যেভাবে রাশিয়া-বিরোধী সাইবার যোদ্ধাদের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে টেলিগ্রাম
রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মাঝে সংঘর্ষ শুরু শুরু হওয়ার পর ভার্চুয়াল জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রাম। কারণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই অ্যাপে হ্যাকার এবং সাইবার অপরাধীদের আনাগোনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
সাইবার সিকিউরিটি কোম্পানি চেক পয়েন্টের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২৪ ফেব্রুয়ারির পর টেলিগ্রাম গ্রুপের সংখ্যা ছয়গুণ বেড়েছে এবং এদের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট গ্রুপ আকারে বেশ ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। কিছু কিছু গ্রুপের সদস্যসংখ্যা আড়াই লাখেরও বেশি।
ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে টেলিগ্রামের জনপ্রিয়তা বাড়ার পিছনে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে-
সাইবার যুদ্ধ
রাশিয়া বিরোধী সাইবার যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী গ্রুপদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী গ্রুপ হচ্ছে "ইউক্রেন আইটি আর্মি", যাদের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ৭০ হাজার।
ইউক্রেন জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব সাইবার-বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত হয়েছে এই আইটি আর্মি। এখন পর্যন্ত বেশ কিছু সফল অপারেশন পরিচালনা করেছে এই বাহিনী।
রাশিয়ান সাইটগুলোকে লক্ষ্য করে ডিডিওএস হামলা চালানোর পাশাপাশি রাশিয়ান মত-মোড়ল ও যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়ান ব্যক্তিত্বদের গোপন তথ্য প্রকাশ করে আসছে গ্রুপটি।
ক্রিপ্টো-ছিনতাইকারী
টেলিগ্রামের বেশিরভাগ স্ব-ঘোষিত "অনুদান" গোষ্ঠীই আসলেই স্ক্যাম, যারা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মানুষের অর্থ চুরি করছে।
ইউক্রেনের প্রতি সহমর্মিতাপূর্ণ ও ইউক্রেনকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে চায়, এমন ব্যক্তিরাই শিকার হচ্ছেন এই স্ক্যামের।
ভুয়া ও অসম্পাদিত সংবাদ
তৃতীয় কারণটি সংবাদ। যুদ্ধের সময়ে খবরের চাহিদা এমনিতেও বেড়ে যায়। জনগণের সেই বাড়তি চাহিদা মেটাচ্ছে টেলিগ্রাম।
মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোকে বাইপাস করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আসা অসম্পাদিত, সেন্সরবিহীন সংবাদ জায়গা করে নিচ্ছে টেলিগ্রামে। সেখানে যুদ্ধের সার্বক্ষণিক আপডেট দিচ্ছে কিছু টেলিগ্রাম চ্যানেল।
অসম্পাদিত যুদ্ধের দৃশ্য প্রকাশ করা সাংবাদিকতা নীতির বাইরে হলেও এসব চ্যানেলে কোনো যাচাই-বাচাই না করেই সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে।
চেক পয়েন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধ-সংক্রান্ত টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলো বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারীকে আকর্ষিত করছে। 'ইউক্রেন ওয়ার রিপোর্ট' নামের একটি চ্যানেলের সদস্যসংখ্যা ২০ হাজারের মতো। 'রাশিয়া বনাম ইউক্রেন লাইভ নিউজ'-এর সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ১০ হাজার।
রাশিয়ান যুদ্ধাপরাধ প্রকাশের লক্ষ্যে নিয়োজিত আরেকটি নিউজ চ্যানেল, 'ইউক্রেনিয়ান উইটনেস'-এর সদস্যসংখ্যাও এক লাখের মতো।
মূলত শত্রু পক্ষকে হতাশ করার লক্ষ্য নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে টেলিগ্রাম চ্যানেলগুলোতে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে যাচ্ছে কয়েকটি গোষ্ঠী।
এই চ্যানেলগুলোতে যে কোনো সঠিক তথ্য আসে না, ব্যাপারটা এমনও না। কিন্তু ব্যবহারকারীদের জন্য সত্য এবং বানোয়াট সংবাদের মধ্যে পার্থক্য করার কোনো সুযোগই নেই।
কিন্তু টেলিগ্রাম কেন?
টেলিগ্রামের মূল নীতিই হচ্ছে, তারা ব্যবহারকারীদের কোনোরকম সেন্সর করবে না। এখানে নিজের নাম বা ফোন নম্বর শেয়ার না করেই পোস্ট করতে পারেন ব্যবহারকারীরা। পারেন সর্বোচ্চ ২ লাখ মানুষ নিয়ে পাবলিক বা প্রাইভেট গ্রুপ তৈরি করতে, কিংবা চ্যানেল খুলে যত সম্ভব মানুষের কাছে নিজের কনটেন্ট সম্প্রচার করতে।
যে কারণে কম নিয়ন্ত্রিত প্লাটফর্ম খুঁজছে এমন ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ করে টেলিগ্রাম। অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এমন সব ব্যক্তিও এসে জায়গা করে নেয় এখানে।
বিগত কয়েক বছরে সাইবার-অপরাধীদের আখড়া হয়ে উঠেছে প্ল্যাটফর্মটি।
ফ্ল্যাশপয়েন্ট তাদের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রতি ১০ জনে ৬ জন রাশিয়ান টেলিগ্রাম ব্যবহার করে। কারণ তাদের কর্তৃত্ববাদী সরকার এই প্লাটফর্মে নজরদারি চালাতে পারে না।
রাশিয়ান ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) বছরের পর বছর ধরে টেলিগ্রাম বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ২০২০ সালে তারা শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
টেলিগ্রাম ব্যবহারকারী হয়ে থাকলে আপনার জন্য পরামর্শ থাকবে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যেসব চ্যানেল ফলো করেছেন, কেবল সেগুলোকেই বিশ্বাস করুন।
পাশাপাশি, এখন নতুন কোনো রিকুয়েস্ট আসলে তাকে অবশ্যই সন্দেহের সাথে বিবেচনা করা উচিত আপনার। এবং যেই আশ্বাসই দেওয়া হোক না কেন, কাউকে টাকা পাঠানো থেকে বিরত থাকুন।
সবশেষে, টেলিগ্রামের নিউজ ফিডে পাওয়া কোনো সংবাদ যাচাই না করে অন্য প্লাটফর্মে পোস্ট করা থেকে বিরত থাকুন।
সূত্র: ব্লিপিং কম্পিউটার।