‘আমি চরম আতঙ্কিত’: ভুয়া কোভিড-১৯ টিকা নিয়ে শঙ্কায় আছেন হাজারো ভারতীয় নাগরিক
ভারতে যখন টিকা ডোজের সংকট, ঠিক তখনই সহজে ভ্যাকসিন পাওয়ার সুযোগ পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলেন রিশভ কামদার। সবচেয়ে বড় সুবিধা, টিকা নেওয়া যাবে বাড়ির কাছেই; সেজন্য লাইন দিয়ে টিকা কেন্দ্রে ভিড় করে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও নেন।
রিশভ থাকেন দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের একটি হাউজিং কমপ্লেক্সে। এর আগে তিনি সরকারি ভ্যাকসিন পোর্টালে নিবন্ধনের চেষ্টা করেছেন কয়েকদিন, কিন্তু শেষমেষ সুযোগ পাননি।
তারপর জানতে পারলেন, তার আবাসিক এলাকার একটি দাতব্য সংস্থাই এ টিকাদানের উদ্যোক্তা। স্থানীয় সংগঠন জেনে তিনি ভরসা পেয়ে প্রথমেই নিজের নাম লেখান। এরপর ৩০ জুন নির্ধারিত দিনে টিকার প্রথম ডোজ পান তিনি; কিন্তু তা আসলে কোভিড-১৯ টিকাই ছিল না। কী ছিল ওই সিরিঞ্জে?- তা আজো জানেন না ২৫ বছরের তরুণ রিশভ। তার সঙ্গে ওই আবাসিক স্থাপনার আরও ৩৯০ জন ভুয়া টিকার ইঞ্জেকশন নেন।
তাছাড়া, শুরুতে বিষয়টি কেউই জানতো না। কিন্তু, কয়েক দিন পার হওয়ার পরও যখন টিকাপ্রাপ্তরা কেউ সরকারি সনদ পেলেন না, তখন আবাসন কমপ্লেক্সটির কর্মকর্তারা আসলে কী হয়েছে- তা জানতে নিজস্ব অনুসন্ধান শুরু করেন।
এরপর সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের পর জানা যায়, অন্য অনেকের মতো তারাও এক বড় রকমের জালিয়াতির শিকার হয়েছেন। এ জালিয়াতি হয়েছে পুরো ভারতেই।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট'কে রিশভ বলেন, "টিকা নেওয়ার পর এক মাস পেরিয়ে গেল, অথচ আমি জানিনা আমার রক্তে কোন বিষ মেশানো হয়েছে। এর ফলে কী হতে পারে? আমি দীর্ঘমেয়াদী কোন অসুস্থতায় পড়তে পারি, সেই ভয়ে এখন চরম আতঙ্কে দিন কাটছে।"
তিনি জানান, সবাই একটু সন্দেহ করলই হয়তো জারিজুরি ধরা পড়তো, কারণ টিকা নেওয়ার সময় তারা কাউকে ছবি তুলতে দেয়নি। তাছাড়া, টিকা গ্রহণের পর কারো বাহুতে ইঞ্জেকশনের জায়গায় ব্যথা অনুভব হয়নি বা কোনো প্রকার বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি; তাই পরে সবার মনেই সন্দেহের মেঘ উঁকি দিতে থাকে। তবে ১৫ দিন পরও যখন কেউই সরকারি টিকা সনদ পেলেন না, তখনই সবার টনক নড়ে।
রিশভ জানান, "বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, সবার মুখেই এক কথা; আমার টিকা সনদ তো পেলাম না? তারপর যখন কেউ কেউ সনদ পেলেন, তখন সেখানে নাম ও টিকাগ্রহণের তারিখ ভুল, একেক জনের ক্ষেত্রে দেওয়া একেক টিকা কেন্দ্রের নাম।" অর্থাৎ জাল সনদ পান তারা।
হিরানন্দিনী হেরিটেজ হাউজিং কমপ্লেক্সের রিশভ নামের এ তরুণ ব্যবসায়ীসহ পুরো মহারাষ্ট্র রাজ্যে মোট দুই হাজার মানুষ ভুয়া টিকা চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
রাজ্য পুলিশ বলছে, প্রতারিত ব্যক্তিদের ইঞ্জেকশনে করে কী তরল দেওয়া হয়েছে- সেটা তারা এখনও জানতে পারেননি। তবে কর্মকর্তাদের ধারণা, স্যালাইন জাতীয় কোন মিশ্রণ হয়তো দেওয়া হতে পারে।
ভারতে এপর্যন্ত এটাই সবচেয়ে বড় টিকা নিয়ে জালিয়াতি। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে নিবন্ধিত চিকিৎসকসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এপ্রিল-জুন দুই মাস ধরে ভারতের আর্থিক প্রাণকেন্দ্র মুম্বাইয়ের ১২টি ভুয়া টিকাদান কেন্দ্রে এ প্রতারণা করা হয়। নগর কেন্দ্রের পাশপাশি নগরীর উপকণ্ঠের এলাকাগুলোতেও তৎপর ছিল জালিয়াত চক্র।
ভারতে মহামারির দুটি ঢেউয়েই ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল মুম্বাই মহানগরী। আর রাজ্য সরকারের আনুষ্ঠানিক হিসাবে, পুরো মহারাষ্ট্রে মারা গেছেন এক লাখ ২৪ হাজার জন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর বহুগুণ বেশি। মানুষের এই দুর্দশারই সুযোগ নেয় প্রতারকরা।
