সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থে যেভাবে কোভিড নিয়ে মিথ্যাচার করেছে ভারতের শীর্ষ গবেষণা সংস্থা
করোনাভাইরাস সংক্রমণ মারাত্মক রূপ নেবে না, সরকার অনুমোদিত ও গাণিতিক পদ্ধতি অনুসারে দেওয়া বৈজ্ঞানিক আভাসে ছিল এ আশ্বাস। কিন্তু, পরবর্তী সময়ে তা প্রচণ্ড ভুল প্রমাণিত হয়, জন্ম দেয় স্মরণকালের ভয়াবহতম ট্র্যাজেডির।
ভারতে কোভিড-১৯ মহামারির ভয়াল দ্বিতীয় ঢেউ হানা দেওয়ার আট মাস আগে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে এটি প্রকাশিত হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগকৃত বিজ্ঞানীরা ভাইরাসের নতুন প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকিকে নগণ্য বলে উপস্থাপন করেন।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে তারা লিখেছিলেন, শুরু থেকেই কড়া লকডাউনের সুবাদে ভারতে প্রথম দিককার সংক্রমণ গতি হ্রাস পেয়েছে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। তাদের এ অভয় বাণী ভারতীয় গণমাধ্যমেও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। জনগণ পায় সম্পূর্ণ ভুল বার্তা।
কিন্তু, বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফল ছিল, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রধান দুই লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। লক্ষ্য দুটি হলো; যত দ্রুত সম্ভব অর্থনীতির পুনঃউন্মুক্তকরণ এবং আসন্ন রাজ্য পর্যায়ের নির্বাচনে তার দল বিজেপির হয়ে ব্যাপক প্রচারণা অভিযানে অংশগ্রহণ।
ওই সময়ে ভারতের চিকিৎসা খাতের শীর্ষ বৈজ্ঞানিক সংস্থাটিতে (আইসিএমআর) কর্মরত ছিলেন ডা. অনুপ আগারওয়াল নামের একজন চিকিৎসক। তিনি ওই প্রতিবেদন মূল্যায়নে জড়িত ছিলেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এটি প্রকাশের ফলে দেশের মানুষ ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার ভুল ধারণা পাবে।
ডা. আগারওয়াল তার শঙ্কার কথা সংস্থার প্রধান কর্মকর্তার কাছেও তুলে ধরেছিলেন, যার প্রতিক্রিয়ায় তার বদলে গবেষণা মূল্যায়নে অন্য একজন বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বলাই বাহুল্য, পরবর্তীকালে আগারওয়ালের ধারণার চাইতেও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার হয় ১৩০ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশটি।
ভারতে মহামারির প্রথমদিকেই যখন দৈনিক হাজারো মানুষের মৃত্যু হচ্ছিল, তখন অনেক নাগরিকই প্রশ্ন তোলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও জনবহুল দেশের সরকার হয়ে এত বড় বিপর্যয়ের অনুমান করতে মোদি সরকার কীভাবে ব্যর্থ হলো? কেনইবা তারা সমূহ বিপদের আগাম আভাসগুলোকে গ্রাহ্য করেনি?
এসব প্রশ্নের সদুত্তর সন্ধানে দেশটির সাবেক ও বর্তমান সরকারি বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, গবেষকদের সঙ্গে আলোচনা করেছে মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। পরীক্ষা করেছে সরকারি নথিপত্র।
যার ভিত্তিতে জানা গেছে, সরকারের অভিজাত সংস্থার প্রধান কর্মকর্তারা, অধীনস্থ বিজ্ঞানীদের মোদি সরকারের রাজনৈতিক লক্ষ্য অনুসারে মহামারির হুমকি খাটো করে দেখাতে বাধ্য করেছেন।
৩২ বছর তরুণ গবেষক ডা. আগারওয়াল বলেন, "সে সময় সরকারি বক্তব্য সমর্থনে, বিজ্ঞানকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।"
সরকারি নথি ও গবেষকদের সূত্রে জানা যায়, ডা. আগরওয়ালের কর্মস্থল ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর) এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে ঝুঁকিমূলক তথ্য গোপন করেন। এরপর সরকারি প্রচেষ্টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণার ফলাফল প্রত্যাহারে বাধ্য করেন তারা। সংস্থার তৃতীয় আরেকটি গবেষণায় মারাত্মক দ্বিতীয় ঢেউয়ের আভাস ছিল, সেটিকেও তারা সমর্থন দেননি।
দ্য টাইমসকে সাক্ষাতকার দেওয়া সংস্থাটির বিজ্ঞানীরা অভিযোগ করেছেন, আইসিএমআর- এ আছে গোপনীয়তা চর্চার দমনমূলক নীতি। বিজ্ঞানের কোন অনুসন্ধান সরকারি নীতির বিপক্ষে গেলে- তা থামিয়ে দেওয়া হতো। ছিল না গবেষকদের নিজস্ব মতামত ও পর্যবেক্ষণের কদর।
তাছাড়া, কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হলে, সবসময় পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কায় থাকতেন মধ্য পর্যায়ের গবেষকরা। ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সাথে দ্বিমত পোষণকারীরা অন্যান্য সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হতেন।
ভারতের শীর্ষ ভাইরোলজিস্ট ও সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. শহিদ জামিল বলেন, "যে পরিবেশে বাক-স্বাধীনতার চর্চা থাকে, সেখানেই বিজ্ঞান বিকশিত হয়। অনুকূল পরিবেশে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা ও আলোচনার সুযোগ থাকে। কিন্তু, পরিতাপের বিষয়, আমাদের দেশের অনেক সংস্থায়, অনেক স্তরে- সে চর্চাটি অনুপস্থিত।"
