নিজে করলেও আমেরিকা কেন অন্যের মাতব্বরি মানতে চায় না?
পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে রাশিয়ার সাম্প্রতিক শক্তিপ্রদর্শনের ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে সরব হয়েছেন সমালোচকরা। কেন আমেরিকা পুতিনের কিছু দাবি মেনে নিচ্ছে না- তারা সে প্রশ্নও তুলছেন। পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিলে বিপন্ন হবে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা। আর সেটাই তার মাথাব্যথা। ইউক্রেন কোনোদিনই ন্যাটো সামরিক জোটে যোগ দিতে পারবে না- তাহলে সে নিশ্চয়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাধা কোথায়? সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত কিছু অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব বলয় মেনে নিয়ে আমেরিকা কী যুদ্ধ/ সংঘাত এড়াতে পারে না?
এসব প্রশ্নের উত্তর নিহিত আমেরিকার ইতিহাসের গভীরে, যা অনেক পর্যবেক্ষক এখনও অনুধাবন করছেন না।
ভাল বা মন্দ যাই হোক—মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ঐতিহ্যগতভাবেই অন্য বিশ্বশক্তির প্রভাব খর্ব করার বৈশিষ্ট্যের জন্য পরিচিত। এমন নীতি স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী যুগে বিজয়ের উচ্চতায় পৌঁছেছিল- যা আজ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছে।
আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের বেশিরভাগ সময়েই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিক অঙ্গ ছিল—'প্রভাব বলয়।' নিজ সীমান্ত ঘনিষ্ঠতা অনুসারে পরাশক্তিগুলো প্রতিবেশী অঞ্চলে প্রধান শক্তির ভূমিকা রেখেছে। প্রভাবাধীন দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় এনেছে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন। এভাবে তারা প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তির হাত থেকে মুক্ত রেখেছে নিজ প্রভাবাধীন ভূখণ্ড।
আমেরিকাও তার ব্যতিক্রম নয়। যেমন দেশটি পরাশক্তি হয়ে ওঠার অগ্রযাত্রায় প্রথমে ক্যারিবিয় অঞ্চল এবং লাতিন আমেরিকা থেকে ইউরোপীয় শক্তিগুলোকে বহিষ্কার করে। ১৮৯৫ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিচার্ড ওলনি বলেছিলেন, "এই মহাদেশের অধিকার একমাত্র আমেরিকার। আমেরিকার ইচ্ছাই এ অঞ্চলে অনুগত রাষ্ট্রগুলোর জন্য আইন- তা মানা না মানার ওপর তাদের অবস্থান (শত্রু/মিত্র) নির্ণয় হবে।"
অথচ অন্য পরাশক্তির প্রভাব বলয়কে কোনোদিন মানেনি আমেরিকা। ১৮ শতক এবং ১৯ শতকের শুরুতে বিদেশি শক্তিগুলোর চীনকে বিভাজিত করার উদ্যোগে বাধ সাধে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা জড়ায় ইংলিশ চ্যানেল থেকে পূর্ব ইউরোপ পর্যন্ত জার্মান সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র প্রভাব বিলোপে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আরও বৃহৎ অঞ্চলে জাপান ও জার্মানির নিয়ন্ত্রণ রুখতে লড়েছে মার্কিন সেনারা।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ব্লককে চ্যালেঞ্জ করেছে আমেরিকা। এজন্য গোপন অভিযান, তথ্যযুদ্ধসহ মস্কোর নিয়ন্ত্রণ খর্ব করার সব চেষ্টাই চালিয়েছে ওয়াশিংটন।
প্রভাবের ক্ষেত্রগুলির প্রতি এই শত্রুতা- আমেরিকার বেশ কয়েকটি প্রধান কূটনৈতিক বৈশিষ্ট্যের ফলাফল। আসলে অন্য দেশের বাজার এবং সম্পদ নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা মার্কিনীদের বিভাজিত দুনিয়ার পরিণতি সম্পর্কে সন্ত্রস্ত করে তোলে। ভোগবাদী পুঁজিবাদের স্বাভাবিক চাহিদা আরও সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার- তা বৈরী পরাশক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকুক- যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায়নি।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় আগ্রহ দেখালেও- তা কোনোদিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিজ অঞ্চলে (প্রভাব বলয়ে) মহৎ আচরণ করতে শেখায়নি। একইসাথে মার্কিনীদের অসহিষ্ণু করেছে বিশ্বের দূরবর্তী অঞ্চলে অন্য পরাশক্তির কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ মেনে নেওয়ার বিষয়ে।
