ইলেকট্রিক কার প্রতিযোগিতায় জিততে মুকেশ আম্বানি কেন সোডিয়ামের ওপর বড় বাজি ধরেছেন?
স্মার্টফোন হোক বা টেসলা ইঙ্কের মতো বিখ্যাত কোম্পানির দামি বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি); লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির রাজত্ব আজ সর্বত্র। অথচ ইংল্যান্ডে ১০ কোটি পাউন্ড নিয়ে কেনাকাটা করতে গিয়ে সাধারণ সোডিয়াম নিয়েই কিনা ফিরলেন এশিয়ার সেরা ধনী!
তবে সোডিয়াম দিয়ে বিদ্যুৎকোষ (ব্যাটারি) তৈরির উপায়ও নেহাত মন্দ নয়। মুকেশ ইভি ব্যাটারির যে মহাকায় কারখানা (গিগাফ্যাক্টরি) স্থাপন করতে চান সেই লক্ষ্যের সহযোগী হতে পারে সোডিয়াম নির্ভরতা, যার প্রধান কারণ- কাঁচামালটির সহজলভ্যতা। যেমন পৃথিবীর ভুপৃষ্ঠে লিথিয়ামের চাইতে ৩০০ গুণ বেশি সোডিয়াম রয়েছে। দ্বিতীয় কারণ হলো- ইভির বিপুল চাহিদা। বর্তমানে ইভির বিক্রি এতোই বেড়েছে যে শুধু লিথিয়াম নয়, বরং উচ্চমানের নিকেল, কোবাল্টসহ ইভির ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত অনেক ধাতুর সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
২০৩০ সাল নাগাদ লিথিয়াম-আয়ন সেল তৈরিতে ব্যবহৃত ধাতুর চাহিদা পাঁচগুণ বাড়বে বলে জানিয়েছে ব্লুমবার্গ-এনইএফ। এমনকি চলতি ২০২২ সালেই বিগত কয়েক বছরের চেয়ে ইভির ব্যাটারিপ্যাক আরও দামি হয়ে উঠতে পারে।
দূষণমুক্ত শক্তিখাতে উৎপাদনে যেতে ৭৬ বিলিয়ন ডলারের এক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য বাস্তবায়নের পথে রয়েছে আম্বানির মূল প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তাই জটিল প্রযুক্তিতে যাওয়ার আগে প্রচলিত লিড-এসিড ব্যাটারির মতোন সস্তা সোডিয়াম প্রযুক্তির পেছনে তার বিনিয়োগ সহজেই বোধগম্য। এ উপকরণ পাওয়াও তুলনামূলক সহজ।
ভারতের ভোক্তারাই রিলায়েন্সের প্রধান বাজার। যেখানে পণ্যের মূল্য সংবেদনশীলতা একটি বড় নিয়ামক। সুলভে ব্যাটারি উৎপাদন করা গেলে ইভির বাজার নিয়ন্ত্রণেও এগিয়ে যাবেন মুকেশ। অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির বাজারেও এতে প্রতিযোগী সক্ষমতা তৈরি হবে। এসব বাজারের ক্রেতারা অ্যানোড ও ক্যাথোডের পাশাপাশি কম দামের সোডিয়াম আয়ন প্রযুক্তির ব্যাটারি পেলেও বর্তে যাবেন, যদি লিথিয়ামের তুলনায় এর পারফরম্যান্স খুব একটা হেরফের না করে।
কিন্তু, সত্যিই কী ভোক্তাদের থেকে এমন সাড়া মিলবে? আম্বানি অন্তত তেমন ধারণাই করছেন। প্রতি ইউনিট ওজনের বিপরীতে সোডিয়াম ব্যাটারির বিদ্যুৎধারণ ক্ষমতার চেয়ে এগিয়ে রয়েছে লিথিয়াম ব্যাটারি। তবে এই পার্থক্য ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে এমন আশাই করছেন তিনি। এই ব্যবধান কমাতে তার বিনিয়োগ বড় ভূমিকা রাখবে সেই লক্ষ্যেই ধরেছেন বাজি।
আম্বানি ইংল্যান্ডের শেফিল্ড ও অক্সফোর্ড ভিত্তিক ফ্যারাডিওন লিমিটেডেই শুধু ১০ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করেননি; বরং অতিরিক্ত আরও আড়াই কোটি পাউন্ড লগ্নী করছেন কোম্পানিটির বাণিজ্যিক পথচলা শুরুর পেছনে। ছোট্ট এই কোম্পানিতে বর্তমানে ১৬ জন কর্মী থাকলেও, গবেষণায় এগিয়ে রয়েছে তারা। ফ্যারাডিউনের রয়েছে ৩১টি আবিষ্কারের প্যাটেন্ট।
এসব প্রযুক্তি গুজরাটের জামনগরে রিলায়েন্সের গিগাফ্যাক্টরিতে ইভির ব্যাটারি প্রস্তুতে ব্যবহার করা হবে।
ভারতের শীর্ষ শিল্পপতির এই বিনিয়োগকে ব্যাখ্যা করেন যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক মার্সিয়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট- এর ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট (নবউদ্যোগে বিনিয়োগকারী) এবং ফ্যারাডিওনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা অশ্বিন কুমার: "লিথিয়াম মূল ধারার হলেও, সেটির নেই পর্যাপ্ত সরবরাহ। কোবাল্ট তো আরও দুর্লভ। অথচ বিপুল সোডিয়াম আহরণে আমরা এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছি।"