এসব অভিযোগের ব্যাপারে দ্য টাইমসের অনুরোধের প্রেক্ষিতে কোন মন্তব্য করতে রাজী হয়নি আইসিএমআর কর্তৃপক্ষ।
তবে সংস্থার এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের স্বনামধন্য ও শীর্ষ সংস্থা হিসেবে আমরা ভারতের করোনাভাইরাস টেস্টের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা দিয়েছি।
সংস্থার মূল পরিচালক ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও যোগাযোগ করে টাইমস। কিন্তু, মন্ত্রণালয় এতে সাড়া দেয়নি।
তবে ভারতই একমাত্র নয়, বিশ্বের অনেক দেশের সরকার প্রধানেরা মহামারিকালে রাজনৈতিক অভিসন্ধি অর্জনে বিজ্ঞানের তথ্যপ্রমাণকে অস্বীকার করেছেন। এ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে ছিলেন সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। মহামারি সংক্রান্ত অপপ্রচার ও রাজনীতির জেরে যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় বিভাজনও গভীর হয়। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে সংক্রমণ বাড়তে থাকার পরও টিকা বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রচারণা জোর গতি পায়।
মহামারির শুরুতে চীনেও এমন রাজনীতিকরণ হয়েছে। দেশটি মহামারির প্রাথমিক উৎস নিয়ে অসচ্ছতা বজায় রাখে। আবার, রাশিয়া, স্পেন ও তানজিনিয়ার মতো দেশে টিকাবিরোধীরা ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে।
কিন্তু, এর ফলে সবচেয়ে ভয়াল পরিণতি বরণ করেছে ভারত। বিশাল এ দেশটিতে আগে থেকেই সরকারি স্বাস্থ্য খাত ছিল দুর্বল। তাই কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানা মাত্রই দেশটি তা সামলাতে হিমশিম খাবে- এটাই ছিল বাস্তবতা। তার ওপর সত্যিই যখন দ্বিতীয় ঢেউ হানা দিল, তখন ভাইরাস সংক্রমণের প্রধান উৎস হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী ডেল্টা ভেরিয়েন্ট। তার আগে মানুষ সরকারি আশ্বাসে বিশ্বাস করে, মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাও ছেড়ে দিয়েছিল।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মোদির নিজ দল বিজেপির একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য বিজয় চৌথিওয়ালে বলেন, "প্রধানমন্ত্রী মোদি কখনোই মানুষকে অসতর্ক হতে বলেননি।"
নিকট অতীতের ক্ষমতাসীনদের কার্যকালাপ কিন্তু এ দাবি সমর্থন করে না। দ্বিতীয় ঢেউ হানা দেওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে জানুয়ারিতে নরেন্দ্র মোদি দাবি করেন, ভারত মহামারির হুমকি থেকে বিশ্বকে রক্ষা করেছে।
তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন মার্চ মাসে বলেন, ভারত মহামারির শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
তবে দ্বিতীয় ঢেউ হানা দেওয়ার পর, তীব্র সমালোচনার মুখে গত জুলাইয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন কেন্দ্রীয় এ মন্ত্রী।
সরকারি এসব ভাষ্যকে সমর্থনদান ও সে অনুসারে ভুল ধারণা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে আইসিএমআর।
ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে সংস্থাটি বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি, ফলে বেসরকারি পর্যায়ের বিজ্ঞানীরাও- তা বিশ্লেষণ করে সঠিক আভাস দিতে বাধাগ্রস্ত হন। তথ্যের এ শূন্যতা পূরণে বিভিন্ন রকম ইতিবাচক পূর্বাভাস দিতে থাকে সংস্থাটি, যা অধিকাংশ সময়েই বিতর্কের জন্ম দেয়।
সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান, গত বছরের শুরু থেকেই এ নীতি নেয় সংস্থাটি। ওই সময় পুরো দেশে সংক্রমণ রোধে জাতীয় লকডাউন আরোপ করেন মোদি। তার দলের নেতারা তাবলীগ জামাতের মতো কিছু ইসলামী সম্মেলন থেকে পুরো দেশে ভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগ তোলেন। ফলে মুসলমানদের ওপর বিজেপির মূল সমর্থক হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সহিংস হামলা বৃদ্ধি পায়।
সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের এ আবহেই আইসিএমআর বলে, ধর্মীয় ওই সমাবেশে সংক্রমণ রোধের চেষ্টা ব্যাহত হয়েছে। লকডাউনের সুফল নষ্ট করেছে এ জমায়েত।
আইসিএমআর- এর প্রধান বিজ্ঞানী রমণ গঙ্গাখেদকর স্থানীয় এক সাক্ষাতকারে বলেন, এই জমায়েতটি অপ্রত্যাশিত ছিল।
দ্য টাইমসকে গঙ্গাখেদকর বলেছেন, মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ওই সময়ের সরকারি প্রচারণা নিয়ে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করলে, আইসিএমআর এর মহাপরিচালক বলরাম ভার্গভ তাঁকে বলেন, এনিয়ে তার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
এব্যাপারে ডা. বলরাম ভার্গভের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে,ও তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস