যে কারণে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছে না জার্মানি
ইউক্রেনের এই দুঃসময়ে দেশটিতে অস্ত্র পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে জার্মানি। আর এতে বিভ্রান্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে মিত্র রাষ্ট্রগুলো। কিন্তু ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ জার্মানি কেনো অস্ত্র পাঠাতে অসম্মতি জানালো?
এর পেছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক কারণ।
বার্লিনের পূর্বে রয়েছে বিস্তীর্ণ এক তৃণ সমভূমি, যেই ভূমি আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতার এক টুকরো সাক্ষী হয়ে আছে।
সময়টি ছিল ১৯৪৫ সালের বসন্তকাল। হিটলার বার্লিনের একটি বাঙ্কারে লুকিয়ে ছিলেন; তার সৈন্যরা তখন আত্মসমার্পণের পথে। সোভিয়েত বাহিনী পূর্ব দিকের সমতল দিয়ে অগ্রসর হতে থাকলো। তাদের ওপরে ছিল সিলো হাইটস নামের এক উপত্যকা। সেখানে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিয়েছিল হিটলারের নাৎসিবাহিনী। তবে, শেষ পর্যন্ত ঠিক সুবিধা করে উঠতে পারেনি তারা।
এক রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়ার পর সোভিয়েতরা অবশেষ জয়ী হলো। যুদ্ধের সমাপ্তিও খানিটা এগিয়ে এলো তখন। তবে, এর জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল অনুমানিক ৩০ হাজার নাৎসিকে।
সিলো হাইটসের স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করলেই বোঝা যায়, এই নৃশংস ইতিহাস জার্মানদের মনে কতটা গভীরভাবে গেঁথে আছে; সেইসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহতা আজও কীভাবে দেশটির পররাষ্ট্র নীতিকে প্রভাবিত করছে।
জার্মানি ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাতে অস্বীকৃতি জানানোর একটি অন্যতম কারণ হলো, দেশটির রাজনীতিবিদরা এ ব্যাপারে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছেন। কারণ তারা মনে করেন, জার্মানি সর্বোপরি শান্তিবাদীদের দেশ।
বার্ষিক এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, বেশিরভাগ জার্মানরাই দ্বন্দ্ব সমাধানের সর্বোত্তম উপায় হিসেবে কূটনৈতিক আলোচনাতে বিশ্বাসী। জার্মান সৈন্যরা শান্তিরক্ষা মিশন ছাড়া অন্যান্য অপারেশনে অংশগ্রহণ করে না বললেই চলে। তবে, কিছু ব্যতিক্রম যেমন- ৯০'র দশকের বলকান এবং সম্প্রতিকালের আফগান অভিযান ছাড়া।
এছাড়া আরেকটি বিষয় হল, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারকদের মধ্যে জার্মানি অন্যতম। তবে কোথায় অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে, তার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখার আইন রয়েছে দেশটিতে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে সেই নিয়ম জার্মানিতে খুব কমই মানতে দেখা গেছে। এমনকি অ্যাঞ্জেলা মের্কেল সরকারকে মাঝেমধ্যেই সেসব নিয়ম ভাঙার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
জার্মান মার্শাল ফান্ডের টমাস ক্লাইন-ব্রকহফ বলেন, "যখন সর্বাত্মক সামরিক সংঘাতের কথা আসে তখন জার্মানি তার পুরনো নীতি অনুসরণ করে। দেশটি মনে করে, অস্ত্র রপ্তানি সংঘাত কমানোর পরিবর্তে সংঘাতে ইন্ধন দেয়। জার্মানির দীর্ঘদিনের এই নীতিই বলে দেয়, বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে দেশটি অস্ত্র রপ্তানি করে না।"
তবে উত্তর ইরাকে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত পেশমার্গা যোদ্ধাদের অস্ত্র দেওয়ার সময় জার্মানি সেই নীতি থেকে সরে এসেছিল। কিন্তু এখানে ইউক্রেনের পরিস্থিতি ভিন্ন বলে মনে করছেন টমাস। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকেই এখানে বড় করে দেখছেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউক্রেন সীমান্ত পরিস্থিতি জার্মানির নতুন জোট সরকারকে এক চরম পরীক্ষায় ফেলেছে।
দেশটির নতুন চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস হয়তো ভেবেছিলেন করোনা মহামারিই তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সেই ধারণাটি হয়তো শতভাগ সত্য হয়নি। জার্মানি যেন তার পুরনো নীতি থেকে সরে এসে আরও কঠোর অবস্থান নেয়, সেজন্য মিত্রদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন তিনি।
সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, গ্রিনস এবং ফ্রি ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে গেলো বছরের শেষের দিকে সরকার গঠন করেন শলৎস। মূল্যবোধ-ভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতি এবং অস্ত্র রপ্তানিতে কঠোর নিয়মনীতি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছিল।
কিয়েভে অস্ত্র পাঠানোর পরিবর্তে চ্যান্সেলর শলৎস জার্মানিতে আহত সৈন্যদের চিকিত্সায় একটি ফিল্ড হাসপাতাল নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছেন। সেইসঙ্গে পাঁচ হাজার হেলমেট পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছেন ইউক্রেনে।
অস্ত্র রপ্তানিতে জার্মানির অনিচ্ছার আরেকটি কারণ হলো, অনেক জার্মানই বিশ্বাস করেন না, অস্ত্র পাঠানোর মাধ্যমে সংকটের সমাধান হবে।
এছাড়া, শলৎসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রিন পার্টির রাজনীতিবিদ আনালেনা বেয়ারবক জানিয়েছেন, জার্মানি ইউক্রেনের আর্থিক দাতা হিসেবে কাজ করছে এবং দেশটি বিশ্বাস করে, অস্ত্র পাঠানোর চেয়ে আর্থিক দাতা হিসেবে কাজ করাই এক্ষেত্রে বেশি কার্যকর।
চ্যান্সেলর শলৎস তার পূর্বসূরি মের্কেলের নীতি অনুসরণ করতেই বেশি আগ্রহী। পূর্ব ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জার্মানি, ফ্রান্স, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে তথাকথিত 'নরম্যান্ডি ফর্ম্যাট' নামের একটি সংলাপ তৈরিতে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন অ্যাঞ্জেলা মের্কেল। আশা করা হচ্ছে, এবারের সংকটেও সেই একই ধরনের সংলাপ কাজ করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জার্মানি এ ধরনের কূটনীতির জন্য প্রস্তুত। প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে হয়তো চ্যান্সেলর শলৎসের সম্পর্কটি তেমন নয়, যেমনটি মের্কেলের সঙ্গে ছিল। তবে এক্ষেত্রে তাদের ইতিহাস কাজ করবে। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির সম্পর্ক অন্যান্য পশ্চিমা দেশের তুলনায় ভিন্ন।
হাজার হাজার জার্মান প্রতিষ্ঠান রাশিয়ায় ব্যবসা করছে। অনেক জার্মান নাগরিক স্কুলে রাশিয়ান ভাষা শেখেন। এমনকি তাদের মধ্যে অ্যাঞ্জেলা মের্কেলও রয়েছেন। অন্য নেতারা না পারলেও পুতিনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন তিনি। কমিউনিস্ট প্রাচ্যে তাদের একই রকম অভিজ্ঞতাই হয়তো রয়েছে এই যোগাযোগের পিছনে।
বিশ্বজুড়ে জার্মান সরকারের ওপর ক্ষোভ সৃষ্টির আরেকটি কারণ হলো, চ্যান্সেলর শলৎস কেনো তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি নিচ্ছেন না।
নর্ডস্ট্রিম ২ পাইপলাইনে মাধ্যমে জার্মানির ভেতর দিয়ে ইউরোপে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করবে রাশিয়া। তাই এই মুহূর্তে ওই প্রকল্প বাতিল ও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখোমুখি হচ্ছেন শলৎস।
জার্মান সরকার এখনও এই পদক্ষেপ না নেওয়ায় সমালোচকরা বলছেন, এমনটি না করার পেছনে স্বার্থ রয়েছে জার্মানির। এমনকি এই পাইপলাইনের ব্যাপারে জার্মান জোট সরকারের পক্ষগুলোর মাঝেও ভিন্নমত দেখা দিয়েছে।
শলৎস ইঙ্গিত দিয়েছেন, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ করতে চায়, তবে এই পাইপলাইনের বিষয়টি তাদের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। একে উপেক্ষা করেই পুতিনি সেখানে আক্রমণ চলাবেন। তবে অনেকেই মনে করছেন, তার এই ইঙ্গিত ইতিহাস প্ররোচিত।
মের্কেল যুগের শেষের দিক থেকেই বিশ্ব মঞ্চে জার্মানিকে আরও শক্তিশালী সামরিক অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে মিত্রতা।
তবে সিলো হাইটসে যারা কাতিউশা রকেটের গর্জন আর মৃত্যু পথযাত্রী সৈন্যদের চিৎকার শুনেছেন, শুধু তারাই জানেন জার্মানি খুব ভালভাবেই বুঝেছে কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে তারা; এবং যেকোনো ভুল সিদ্ধান্তের কতবড় মূল্য চুকাতে হবে তাদের।
- সূত্র: বিবিসি