নারী ভক্তের হয়ে ভারতের স্টক এক্সচেঞ্জ চালাতেন রহস্যময় হিমালয় গুরু!
যদি বলা হয় ভারতের সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ চালিয়েছেন হিমালয়ে বসে থাকা এক সাধু, বিশ্বাস করবেন? একজন সাধুর কী এমন ক্ষমতা আছে যার সাহায্যে তিনি হিমালয়ে বসে দেশটির সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক কারবারী নিয়ন্ত্রণ করলেন?
শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য যে এক-দুই বছর নয়, টানা ২০ বছর ভারতের ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে (এনএসই) কল কাঠি নেড়েছেন এই আধ্যাত্মিক সাধু।
ভারতের শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অভ ইন্ডিয়ার (এসইবিআই) সাম্প্রতিক এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনএসইর সাবেক প্রধান নির্বাহী চিত্রা রামকৃষ্ণ ক্ষমতায় থাকাকালে শেয়ারবাজার পরিচালনা করতেন ওই সাধুর পরামর্শে। টানা ২০ বছর যাবত শেয়ারবাজারের গোপনীয় তথ্য ওই সাধুর কাছে পাঠিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নিতেন।
প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকাকালে এনএসইর আর্থিক প্রাক্কলন, ব্যবসা পরিকল্পনা, বোর্ড এজেন্ডাসহ নানা তথ্য ওই আধ্যাত্মিক সাধুকে জানিয়েছেন রামকৃষ্ণ। এসইবিআই একে 'অদ্ভুত অসদাচরণ' ও তাদের বিধিমালার 'চরম লঙ্ঘন' বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।
১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের এই সর্ববৃহৎ শেয়ারবাজরের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন চিত্রা। এরপর ১৯৯৬ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন এর বিভিন্ন পদে। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এনএসইর সিইও পদে ছিলেন চিত্রা রামকৃষ্ণ। কিন্তু ২০১৬ সালে ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে এই পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।
তারপর এনএসই ও তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠতে থাকে। সেসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ২০১৭ সালে তদন্তে নামে এসইবিআই। তিন বছর তদন্তের পর এ মাসের শুরুর দিকে ১৯০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রকাশ করে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
তদন্তের সময় চিত্রা জানান, ওই গুরুকে তিনি কোনোদিন চোখে দেখেননি। তবে চোখ বুজে বিশ্বাস করে গেছেন। আর মেইলে পাঠানো তার পরামর্শগুলো নির্দ্বিধায় বাস্তবায়ন করে গেছেন।
শুধু স্টক এক্সচেঞ্জের ভেতরের যাবতীয় কার্যকলাপই নয়, তিনি ওই সাধুর কাছে পাঠাতেন কর্মীদের বার্ষিক মূল্যায়ণন। নিতেন পরামর্শ। সাধুর পরামর্শে হতো কর্মীতের পদোন্নোতি।
এসইবিআই বলছে, আড়ালে থেকে সাধুই কার্যত স্টক এক্সচেঞ্জ চালাতেন। চিত্রা ছিলেন তার হাতের 'পুতুল'মাত্র। এনএসইর অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক পরিকল্পনা বাইরের কারও কাছে প্রকাশ করা একটি 'সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার'। এই ঘটনা স্টোক এক্সচেঞ্জের 'ভিত' নাড়িয়ে দিতে পারে।
যেভাবে ওই গুরুর সন্ধান পেল এসইবিআই
এসইবিআই বিগত কয়েক বছর যাবত ন্যাশনাল এক্সচেঞ্জে কিছু অনিয়ম লক্ষ করে আসছিল। তারা জানতে পেরেছিল, কিছু কর্মকর্তার মাধ্যমে এক্সচেঞ্জের ভেতরের ট্রেডিংয়ের খবর নির্দিষ্ট কিছু ট্রেডারের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। আর এসব ট্রেডাররা এই খবর কাজে লাগিয়ে বারবার ট্রেডিং করত।
মূলত এই বিষয়টিকেই খতিয়ে দেখার জন্য তদন্তে নামে এসইবিআই। আর সেই তদন্ত করতে গিয়েই তারা চিত্রা রামকৃষ্ণের ই-মেইলের কথা জানতে পারেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, চিত্রা রামকৃষ্ণ ও হিমালয়ের আধ্যাত্মিক গুরুর যোগাযোগ হতো ই-মেইলের মাধ্যমে। এসইবিআই অফিসারদের জেরার মুখে চিত্রা ওই লোকের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন যে, এটি একটি 'আধ্যাত্মিক শক্তি'। তিনি তার সাথে এনএসইর কোনো স্পর্শকাতর বিষয় শেয়ার করেননি।
তবে এসইবিআই বলছে, এই দাবি মিথ্যা। এই সাধুর হাত ছিল অনেক লম্বা। তিনি চিত্রার মাধ্যমে এসময় এক্সচেঞ্জে মধ্য পর্যায়ের একজন অফিসারকে নিয়োগ দেন। পুঁজি বাজার সম্পর্কে এই অফিসারের কোনো জ্ঞান ছিল না। কিন্তু তাকে সরাসরি চিত্রার উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং অন্যান্য অফিসারদের চেয়ে তার বেতন অনেক বেশি ধার্য করা হয়।
চিত্রার সাথে সাধুর এই সম্পর্কের কথা বোর্ডের অন্যান্য কর্মকর্তারা একেবারেই জানতেন না, এমন নয়। বোর্ডের কিছু কিছু সদস্য ও কর্মকর্তারা জানতে পেরেছিলেন যে চিত্রা রামকৃষ্ণের মাধ্যমে এক্সচেঞ্জের ভেতরের গোপনীয় তথ্য বাইরে পাচার হচ্ছে। কিন্তু তারা বিষয়টি এসইবিআইকে জানানোর বদলে গোপন রাখাই ঠিক মনে করেছিলেন।
তদন্তে এনএসইতে মারাত্মক অনিয়মের প্রমাণ মেলায় এনএসইকে ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা করে এসইবিআই। সাথে আগামী ৬ মাসের জন্য সিকিউরিটি মার্কেটে এনএসইর বিনিয়োগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি বাইরে তথ্য পাচারের কারণে এনএসইকে আরও ২.৭ লাখ ডলার জরিমানা ও আগামী ৬ মাসের মধ্যে কোনো নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়য়েছে।
শাস্তি হিসেবে হিমালয় সাধুর এই শিষ্যা চিত্রা রামকৃষ্ণকে প্রায় ৪ লাখ ডলার জরিমানা করা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী তিন বছর তিনি এসইবিআই-স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো স্টক এক্সচেঞ্জের সাথে যুক্ত হতে পারবেন না।
- সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড