বুল্লি বাই: ভারতে আবারও মুসলিম নারীদের হেনস্তায় ভুয়া অনলাইন নিলাম
বছরের প্রথমদিন ঘুম থেকে উঠেই বড় ধরনের ধাক্কা খান কাশ্মিরী সাংবাদিক কুরাতুলাইন রেহবার। তার অনুমতি ব্যতীত একটি অ্যাপে তার ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তার থেকেও ভয়ঙ্কর বিষয় হলো রেহবারকে বিক্রির জন্য নিলামে তোলা হয়েছে!
রেহবার একাই নন। ভারতের প্রায় ১০০ জনেরও বেশি মুসলিম নারীর ছবিসহ তাদের 'বিক্রির' বিজ্ঞাপন 'বুল্লি বাই' নামের একটি অ্যাপের মাধ্যমে নিলামে তোলা হয়েছে। ভুক্তভোগী নারীদের মধ্যে খ্যাতনামা অভিনয়শিল্পী শাবানা আজমিসহ দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতির স্ত্রী, বেশ কয়েকজন সাংবাদিক, সমাজকর্মী ও রাজনীতিকদের মতো সুপরিচিত ব্যক্তিত্বও রয়েছেন।
নারীদের ভুয়া নিলামে তোলা এই বিকৃতমনষ্কদের হাত থেকে রেহাই পাননি জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিখোঁজ শিক্ষার্থী নাজিব আহমেদের ৬৫ বছর বয়সী মা ফাতিমা নাফিসও। এই তালিকায় আরও রয়েছে পাকিস্তানি নোবেলজয়ী সমাজকর্মী মালালা ইউসুফজায়ীর নাম।
এর আগে গত জুলাই মাসে 'সুল্লি ডিলস' নামের একটি অ্যাপে ভারতের প্রায় ৮০ জন মুসলিম নারীকে 'নিলামে' তোলার অভিযোগ সামনে আসে। একবছরের মধ্যে এটি দ্বিতীয়বারের মতো মুসলিম নারীদের অনলাইনে হয়রানির ঘটনা।
ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট অল্টনিউজে কর্মরত সাংবাদিক মোহাম্মদ জোবাইর আল-জাজিরাকে বলেন, সুল্লি এবং বুল্লি দুটি শব্দই স্থানীয় ভাষায় মুসলিম নারীদের জন্য অবমাননাকর। নারীদের হেনস্থা করতে এ ধরনের শব্দ ব্যবহৃত হয়।
গত বছর জুলাইয়ে সুল্লি ডিলস নিয়ে রিপোর্ট করেছিলেন রেহবার। এবার নিজেই হয়রানির শিকার হয়ে তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, 'নিজের ছবি দেখার পর আমার গলা ভারি হয়ে আসছিল, গায়ে কাটা দিয়ে উঠছিল। আমি পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছিলাম। বিষয়টি আমার জন্য প্রচণ্ড অপমানজনক ও বড় এক ধাক্কা ছিল।'
মাইক্রোসফটের মালিকানাধীন উন্মুক্ত সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট সাইট গিটহাব ব্যবহার করে বুল্লি বাই নামের ভুয়া অ্যাপটি নির্মিত হয়।
রেহবারের মতে, সরব মুসলিম নারীদের অপমান ও হেনস্তার মাধ্যমে থামিয়ে দিতেই অ্যাপটি বানানো হয়েছে।
শনিবার অ্যাপটি সরিয়ে ফেলা হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য মুসলিম নারী তাদের ছবি ও ব্যক্তিগত তথ্য অ্যাপটিতে থাকার কথা জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ভুক্তভোগী নারীদের একজন নয়াদিল্লির সাংবাদিক ইসমাত আরা। শনিবার অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন ইসমাত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুসলিম নারীদের ছবি ব্যবহার করে মিথ্যাচার ও হেনস্তার অভিযোগ আনেন তিনি।
ইসমাতের অভিযোগের ভিত্তিতে রোববার দিল্লি পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ভারতীয় দণ্ডবিধির ধর্মীয় কারণে শত্রুতা, জাতীয় সংহতির প্রতি হুমকি ও নারীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির বিভিন্ন ধারার কথা উল্লেখ করে এফআইআর লিপিবদ্ধ করে।
বুল্লি বাই ডেভলপার এবং বেশ কয়েকটি টুইটার অ্যাকাউন্ট পরিচালনাকারীর বিরুদ্ধে মুম্বাইয়ে পৃথক মামলা দায়ের করেছেন সিদরাহ নামে আরেক ভুক্তভোগী নারী।
কিন্তু সুল্লি ডিলসের ঘটনার তদন্তে ছয় মাসেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আর তাই পুলিশি তদন্তেও কোনো ফল মিলবে না বলে মনে করছেন ইসমাত আরা।
সুল্লি ডিলস এবং বুল্লি বাই দুজায়গাতেই নিজের নাম পান মুম্বাইয়ের আইনজীবী ফাতিমা জোহরা খান। গত বছর তিনিও মুম্বাই পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
আল-জাজিরাকে ফাতিমা বলেন, 'মুম্বাই পুলিশ টুইটার, গিটহাব এবং গো-ড্যাডি (ওয়েব হোস্টিং কোম্পানি) প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে তথ্য চাইলেও তারা সাড়া দেয়নি। কোর্ট ওয়ারেন্ট ব্যতীত ওয়েবসাইটগুলো তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।'
তবে, দিল্লি ও মুম্বাই পুলিশের সঙ্গে আল-জাজিরা কথা বলতে চাইলেও তারা রাজি হয়নি।
'বিষয়টি দুঃখজনক যে এই বিদ্বেষকারীরা কোনো ভয়ভীতি ছাড়াই মুসলিম নারীদের টার্গেট করার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। এ ধরনের নিলাম এই প্রথম নয়,' বলেন তিনি।
ইসমাত আরও বলেন, 'সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিম ইস্যু নিয়ে সোচ্চার নারীদের টার্গেট করা হচ্ছে। অনলাইনে হিন্দু ডানপন্থীদের বিদ্বেষমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব মুসলিম নারীদের থামাতে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি পরিষ্কার।'
এর আগে গত বছর ১৩ মে ঈদ-ঊল-ফিতরের দিনও একই ঘটনা ঘটে।। সেদিন, ইউটিউবের একটি চ্যানেলে 'ঈদ আয়োজনে'র নাম দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানি নারীদের ছবি ব্যবহার করে 'নিলামের' ডাক দেওয়া হয়।
সেখানে মন্তব্যকারীরা নারীদের রেটিং প্রদানের পাশাপাশি পাঁচ রূপি, দশ রূপি ইত্যাদি বিভিন্ন মূল্য লিখে চলেছিল। ধর্ষণের হুমকিও দেয় তারা।
পরবর্তীতে টুইটারেও একাধিক ভুয়া একাউন্ট থেকে মুসলিম নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করা হয়।
এর আগে ভারতে অনলাইন হয়রানি বিষয়ক এক প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, যে নারীরা যত বেশি সরব হন, তাদের অনলাইন আক্রমণকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাও তত বেশি। তবে সংখ্যালঘু নারীরা সবক্ষেত্রেই আক্রমণের সহজ শিকার হয়ে থাকেন।
- সূত্র: আল-জাজিরা