নবউদ্যোগ (স্টার্টআপ) ফ্যারাডিওন প্রায় এক দশক ধরে সোডিয়াম আয়ন নিয়ে গবেষণা করেছে। সংস্থাটির দাবি, তাদের তৈরি ব্যাটারি প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে ১৬০-১৭০ ওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ ধারণ করতে পারছে। খুব শিগগির এই ক্ষমতা ২০০ ওয়াট ঘন্টায় পৌঁছাবে বলে আশা করছে তারা।
প্রত্যাশিত এই ক্ষমতা হবে টেসলার চীনের কারখানায় তৈরি মডেল-থ্রি বৈদ্যুতিক কারে ব্যবহৃত লিথিয়াম-আয়ন-ফসফেট ব্যাটারির সক্ষমতার কাছাকাছি।
এসব পারফরম্যান্স সংখ্যার গুরুত্ব বর্তমান বাজার সম্পর্কে আরেকটু জানলেই বোঝা সম্ভব। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইভি ব্যাটারি উৎপাদক চীনের অ্যাম্পেরেক্স টেকনোলজি কোম্পানি লিমিটেড। গত গ্রীষ্মে তারা সোডিয়াম আয়ন বিদ্যুৎকোষ যুক্ত ব্যাটারি বাজারে আনে। কোম্পানিটির ঘোষণায়, প্রতি কেজি ওজনের বিপরীতে এই ব্যাটারি ১৬০ ওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ ধারণ করতে পারে বলে জানানো হয়। আর ২০২৩ সাল নাগাদ তৈরি হবে এর উপকরণ সরবরাহের চক্র।
অর্থাৎ, লিথিয়াম ব্যাটারির মতো এ খাতে এখনও চীনের রাজত্ব কায়েম হয়নি। আম্বানি একটি প্রতিযোগিতামূলক খাতেই বিনিয়োগ করেছেন, যাতে জয়-পরাজয় দুই সম্ভাবনাই রয়েছে। তাছাড়া, ভারতে সোডিয়াম প্রযুক্তি নিয়ে এখনও কোনো প্রতিপক্ষ স্বদেশী শিল্পপতি উদ্যমী হননি। সেটাও আম্বানির সামনে অমিত সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
বৈদ্যুতিক যানের ব্যাটারি উৎপাদনে নেভাদা থেকে নিউইয়র্ক, সাংহাই থেকে বার্লিন ও বুদাপেস্ট; সর্বত্র দেখা যাচ্ছে গিগাফ্যাক্টরি নির্মাণের উদ্যোগ। সে তুলনায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনবহুল দেশ ভারতে এই প্রযুক্তির পেছনে বিনিয়োগ হয়েছে যৎসামান্য।
তোশিবা কর্প, সুজুকি মোটর কর্প ও ডেনসো কর্প গুজরাটে যৌথভাবে একটি ব্যাটারি কারখানা স্থাপনে ১৮ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। এখানে উৎপাদিত ব্যাটারি মারুতি সুজুকির ইভিতে সরবরাহ করা হবে। এছাড়া, ভারতীয় কার প্রস্তুতকারকদের মধ্যে ব্যাটারিখাতে বিনিয়োগের কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে মুম্বাইভিত্তিক ব্রোকারেজ হাউজ কোটাক ইনস্টিটিউশনাল ইক্যুইটিজ। আম্বানির বিনিয়োগ সেই শূন্যতাকে শুধু পূরণই করবে না, বরং ছাপিয়ে যাবে।
পাশাপাশি ভারত সরকারের 'মেক ইন ইন্ডিয়া' লক্ষ্যের সহযোগী হয়ে বিপুল কর রেয়াত পাবেন মুকেশ। ভারতে ইভি স্টোরেজের (ব্যাটারি) বাজার বর্তমানে মাত্র ৩০ কোটি ডলার হলেও; তা চিরকাল এই অবস্থায় থাকবে। কোটাকের প্রক্ষেপণ অনুসারে, আগামী ২০ বছরে মোট কার ও মোটরসাইকেল বিক্রির ৭০ শতাংশই হবে বৈদ্যুতিক। আর ২০৫২ সাল নাগাদ এই বাজার বার্ষিক সাড়ে ৫৮ হাজার কোটি ডলারের মহীরুহে রুপ নেবে। এতে পুঁজিবাজারে ইভি উৎপাদকরা এক লাখ কোটি ডলার বাজারমূল্যের সম্পদ সৃষ্টি করবে বলে হিসাব কষেছে কোটাক।
তাই সবার মনোযোগ তখন অন্য খাতে, সুযোগ বুঝে শুনে সঠিক খাতেই 'দাঁও মারতে' উদ্যমী হলেন আম্বানি।
- লেখক: শিল্প প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক সেবাখাত বিষয়ে মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট অ্যান্ডি মুখার্জি। ইতঃপূর্বে তিনি কলাম লিখতেন রয়টার্সের ব্রেকিংভিউজে। এছাড়া, কাজ করেছেন বিখ্যাত গণমাধ্যম স্ট্রেইটস টাইমস, ইটি নাউ এবং ব্লুমবার্গ নিউজে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ অনুকরণে অনূদিত ও সংক্ষেপিত