এমন দ্বিচারী আচরণের প্রধান কারণ- কৌশলগত। মার্কিন নীতি-পরিকল্পনাবিদদের সর্বদাই শঙ্কা বৈরী পরাশক্তিগুলো তাদের প্রভাবিত অঞ্চলে সংগঠিত হয়ে সেখান থেকে বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালাবে। এর পেছনে কোনো অংশেই কম দায়ী নয়- মার্কিনীদের 'ব্যতিক্রমবাদ' এ আস্থা—যেখানে বিশ্বাস করা হয়, আমেরিকা অন্য রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক ন্যায্যভাবে! শক্তিপ্রয়োগ করে। এভাবে তারা নিজেদের স্পষ্ট দ্বিচারীতার গ্লানি কমায়। ফলে মার্কিন প্রশাসনগুলো কোনোদিন অপরাধবোধে ভোগেনি। অন্যকে যা করতে দিতে যুক্তরাষ্ট্র নারাজ, নিজে সে 'মাতব্বরি' করে চলে নিঃসংকোচে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাববলয়-বিরোধী প্রকল্প দিনান্তে পৌঁছায়। ছিল না প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ইউনিয়ন। অন্যদিকে, বৈশ্বিক মিত্রদের সাথে নিয়ে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায় এগিয়ে রয় ওয়াশিংটন। এই ক্ষমতার বলে সে বড় দেশগুলির প্রতিবেশী জাতির ওপর প্রভাব বিস্তার রোধ করার একচ্ছত্র শক্তি অর্জন করে।
আমেরিকা তা প্রমাণ করতেই ১৯৯৬ সালে তাইওয়ানে চীনের আগ্রাসন ঠেকাতে দুটি বিমানবাহী রণতরী পাঠায়। নব-শক্তিতে বলীয়ান রুশ সাম্রাজ্যের উত্থানের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো জোটের বিস্তার ঘটায়। এমনকি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার সময় এই জো বাইডেনই বলেছেন- "আমরা কোনো দেশের প্রভাববলয় থাকা মেনে নেব না।"
যুক্তরাষ্ট্র প্রভাববলয়হীন বিশ্ব ব্যবস্থার প্রধান সুবিধাভোগী- বাইডেন তা ঠিকই বলেছেন। বাকি বিশ্বও এর সাথে দৃশ্যত দ্বিমত পোষণ করেনি। ঘরের কাছের আঞ্চলিক শক্তির হাতে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ভীতি থেকে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শুরু করে ইউরোপের বাল্টিক সাগর তীরবর্তী পূর্ব ইউরোপের মার্কিন মিত্র দেশগুলোও আমেরিকার এই একক রাজত্বকে স্বাগত জানাতে উৎসাহ দেখায়।
নেপথ্য এ কাহিনিই ব্যাখ্যা করছে কেন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের জন্য ন্যাটোতে যোগদানের দুয়ার বন্ধ করতে রাজি নয়। কেনইবা প্রতিবেশী দেশের ভূরাজনৈতিক সিদ্ধান্তে মস্কোর ভেটোদানের ক্ষমতাকে যেকোনো উপায়ে এড়াতে চায়। যদিও মার্কিন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে যে বিপজ্জনক বিশ্ব ব্যবস্থা এড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করেছেন এ নীতি তার পরিপন্থী।
অথচ স্নায়ুযুদ্ধের পর পরই আমেরিকা যে সর্বময় শক্তির শিখরে ছিল আজকের বিশ্বে তা বজায় রাখা দিনে দিনে নাটকীয়রুপে কঠিন হয়ে পড়ছে। পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়া প্রতিবেশী ইউক্রেন দখলের মতো সামরিক শক্তি পুনর্জীবিত করেছে। নিজ সীমান্ত লাগোয়া অন্য দেশেও করছে হস্তক্ষেপ। গত ১৫ বছরে ধরেই রাশিয়ার আঞ্চলিক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ব্যাপক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন পুতিন। জর্জিয়ার মতো যেসব দেশ তা মানতে চায়নি, সেখানে সামরিক অভিযানও পরিচালনা করেছে মস্কো।
রাশিয়ার এই নতুন জার প্রতিবেশী ইউক্রেন নিজস্ব ভূরাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করুক তা চান না- এজন্যই তিনি দেশটিকে ধবংসের হুমকি দিচ্ছেন।
অপরদিকে, ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানো হলে রাশিয়ার ওপর অকল্পনীয় মাত্রায় অর্থনৈতিক ও কূটনীতিক নিষেধাজ্ঞার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে আমেরিকা। এভাবে কিয়েভের পতনকে মস্কোর জন্য বিপুল ক্ষয়ক্ষতির করে তুলতে চাইছে হোয়াইট হাউস। নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া পরবর্তীতে অন্য প্রতিবেশীর ওপর আগ্রাসন চালানোর ক্ষমতাও হারাবে এমন লক্ষ্যই বাইডেন প্রশাসনের।
তবে এই পদক্ষেপ মস্কো ও ওয়াশিংটনের দ্বৈরথকে দেবে নতুন মাত্রা। পূর্ব ইউরোপে তাদের পরস্পরের প্রতি চোখ রাঙানি ও শক্তি প্রদর্শন বাড়বে বহুগুণে। পরমাণু অস্ত্রসজ্জিত দুই শক্তির যুদ্ধের সম্ভাবনায় বিশ্ব হবে আরও অনিরাপদ। ইউরোপ হারাবে স্থিতিশীলতা। এর প্রভাব পড়বে বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও।
পুতিন নতুন প্রভাবলয় সৃষ্টিতে দৃঢ়সংকল্প, আর আমেরিকার এতে বাধা দেওয়ার ইচ্ছে তাদের একে-অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যার অর্থ, রাশিয়ার সাথে সংঘাতের চরম মূল্য ও ঝুঁকির বিবেচনাতেই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির চিরকালীন এ বৈশিষ্ট্যটির (প্রভাব বলয় বিরোধিতার) অবসান হতে পারে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ
- লেখক: জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের হেনরি কিসিঞ্জার সম্মাননাপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউডে'র একজন গবেষক ও ব্লুমবার্গের নিয়মিত কলাম লেখক।