পুতিনের ভুল হিসেবনিকেশ!
সোমবার রাতে টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটা জিনিস স্পষ্ট করে দিয়েছেন—ইউক্রেনকে তিনি বৈধ স্বাধীন দেশ হিসেবে গণ্য করেন না। তারপর বৃহস্পতিবার সকালে সর্বাত্মক হামলা শুরুর মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, ইউক্রেনের ৩০ বছরের স্বাধীনতার ইতি টানাই তার পরিকল্পনা।
কিন্তু সামরিক শক্তিতে ইউক্রেনের চেয়ে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও পুতিন যতটা ভেবেছেন তত সহজে এ লক্ষ্য হাসিল হবে না।
পুতিন তার সামরিক বাহিনীকে বার্তা দিয়েছেন, ইউক্রেন শাসন করে 'নব্য নাৎসিরা'। তার এই বার্তা হাস্যকর। কেননা ইউক্রনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজেই ইহুদি। তবে এই বার্তা থেকে পুতিনের রণকৌশল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
পুতিনের আশা, রুশ বাহিনী ইউক্রেনে ঢুকে পড়ে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ সাপ্লাই রুট কেটে দেয়ার এবং প্রধান শহরগুলোকে ঘিরে ফেলার পর জেলেনস্কির সরকার ভেঙে পড়বে, ইউক্রেনিয়ান সৈন্যরা অস্ত্র নামিয়ে রাখবে এবং রুশ বাহিনীকে ফুলেল সংবর্ধনা জানানো হবে। যেন তারা ৮০ বছর আগেকার বিজয়ী লাল ফৌজ।
স্বল্পমেয়াদে এই আশা পূরণ হতে পারে। রাশিয়ার বিশাল প্রোপাগান্ডা মেশিন নিশ্চিতভাবেই এমন বিজয়ের একটা আবহ তৈরির জন্য রাত-দিন খাটবে। কিন্তু ইউক্রেনের ইতিহাস বলছে, দীর্ঘমেয়াদে এই ফল টিকবে না।
স্বাধীন দেশ হিসেবে বয়স বেশি না হতে পারে, কিন্তু ইউক্রেনের জাতীয় পরিচয় কয়েক শতাব্দী পুরোনো। এই পরিচয় যুগপৎভাবে রাশিয়ার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং রাশিয়া থেকে স্বতন্ত্র। ১৯৯১ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ইউক্রেনের।
দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ—এর মধ্যে একটি দুর্ভিক্ষ ইচ্ছেকৃত সৃষ্টি—আর রাশিয়ান জার, সোভিয়েত ও নাৎসি জার্মান শাসন…কোনো কিছুই জাতি হিসেবে ইউক্রেনকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। রাশিয়ার বর্তমান একনায়কের চেয়ে খারাপ ও বৈরী শত্রুর মোকাবিলা করে টিকে গেছে ইউক্রেনিয়ানরা।
এমনকি রুশ বাহিনী যদি ইউক্রেন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ইউক্রেনের সিংহভাগ অঞ্চলের দখল নিয়েও নেয়, তবু বেশ শক্ত প্রতিরোধ রয়ে যাবে। যুদ্ধ চালিয়ে যাবে ইউক্রেনিয়ান যোদ্ধাদের বড় একটি নেটওয়ার্ক।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনের বিমানঘাঁটিগুলোর দখল নিয়ে নিচ্ছে, ঢুকে পড়েছে রাজধানী কিয়েভে। কিন্তু ইউক্রেনের মতো বিশাল দেশ লম্বা সময় ধরে দখল করে রেখে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সক্ষমতা রুশ বাহিনীর নেই।
তারপরও যদি রাশিয়া গোয়ার্তুমি করে যুদ্ধ চালিয়ে যায়, তাহলে ১৯৮০-র দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নে যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিল, এবার তারচেয়েও খারাপভাবে ব্যর্থ হবে। মূল্যও চুকাতে হবে অনেক বেশি।
পুতিনের জীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং—তার দৃষ্টিতে—সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের ব্যর্থতা নিয়ে গবেষণা করে। ক্রেমলিনের ওপর জনগণের বিশ্বাস হারানোর পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল আফগানিস্তান অভিযান। পুতিনের বিশ্বাস ইউক্রেনের বেলায় এমনটা ঘটবে না। আর এটাই, খুব সম্ভব, তার সবচেয়ে গুরুতর ভুল।
এ কথা সত্য যে, ইউক্রেনিয়ান জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হামলাকারী রুশ বাহিনীকে স্বাগত জানাবে। রুশপন্থি হওয়ায় কিংবা বর্তমান শাসকদের দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠায় তারা রুশ বাহিনীকে স্বাগত করতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে এ কথাও সত্যি যে, ইউক্রেনিয়ানদের বড় একটা অংশ এ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তুলবে।
আর আফগানিস্তানে রুশ বাহিনী পরাজিত হয়েছে ইউরোপ থেকে অনেক দূরে। কিন্তু ইউক্রেনে রুশ বাহিনী প্রতিরোধের মুখে পড়বে খোদ ইউরোপের ভেতরেই, একেবারে ইউরোপিয়ানদের চোখের সামনে।
একুশ শতকে যেকোনো ঘটনা চোখের পলকে বন্দি হয়ে যায় স্মার্টফোনের ক্যামেরায়, তারপর প্রচার হয়ে যায় অনলাইনে। কাজেই রাশিয়ান বাহিনীর ওপর চালানো প্রতিটি হামলা তৎক্ষণাৎ প্রচার হয়ে যাবে অনলাইনে। ইউক্রেনিয়ানরা যদি গুলি করে একটিও রুশ হেলিকপ্টার ভূপাতিত করতে পারে, তা-ও প্রচার হয়ে যাবে অনলাইনে। যুদ্ধের প্রায় প্রতিটি ঘটনা, আহত ও মৃতদের ছবি সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাবে রুশ জনগণও।
আর তাতেই রুশ নেতৃত্বের ওপর থেকে আস্থা উঠে যেতে থাকবে জনসাধারণের। কয়েক দশক আগে যে গতিতে আফগানিস্তান অভিযানের ওপর থেকে জনসমর্থন উঠে গিয়েছিল, এবারের ইউক্রেনের ওপর থেকে জনসমর্থন উঠবে তারচেয়ে অনেক দ্রুতগতিতে।
আর ইতিমধ্যে দেখাও গেছে যে পুতিনের 'প্রজারা' প্রতিবেশীকে দখল করে নেয়ার ব্যাপারে অতি-উৎসাহী নয়। এমনকি ইউক্রেনে হামলার প্রতিবাদে খোদ রাশিয়াতেই অনেক শহরে বিক্ষোভ করেছে অনেক রুশ। এসব বিক্ষোভ থেকে সহস্রাধিক বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে পুতিনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পুতিন ইউক্রেনকে 'নাৎসিমুক্ত' করার যে দাবি করেছেন, তা যে অসার দাবি এসব বিক্ষোভই তার ছোট একটি প্রমাণ। খোদ রাশিয়াতেই সংবাদমাধ্যম এখনও এই হামলাকে এখনও 'দনবাস এলাকায় বিশেষ বাহিনীর অভিযান' হিসেবে উল্লেখ করছে।
২০১৪ সালে ক্ষুদ্র ক্রিমিয়ান উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। অতি অল্প সময়ের মধ্যে কোনো রকমের হতাহত হওয়ার ঘটনা ছাড়াই ক্রিমিয়া দখলে নিয়ে নেয় রুশ বাহিনী। এতে দেশে পুতিনের জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি বেশ বেড়েছিল। আর শত শত রাশিয়ানের জীবন—এবং সহস্র ইউক্রেনিয়ানের জীবনের বিনিময়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের দখল নেয়ার চেষ্টা ঘটেছে রাশিয়ান জনগণের চোখের আড়ালে। কিন্তু ইউক্রেনের বর্তমান যুদ্ধ চলবে প্রকাশ্যে, একে লুকানোর উপায় নেই। কাজেই এই যুদ্ধ পুতিনের সমস্ত হিসাব উল্টে দিতে পারে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পশ্চিমা গোয়েন্দারা পুতিনের যুদ্ধ-পরিকল্পনা মিডিয়ায় ফাঁস করে দিয়েছে। যারা ভেবেছিল পুতিনকে তারা বুঝতে পেরেছে, তারা বিশ্বাস করেনি যে তার মতো সতর্ক লোক ইউক্রেনে হামলা চালাবে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট। এখন তারা তো বটেই, সঙ্গে আরও অনেকেই পুতিন সম্পর্কে পূর্ব-বিশ্বাস নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবেন।
আর পশ্চিমা নেতারাও বুঝতে পারবেন, ইউরোপে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য তারা যে কাঠামোর ওপর আস্থা রেখেছেন, তা যথেষ্ট নয়। কূটনীতি ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে উন্মুক্ত বাণিজ্যের অর্থনৈতিক লাভ যুদ্ধ ঠেকিয়ে রাখবে—এ বিশ্বাসও মার খেয়ে গেছে।
চূড়ান্ত পরিণতি কঠিন, কিন্তু এ থেকে বাঁচার কোনো উপায়ও নেই। জিডিপির বেশিরভাগই ব্যয় করতে হবে প্রতিরক্ষা খাতে এবং জ্বালানিনীতি ঢেলে সাজানোতে। শুধু যে রাশিয়া থেকে জার্মানিতে নেওয়া প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম ২-ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নয়। আরও অনেক ক্ষতির মুখে পড়বে রাশিয়া।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার ন্যাটো-ত্যাগ নিয়ে নাটক করেছেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ দাবি করেছেন, সামরিক জোটটি 'ব্রেইন-ডেড' হয়ে গেছে। ন্যাটোর পরিবর্তে একটি ইউরোপীয় নিরাপত্তা ফ্রেমওয়ার্ক গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। কিন্তু ন্যাটো এখন আগের চেয়েও মূর্তিমান বাস্তবতা। জোটটির নেতারা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ন্যাটো নিয়ে নিজের হিসাবনিকাশেও ভুল প্রমাণিত হতে পারেন পুতিন।
পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের পক্ষে সামরিকভাবে পদক্ষেপ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন হামলার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমারা দেদারসে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক ও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। এছাড়াও রাশিয়া ও ইউক্রেন সীমান্ত-সংলগ্ন ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে সেনা উপস্থিতিও বাড়াতে পারে।
কাজেই সব মিলিয়ে পুতিন যে হিসাব কষে ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়েছেন, তা উল্টে যাওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে। তার জন্য ইউক্রেনই হয়ে উঠতে পারে ১৯৮০-র দশকের আফগানিস্তান, যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দখলদার সোভিয়েত বাহিনী।
- হারেৎজ থেকে নেওয়া, ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