত্ব থেকে চার বছর আগে ট্রাম্পের দায়িত্ব নেওয়ার পরে ত্যাগ করার পরে উত্থিত হয়েছিল - তা এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
বাইডেন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের সাথে তার সম্পর্ক নতুন করে শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে, তাকে অবশ্যই চীনের বিরুদ্ধে তার পূর্বসূরির বিধ্বংসী বাণিজ্য যুদ্ধ শেষ করতে হবে।
- মূল লেখা: Why Biden should abandon Trump's failed trade war with China
- অনুবাদ: সৈকত আমিন