বিশেষ করে, মহামারির ভয়াল দ্বিতীয় ঢেউ হানা দেওয়ার পর সকলেই টিকা নিতে তাড়াহুড়ো করেছেন। তারমধ্যে এপ্রিলে যখন সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ লাগামহীন গতিতে বিস্তার লাভ করতে থাকে, তখন সরকারের কাছে ডোজের চরম সংকট দেখা দেয়।
পুলিশি সূত্র জানায়, এই সুযোগে প্রতারক চক্র বেসরকারি খাতের টিকা সরবরাহক হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করে। এর আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে টিকা বিক্রির সুযোগ করে দিয়েছিল- ভুয়া প্রতিষেধকের ব্যবসা তাতে ফুলেফেঁপে ওঠে।
প্রতারক চক্র বেসরকারি খাতের আসল টিকাদাতাদের চাইতেও ৫০ শতাংশ বেশি- ১,২৫০ রুপি করে নেয় প্রতিডোজ টিকার মূল্য। এভাবে শুধু মহারাষ্ট্রে ২ হাজার জনকে টিকা দিয়ে তারা লাভ করেছে ২০ লাখ রুপি।
পুলিশের ধারণা, হাসপাতালে টিকাদানের পর ফেলে দেওয়া ভ্যাকসিনের ধারক বা শিশিতে স্যালাইন বা অন্য কোন তরল ভরে তারা টিকাকরণ চালায়। ভ্যাকসিনের ধারকগুলো আসল হওয়ায় এ জালিয়াতি সহজে ধরার উপায় ছিল না। তবে মানুষকে আসলে কোন তরল ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে তা জানতে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলেই জানায় পুলিশের সূত্র।
মুম্বাইয়ের আরেক বাসিন্দা ৪৭ বছরের হিতেশ প্যাটেলের ১৮ বছরের ছেলেও এ প্রতারণার শিকার।
হিতেশ জানান, "এ ঘটনায় বেসরকারি খাতের ওপর আমার পুরো পরিবারের আস্থা উঠে গেছে। ভবিষ্যতে বেসরকারি টিকা কেন্দ্রে যাওয়ার আগে আমরা আরেকবার ভাবব।"
"টিকা নিয়েও মানুষ এভাবে প্রতারণা করতে পারে জেনে আমার ছেলে প্রথমে খুবই মুষড়ে পড়ে, তারপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়। এটি ছিল একটি সুসংগঠিত অপরাধ।"
প্রতারক হিসেবে গ্রেপ্তারকৃত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আদালতে জনস্বার্থে মামলা করেছেন মুম্বাই নিবাসী আইনজীবী সিদ্ধার্থ চন্দ্রশেখর। মামলার আর্জি শুনানির পর বোম্বে হাইকোর্ট, মহামারিকালে মানুষের আর্থিক দূরাবস্থার মধ্যে এভাবে ধোঁকা দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়াকে 'ভয়াবহ' ও 'দুঃখজনক' বলে মন্তব্য করেন।
মহামারিকালে ভারতে ভুয়া টিকার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে প্রধান স্থান করে নিলেও এটাই একমাত্র জালিয়াতি নয়। বরং সংকটের মুহূর্তে মানুষের অসহায়তা ও দুর্দশার সুযোগ নিয়ে অনেক ধরনের প্রতারক চক্র বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
যেমন; মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ যখন তীব্রতা লাভ করেছিল ওই সময় ভারতের রাজধানী দিল্লির পুলিশ অক্সিজেন সিলিন্ডারের বদলে অগ্নি-নির্বাপক সিলিন্ডার বিক্রির কয়েকটি চক্রের সন্ধান পায়। প্রতারকদের কেউ কেউ অক্সিজেনের জন্য অগ্রিম টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেয়। স্বাস্থ্যসেবা খাত ভেঙ্গে পড়ার ওই সময়ে কালোবাজারে বিক্রি বাড়ে নকল ওষুধ ও সুরক্ষা পণ্যের।
১৩০ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারতে মহামারির সর্বোচ্চ অবস্থায় একদিনে সোয়া ৪ লাখ নতুন সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সরকারি হিসেবে মহামারি হানা দেওয়ার পর থেকে এযাবত ৪ লাখের বেশি জীবন কেড়ে নিয়েছে কোভিড-১৯। মৃতদের অর্ধেক দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালে প্রাণ হারান।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যানুসারে, এপর্যন্ত মোট ৩৬ কোটি মানুষকে টিকার অন্তত এক ডোজ দেওয়া হয়েছে ভারতে। আর সম্পূর্ণরূপে বা দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন সাড়ে ৬ কোটি নাগরিক, যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪.৮ শতাংশ।
সূত্র: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট